ভেসে এল ব্যারিটোন কণ্ঠ...'বংশী, ছবিটা আমার'...মাপা কথায় শ্যুটিং ফ্লোরে নেমে এল স্তব্ধতা
- Published by:Rukmini Mazumder
- news18 bangla
Last Updated:
লেজিয়ঁ দ্য নর সম্মানে সম্মানিত এই বাঙালির জন্যই হীরকরাজাকে খানখান করার স্বপ্ন দেখতে পারে উদয়ন পণ্ডিতরা। অরিন্দমরা টেবিল চাপড়ে বলতে পারে, " আই উইল গো টু দ্য টপ, দ্য টপ, দ্য টপ!"... ১০০ তম জন্মদিনে 'মহারাজা তোমারে সেলাম'
advertisement
১০০, গড়পার রোডের বাড়ি। ঠাকুরদাদার শূন্য কাজের ঘর থেকে একটি কাঠের বাক্স পেয়েছিল ছেলেটি। সেখানে থাকত ঠাকুরদাদার রং, তুলি আর তেলরঙের কাজে ব্যবহারের জন্য লিনসিড অয়েলের শিশি। উত্তরাধিকারের সেই ধারা পরবর্তী কালে প্রজন্মজয়ী হয়েছিল বালকের হাত ধরেই। লেজিয়ঁ দ্য নর সম্মানে সম্মানিত এই বাঙালির জন্যই হীরকরাজাকে খানখান করার স্বপ্ন দেখতে পারে উদয়ন পণ্ডিতরা। অরিন্দমরা টেবিল চাপড়ে বলতে পারে, " আই উইল গো টু দ্য টপ, দ্য টপ, দ্য টপ!"... ১০০ তম জন্মদিনে 'মহারাজা তোমারে সেলাম'
advertisement
গোড়ায় তিনি ছিলেন মূলত চিত্রনাট্যকার ও পরিচালক: 'তিন কন্যা' ছবি থেকে নিজের ছবির সুর রচনাতেও হাত দিলেন। ১৯৬১ সালের গোড়ার দিক, 'তিন কন্যা' ছবির তৃতীয় অংশ 'সমাপ্তি'র শ্যুটিং চলছেল একদিন ফ্লোরে একটি সিকোয়েন্সের প্রস্তুতি চলছে। নিখোঁজ মৃন্ময়ীর সন্ধান না পেয়ে বৃষ্টিতে ভেজা অপূর্ব নিজের ঘরে ফিরছে। অবশ্য মৃন্ময়ী আগেই সে ঘরে পৌঁছে গিয়েছে। সেটের একপাশে পায়চারি করছিলেন সত্যজিৎ রায়। দাঁতে চাপা রুমালের খুঁট-- চিন্তামগ্ন সত্যজিতের মুদ্রাদোষ। এ'দিকে ক্যামেরার কাছাকাছি তখন কলাকুশলীদের জটলা, সিকোয়েন্সটার শ্যুট নিয়ে চলছে জোর আলোচনা। এঁদের মধ্যে শিল্পনির্দেশক বংশী চন্দ্রগুপ্ত ছিলেন বেশি সরব। সবাই যখন নিজেদেত মত প্রকাশ করতে ব্যস্ত, যারপরনাই ব্যস্ত বংশী চন্দ্রগুপ্ত, আচমকাই ভেসে এল সত্যজিতের ব্যারিটোন কন্ঠ, '' বংশী, ছবিটা আমার''... মাপা কথার সঙ্গে নেমে এল স্তব্ধতা...
advertisement
শুরু হল 'অপুর সংসার'-এর শুটিং। তেমন কোনও একটা রিহার্সালের ব্যবস্থা ছিল না। কিন্তু সত্যজিৎ রায় খুব ধীরে ধীরে এবং অনেকটা অলক্ষিতভাবেই সৌমিত্রকে অপুর চরিত্রের জন্য তৈরি করে নিয়েছিলেন। 'পথের পাঁচালি'র পরে সত্যজিৎ রায় যখন 'অপরাজিত'-র অপুর জন্য কিশোর অভিনেতা খুঁজছেন, তখন তাঁরই একজন সহকারী সৌমিত্রকে রায়ের কাছে হাজির করেছিলেন। কিন্তু অপুর জন্য সৌমিত্রর বয়সটা বেশি ছিল, তাই নির্বাচিত হননি। অনেক পরে সৌমিত্র জেনেছিলেন, ট্রিলজির তৃতীয় পর্বে যুবক অপুর চরিত্রে অভিনয় করার জন্য তখন থেকেই সত্যজিৎ তাঁর কথা ভেবে রেখেছিলেন।
advertisement
'অপুর সংসার' করার সিদ্ধান্ত নেওয়ার পর সৌমিত্রকে ডেকে পাঠালেন সত্যজিৎ। বললেন, বিভূতিভূষণের মূল উপন্যাসটা ঝালিয়ে নিতে। জানালেন ক্যামেরা টেস্ট ও ভয়েস টেস্ট-ও হবে! সৌমিত্রর ভাষায়, '' এই টেস্ট নেওয়ার ব্যাপারটা নিয়ে তখন বিশেষ কিছু ভাবিনি। মনে হয়েছিল সিনেমা তৈরি যে-দুটি যন্ত্রের ওপর প্রধানত নির্ভর করে, সে-দুটোর নিরিখে আমার উপযুক্ততা যাচাই করে নেওয়ার ইচ্ছেটা তো পরিচালকের পক্ষে খুবই স্বাভাবিক। কিন্তু বহু পরে আমার মনে হয়েছে যে সত্যজিৎ রায়ের মতো শিল্পীর অভিজ্ঞ চোখকে ক্যামেরা টেস্ট-এর জন্য নিশ্চয়ই অপেক্ষা করতে হয়নি-- আমার ছবি ক্যামেরায় কেমন আসবে তা বোঝার জন্য! ভয়েস টেস্টের ক্ষেত্রেও সেই একই কথা খাটে। আর সত্যিসত্যি যখন সত্যজিৎ রায় আমার ভয়েস টেস্ট নিলেন, তখন আসল শুটিং শুরু হতে আর বেশি দেরি নেই এবং তার আগে আমি জেনেই নিয়েছি যে আমি ওই চরিত্রের মনোনীত অভিনেতা। তাও যে ক্যামেরা টেস্ট নিয়েছিলেন, তার কারণ, একজন নবাগত যাতে ক্যামেরার সামনে অভিনয় করতে গিয়ে মানসিক অস্বাচ্ছন্দ্য বোধ না করে, ক্যামেরা যন্ত্রটার সঙ্গে তার যাতে একটা পরিচয় ঘটে, এই কথা ভেবেই। আমাকে চলচ্চিত্রের অভিনেতা হিসেবে প্রস্তুত করে নেওয়ার ওটা ছিল অন্যতম প্রক্রিয়া।''
advertisement
ক্যামেরার সামনে অভিনয় আর সিনেমার শুটিং পদ্ধতির সঙ্গে খানিকটা পরিচিত করাতে সত্যজিৎ সৌমিত্রকে তাঁর দুটি ছবি 'পরশ পাথর' ও 'জলসাঘর'-এর সেটে আসতে বলেছিলেন। 'অপুর সংসার'-এর শুটিং শুরু হওয়ার বেশ কিছুদিন আগে তিনি সৌমিত্রকে 'অপুর সংসার'-এর চিত্রনাট্যর একটি খসড়া দিয়েছিলেন, সঙ্গে ফুলস্ক্যাপ কাগজে 'অপু' চরিত্রের একটি ধারণা ও অপু-অপর্ণার সম্পর্ক নিয়ে দু পাতার একটি নোট। অপুর বাঁশি বাজানোর দৃশ্য থাকবে ছবিতে। সুরটা নাহয় সত্যি সত্যি অভিনেতা না বাজালেও চলবে, কিন্তু বাঁশি বাজানো না জানলে বাঁশির ফুঁ এবং আঙু'পলের টিপ থেকে ধরা পড়ে যাবে, অভিনেতা বাঁশি বাজাতে জানেন না! কাজেই বাঁশি বাজানো শিখতে গৌর গোস্বামীর কাছে নাঁড়া বাঁধলেন সৌমিত্র।
advertisement
'পথের পাঁচালি'-র এক-একটি চিত্রমুহূর্ত, এক-একটি ঘটনা চিত্রভাষাতেই মূর্ত। দুর্গাকে ঘিরে সর্বজয়া ও ইন্দির ঠাকরুণের কথাবার্তা, অপুর প্রথম পাঠশালা যাওয়া, পাঠশালার অবস্থা, অপু-দুর্গার কাশবন পেরিয়ে ট্রেন দেখা , ঝড়ের রাতে দুর্গার মৃত্যু, হরিহরের বাড়ি ফিরে দুর্গার মৃত্যুসংবাদ জানা...এমন অসংখ্য দৃশ্যের সাহায্যে পথের পাঁচালি হয়ে উঠেছে এক সর্বকালীন মাস্টারপিস। 'অপরাজিত' ছবি তৈরির সময় নবম কান চলচ্চিত্র উৎসবে পথের পাঁচালি 'শ্রেষ্ঠ মানবিক দলিল' রূপে পুরস্কার পেল। সত্যজিৎ রায় বলেছিলেন, '' কিন্তু দায়িত্বটা যে বেড়ে গেল, তাই না''
advertisement
পঞ্চাশের মন্বন্তরকে কেন্দ্র করে 'অশনি সংকেত'। এ মন্বন্তর কোনও কোনও প্রাকৃতিক দুর্যোগের ফল নয়, মানুষের প্রলোভন ও অন্যায় কাজের পরিণতি। এই সর্বনাশের কালো ছায়া প্রত্যক্ষ করেছিলেন সত্যজিত নিজেও। এই কারণেই বিভূতিভূষণের 'অশনি সংকেত' উপন্যাসটির প্রতি সত্যজিতের দুর্বলতা ছিল। জাতপাতের বিরুদ্ধে বুদ্ধিদীপ্ত প্রতিবাদ ফুটে উঠেচে ছবিজুড়ে। জাতপাতের সমস্যা আরও দৃঢ়ভাবে ফুটে ওঠে 'সদগতি' ছবিতে... ব্রাহ্মণ ঘসিরাম দুখী চামারের শব না ছুঁয়ে দড়ি দিয়ে টেনে নিয়ে যাবে, দুখীর বউয়ের কান্না, কাঠের উপর কুড়ুলের ফলা...
advertisement
advertisement
সত্যজিতের জীবনের শেষ পর্বের তিনটি ছবি 'গণশত্রু', 'শাখা-প্রশাখা' এবং 'আগন্তুক'। অসুস্থতার জন্য 'ঘরে-বাইরে'-র খানিকটা অংশের কাজ ব্যহত হয়েছিল। 'গণশত্রু' দিয়ে তাঁর কাহিনীচিত্র-নির্মাণে ফিরে আসা। ইতিমধ্যেই বিদেশে হার্ট সার্জারি হয়েছে, বড় রকমের কাজ কয়েক বছর বন্ধ রাখতে হয়েছিল। মূলত স্টুডিওর ভিতরে কাজ করার সীমাবদ্ধতা আরোপিত হওবার জন্য ছবির বিষয় নির্বাচনও সেই ভেবে করতে হয়েছি। এ-কালের সমাজের নানা ব্যাধি, ব্যাপক দুর্নীতি ও ধর্মচারণের নামে কুসংস্কার ও ব্যবসা ফুটে ওঠে 'গণশত্রু' ও 'শাখা-প্রশাখা'য়।