নয়াদিল্লি: ভোট আসে ভোট যায়। তার মাঝখানে সেতুর মতো দুলতে থাকে ঝকঝকে প্রতিশ্রুতি দেওয়া আর তা না পূরণের পর্ব। ভোটের সময় মূল্যবান হয়ে যাওয়া নাগরিকের দরবারে হাজির হন নানা দলের প্রতিনিধি। চলতে থাকে প্রতিশ্রুতির অঝোর ধারাবর্ষণ। অভিযোগ, তারপর সব ভুলে যান জয়ী জনপ্রতিনিধি।
চলতি বছরের শুরুতে সুপ্রিম কোর্টে দায়ের করা এক জনস্বার্থ মামলা এ বিষয়ে নতুন করে বিতর্ক তৈরি করেছে। এতে বলা হয়েছে যে নির্বাচনের আগে জনসাধারণের তহবিল থেকেই অযৌক্তিক বিনামূল্য পরিষেবা দেওয়ার প্রতিশ্রুতি ভোটারদের প্রভাবিত করতে পারে। যা আদতে অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের ধারণার মূলে কুঠারাঘাত ছাড়া আর কিছু নয়। এতে নির্বাচনী প্রক্রিয়ার বিশুদ্ধতাও নষ্ট হয়।
সম্প্রতি প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি (PM Narendra Modi), ভোটের জন্য বিনামূল্যে পরিষেবা প্রদানের এই কৌশলকে "রেউড়ি (তিল-গুড়ের তৈরি মিষ্টি) সংস্কৃতি" বলে চিহ্নিত করেছেন। মানুষকে সতর্ক করে তিনি বলেন, দেশের উন্নয়নের জন্য ‘খুব বিপজ্জনক’।
তবে এই প্রবণতা নতুন নয়। গত কয়েক দশক ধরে ভারতের রাজনীতিতে প্রাক-নির্বাচনী প্রতিশ্রুতি এক জনপ্রিয় অনুষঙ্গ। নগদ অর্থ থেকে মদ, গৃহস্থালির প্রয়োজনীয় সরঞ্জাম বা মাসিক বৃত্তি, ভর্তুকি এবং খাদ্যশস্য— সবই থাকে এই বিনামূল্য বিতরণের প্রতিশ্রুতিতে ৷
দেখে নেওয়া যাক কিছু চমকে দেওয়ার মতো প্রতিশ্রুতি—
বিনামূল্য রাজনীতির 'আম্মা'!
তামিলনাড়ুর প্রয়াত মুখ্যমন্ত্রী এবং AIDMK নেত্রী জয়া জয়ললিতা (J Jayalalithaa) বিভিন্ন ভাবে এই বিনামূল্য সংস্কৃতির অন্যতম পথিকৃৎ। তিনি ভোটারদের বিনামূল্যে বিদ্যুৎ, মোবাইল ফোন, ওয়াইফাই সংযোগ, ভর্তুকিযুক্ত স্কুটার, সুদমুক্ত ঋণ, বৈদ্যুতীন পাখা, মিক্সার-গ্রাইন্ডার, বৃত্তি-সহ অনেক কিছুর প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন। তিনিই প্রথম শুরু করেছিলেন ‘আম্মা ক্যান্টিন’। পরবর্তী কালে এই প্রকল্প বিরাট সাফল্য পেয়েছিল। তবে এ বিষয়ে তাঁর পথপ্রদর্শক ছিলেন তাঁর পূর্বসূরি মুখ্যমন্ত্রী সিএন আন্নাদুরাইয়ের (CN Annadurai), তিনি ১৯৬০-এর দশকে ১ টাকায় এক কিলোগ্রাম চাল দেওয়ার ঘোষণা করেছিলেন।
আরও পড়ুন- আরও ফ্ল্যাটের হদিশ মিলবে পার্থ-অর্পিতার? আরও কোটি-কোটি টাকা? অর্পিতাকে ঘিরে ধরছে ইডি
দূর-দর্শন রাজনীতি
জয়ার বিপক্ষে তামিলনাড়ুতেও পিছিয়ে ছিল না DMK। ২০০৬ সালে, তারা জনগণকে বিনামূল্যে রঙিন টেলিভিশন সেট এবং দারিদ্র্য সীমার নীচে (BPL) পরিবারের জন্য রান্নার গ্যাস সংযোগ দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দেয়। ২০১১ সালে ক্ষমতায় ফিরে জয়ললিতা DMK-এর ‘রঙিন টিভি স্কিম’ বাতিল করেন।
নগদ নারায়ণ ও উইকিলিকস
২০১১ সালে, তামিলনাড়ুতে ‘ক্যাশ-ফর-ভোট’ (Cash-for-vote) কেলেঙ্কারির সূত্রপাত হয়। ‘উইকিলিকস’ (WikiLeaks) নামে এক কেবল সংস্থা তথ্য ফাঁস করে অভিযোগ তোলে যে রাজনীতিবিদরা ২০০৯ সালের থিরুমঙ্গলাম (Thirumangalam) উপ-নির্বাচনে ভোটারদের প্রভাবিত করার জন্য নির্বাচনী আইন লঙ্ঘন করার কথা স্বীকার করেছে।
সংস্থাটি দাবি করে DMK ভোটারদের প্রভাবিত করতে নগদ টাকা বিতরণ করেছে। তারা বলে, ‘মাঝরাতে ভোটারদের হাতে টাকা গুঁজে দেওয়ার পুরোন পদ্ধাতি ছেড়ে DMK তিরুমঙ্গলমে সকালের সংবাদপত্রের ভিতর একটি করে খাম পৌঁছে দিয়েছে। ওই খামে টাকার সঙ্গে রাখা ছিল 'ভোটিং স্লিপ'। সেখানে নির্দেশ দিয়েছিল যে কাকে ভোট দিতে হবে।’ ‘উইকিলিকস’ (WikiLeaks) দাবি করে, এই পদ্ধতিতে সকলকে ঘুষ নিতে বাধ্য করেছিল DMK।
ল্যাপটপের লোভ
২০১৩ সালে, উত্তর প্রদেশের অখিলেশ যাদবের (Akhilesh Yadav) সমাজবাদী পার্টি সরকার ছাত্রদের জন্য একটি ‘বিনামূল্য ল্যাপটপ প্রকল্প’ ঘোষণা করেছিল। এতে অখিলেশ তরুণ প্রজন্মের মন জিতে রাজনৈতিক সুবিধা নিয়েছিলেন বলেই অনেকে মনে করেন। ২০১২ থেকে ২০১৫ সালের মধ্যে উত্তরপ্রদেশ সরকার মোট ১৫ লক্ষ ল্যাপটপ বিতরণ করে।
শস্যের সম্ভার
১৯৯৭ সালে পঞ্জাবে, শিরোমণি আকালি দল ক্ষমতায় এসেছিল এক বিশেষ প্রতিশ্রুতি দিয়ে। কৃষকদের বিনামূল্যে বিদ্যুৎ দেওয়ার প্রতিশ্রুতি সে বার ভোটে বড় ‘ফ্যাক্টর’ হয়েছিল। কিন্তু ২০০২ সালে কংগ্রেসের মুখ্যমন্ত্রী ক্যাপ্টেন অমরিন্দর সিং (Amarinder Singh) রাজকোষ ঘাটতির কারণে এই প্রকল্প বাতিল করতে বাধ্য হন। কিন্তু ফের তা চালু করতে হয় সে রাজ্যে।
বিল হত্যা
দান রাজনীতির অন্যতম ধারক বর্তমান দিল্লির মুখ্যমন্ত্রী অরবিন্দ কেজরিওয়াল (Arvind Kejriwal) ও তাঁর নেতৃত্বাধীন আম আদমি পার্টি (AAP)। ২০১৫ সালে দিল্লি বিধানসভা নির্বাচনের আগে AAP বিদ্যুৎ বিতরণ সংস্থাগুলির একটি অডিটের মাধ্যমে গ্রাহকদের বিদ্যুতের ব্যয় ৫০ শতাংশ হ্রাস করার এবং প্রতিটি বাড়িতে প্রতিদিন ৭০০ লিটার জল বিনামূল্যে দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল। তারপরই এক ঐতিহাসিক জয়ের মুখ দেখেন কেজরি।
এই মুহূর্তে দিল্লি ছাড়িয়ে দেশের অন্যরাজ্যগুলিতেও নিজেদের আধিপত্য বিস্তার করতে চাইছে কেজরিওয়ালের নেতৃত্বাধীন APP। ইতিমধ্যেই পঞ্জাবকে তার মুকুটের অন্যতম পালক হিসেবে যুক্ত হয়েছে। সেখানে নির্বাচনের আগে AAP যুবকদের জন্য বৃত্তি, বয়স্কদের জন্য তীর্থযাত্রা এবং মহিলাদের হাতে অর্থ ইত্যাদির মতো নানা প্রতিশ্রুতি-বাণে তার তূণীর সাজিয়ে তুলেছে।
চাঁদের প্রতিশ্রুতি
সব থেকে চমকদার প্রতিশ্রুতি মিলেছিল তামিলনাড়ু থেকেই। গত বছরের তামিলনাড়ু নির্বাচনে, দক্ষিণ মাদুরাই আসন থেকে নির্দল প্রার্থী থুলম সারাভানান (Thulam Saravanan) চাঁদের মাটিতে ১০০ দিনের বিনামূল্য ভ্রমণের প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন। সঙ্গে ছিল আইফোন, গৃহকর্ত্রীদের ঘরোয়া কাজে সাহায্য করার রোবট, প্রত্যেকের জন্য সুইমিং পুল-সহ তিনতলা বাড়ি, মিনি-হেলিকপ্টার, মেয়েদের বিয়ের জন্য ১০০টি স্বর্ণমুদ্রা, প্রতিটি পরিবারের জন্য একটি নৌকা এবং যুবকদের ব্যবসায়িক উদ্যোগ শুরু করার জন্য ৫০ হাজার ডলার দেওয়ার কথাও বলেছিলেন। এমন চটকদার প্রতিশ্রুতিতে অবশ্য চিঁড়ে ভেজেনি।
নিউজ১৮ বাংলায় সবার আগে পড়ুন ব্রেকিং নিউজ। থাকছে দৈনিক টাটকা খবর, খবরের লাইভ আপডেট। সবচেয়ে ভরসাযোগ্য বাংলা খবর পড়ুন নিউজ১৮ বাংলার ওয়েবসাইটে।
Tags: Politics