#পূর্ব মেদিনীপুর: ময়না গড়! পূর্ব মেদিনীপুরের ময়না ব্লকের কাঁসাই নদীর পশ্চিম পাড়ে অবস্থিত। দুই প্রশস্ত পরিখা দ্বারা বেষ্টিত ভূখন্ড ময়না গড়। হাজার বছরের ইতিহাসের সাক্ষী ময়না গড় (maynagarh)। ধর্মমঙ্গল খ্যাত লাউসেনের কাহিনী এখনো মানুষের মুখে মুখে ঘুরে।
গৌড় থেকে লাউসেন তার রাজধানী ময়না(maynagarh) স্থানান্তরিত করে। হাজার বছর ধরে আজও পূজিত হয় রঙ্কিনী দেবী। ধর্মমঙ্গল কাহিনী কে বাদ দিলেও ময়না গড়ের বয়স কিন্তু কম নয়। কলিঙ্গ সাম্রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত 'জলৌতি দণ্ডপাট' এর অধিকারী ছিল বাহুবলিন্দ্র রাজপরিবারের পূর্ব পুরুষেরা। পর্যন্ত 'জলৌতি দণ্ডপাট' এর রাজধানী ছিল বালিসিতা গড়। এই বালিসীতা গড় থেকেই ১৫৬১ সালে বাহুবলীন্দ্র রাজপরিবারের পূর্বপুরুষ গোবর্ধননন্দ বাহুবলীন্দ্র প্রথম ময়না গড়ে রাজধানী স্থাপন করেন। দুটি প্রশস্ত পরিখা ঘেরা এই গড় বর্তমানে মানুষের মূল আকর্ষণের কেন্দ্রবিন্দু।
ময়না গড়(maynagarh) দুটি পরীখা দ্বারা বেষ্টিত। কালিদহ মাকড়দহ দুই প্রশস্ত পরিখা আলাদা করে রেখেছে ময়না গড়কে। শত্রুর আক্রমণ হাত থেকে রক্ষা করার জন্য এই দুটি প্রশস্ত পরিখা কাটা হয়েছিল। জনশ্রুতি আছে নিরাপত্তা সুনিশ্চিত করতে একসময় এই পরিখা গুলিতে কুমীর ছাড়া থাকত। এছাড়াও পরিখা বেষ্টিত এই ভূখণ্ডের চারপাশে কাটা জাতীয় বাঁশের বন লাগানো হয়েছিল। ঘন কাটা জাতীয় বাঁশের জঙ্গল তীর ধনুক ভেদ করতে পারত না। যার আজও বর্তমান। গড়ের ভেতরে প্রবেশের একমাত্র উপায় নৌকো। বর্তমানে বাহুবলীন্দ্র রাজপরিবারের কিছু সদস্যরা এখন গড়ে বাস করে। যাদের নিত্যপ্রয়োজনে নৌকো ঘাটে বাঁধা থাকে।
ময়না গড়ের (maynagarh)ভেতরে সর্বধর্ম সমন্বয়ের নিদর্শন বর্তমান। ময়না গড়ের ভেতরে হিন্দু বৌদ্ধ ও মুসলিম ধর্মালম্বীদের জন্য আলাদা আলাদা উপাসনা কেন্দ্র আছে। ধর্মমঙ্গলের লাউসেনের ধর্ম ঠাকুরের পুজোর প্রসঙ্গ যেমন আসবে তেমনি তিন শতাব্দী প্রাচীন হজরত তুর জালাল শাহের দরগা দেখতে পাবেন। আছে রাজপরিবারের কুল দেবতা শ্যামসুন্দর জিউ। শ্যামসুন্দর জিউকে কেন্দ্র করে প্রতিবছর রাসমেলা বসে। ময়না গড়ের রাসমেলার বর্তমান বয়স ৪৬১। রাসমেলা দুই সম্প্রদায়ের মানুষের মিলনের মেলা। রাস মেলার কমিটি গড়া হয়েছে হিন্দু-মুসলমান উভয় সম্প্রদায়ের মানুষদের নিয়ে। ময়না রাসের বিখ্যাত থালার মত বড় বড় বাতাসা ও ফুটবলের মতো বড়-বড় কদমা মিষ্টি অন্যতম আকর্ষণ।
ময়নার গড়ের (maynagarh)অন্দরে রয়েছে অনেকগুলি দর্শনীয় স্থান। প্রায় হাজার বছরের প্রাচীন শিব মন্দির লোকেশ্বর জিউর মন্দির। এখানে শিবলিঙ্গের অবস্থান ভূপৃষ্ঠ থেকে অনেক নিচে। নদীর জোয়ারের সময় শিবলিঙ্গ উপরে উঠে আসে। এই মন্দিরের সঙ্গে কাঁসাই নদীর সংযোগ রয়েছে। আজও কাঁসাই নদীর জোয়ারের সময় শিবলিঙ্গ উপরে উঠে আসে আবার ভাটার সময় নিচে চলে যায়। পাশেই আছে রঙ্কিনী দেবীর মূর্তি। এক হাজার বছরের প্রাচীন মূর্তি। সারাবছরের নিত্য পূজার পাশাপাশি। দুর্গাপূজার সময় বিশেষ পূজা হয় এই চারদিন। ময়না গড়ের অন্দরে রয়েছে কুল দেবতা শ্যামসুন্দর জিউর মন্দির। প্রতিদিন নিত্য হয়। প্রতিদিন কাঠের উনুনে ভোগ রান্না সম্পন্ন হয়। ময়না গড়ের ভেতরে দেবতার কাহিনীর পাশাপাশি অপ দেবতার কাহিনী লোকমুখে শোনা যায়। লোকের বিশ্বাস প্রাচীন তেতুল গাছে একসময় ব্রহ্মদৈত্য থাকত। আজও তেঁতুল গাছের তলায় দাঁড়াতে গা ছমছম করে বৈকি।
পুরনো রাজবাড়ি, রাজ দরবার কাছারিবাড়ি, গুপ্ত ঘর এসবের পাশাপাশি রয়েছে ২০০ বছরের প্রাচীন কাঁঠাল গাছ। কাঁঠাল গাছের বর্তমানে কান্ড খুঁজে পাওয়া মুশকিল। শ্যামসুন্দর জিউর মন্দিরের পাশে রয়েছে এই কাঁঠাল গাছ। এছাড়াও অন্যতম দর্শনীয় জায়গা আয়না পুকুর। আয়না পুকুর নিয়ে দু'ধরনের জনশ্রুতি আছে(maynagarh)। একটি জনশ্রুতি হল রাজ দরবারে বিচারের অপরাধীদের শূলে চড়ানো হত। তাদের দেহ ফেলা হতো এই আয়না পুকুরে। কেউ কেউ আবার বলে রাজদরবারের মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত অপরাধীদের মাথা কেটে ফেলা হতো আয়না পুকুরে। এছাড়াও আয়না পুকুর নিয়ে রাজ পরিবারের সদস্যের কথা অনুযায়ী এটি ছিল রাজপরিবারের মহিলাদের স্নানের পুকুর। পুকুর সংলগ্ন একটি ঘর ছিল। যেখানে বড় বড় আয়না লাগানো ছিল সেই থেকে এর নাম আয়না পুকুর। এই পুকুরের আনুমানিক বয়স কত আজও নির্ণয় করা যায়নি।
পূর্ব মেদিনীপুরের অন্যতম প্রাচীন জনপদে প্রশাসনের উদাসীনতায় অবহেলা অনাদরে গড়ে ওঠেনি কোন পর্যটন কেন্দ্র। ২০০৬ সালে ময়না গড় হেরিটেজ ঘোষণা হয়। পূর্ব মেদিনীপুরের পর্যটন মানচিত্রে স্থান পেলেও গড়ে ওঠেনি পর্যটকদের থাকা-খাওয়ার জন্য কোন অতিথিশালা। হলে ময়না গড়ে থাকার কোন ব্যবস্থা নেই। নেই মূল ভূখন্ড থেকে পরিখা বিশিষ্ট ভূখণ্ড ময়না গড়ে যাওয়ার কোন সরকারি ব্যবস্থা। ময়নাগর পৌঁছাতে হলে রাজ পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে যোগাযোগ করতে হবে। তাদের পরিবারের জন্য ব্যবহৃত নৌকো আপনাকে নিয়ে যাবে ময়না গড়ে।
ময়না আসার রাস্তা দু দিক দিয়েই আছে। বলাইপণ্ডা(maynagarh) মেচেদা রাজ্য সড়ক ময়না গড়ের কাজ দিয়েই চলে গেছে। ট্রেনে মেছাদা স্টেশন থেকে ময়নাগামী বাস উঠে ময়না বাজারে নেমে ময়না গড়ে আসা যায়। মেছাদা ময়নার দূরত্ব ৩১ কিলোমিটার। কলকাতা থেকে বাসে করে নিমতৌড়ি বাসস্ট্যান্ডে নেমে ময়না আসা যায়। নিমতৌড়ি থেকে ময়নার দূরত্ব ৭ কিলোমিটার। মেছেদা, নিমতৌড়ি ও তমলুক থেকে প্রচুর বাস, টোটো, ট্রেকার ছোট কারী নির্দিষ্ট সময় অন্তর অন্তর যাতায়াত করছে ফলে যাতায়াতের কোনো অসুবিধা নেই ময়না গড়ে আসার।
ময়নাগড়ে(maynagarh) থাকার কোন ব্যবস্থা নেই। সারাদিন ময়নাগড় থেকে সন্ধে নামার আগেই নৌকায় করে ময়না বাসস্ট্যান্ডে ফিরে আসতে হবে। খাওয়ার সঙ্গে করে নিয়ে যেতেও পারেন। এছাড়া আগে থেকে বলে রাখলে ময়না রাজবাড়ীর কুল দেবতার ভোগ প্রসাদ পেয়ে যাবেন দুপুরে। রাজপরিবারের নৌকোয় করে পরিখা প্রদক্ষিণ করতে পারেন। নৌকোয় বসে পরিখা থেকে রাজ গড়ের ছবি তোলার জন্য উপযুক্ত। তাই বর্তমানে কিছু ছবি শিকারি দল ও ইতিহাস প্রেমী মানুষজনের ময়নাগড়ে আসছে। দুর্গাপূজায় এক বেলা ময়নাগড়ে কাটিয়ে যাওয়ায় আদর্শ জায়গা। ময়নাগড় রাজ পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে যোগাযোগ করে চলে আসুন ধর্মমঙ্গলের কাহিনী বিখ্যাত লাউসেনের রাজধানী ময়না গড়ে।
সৈকত শী
নিউজ১৮ বাংলায় সবার আগে পড়ুন ব্রেকিং নিউজ। থাকছে দৈনিক টাটকা খবর, খবরের লাইভ আপডেট। সবচেয়ে ভরসাযোগ্য বাংলা খবর পড়ুন নিউজ১৮ বাংলার ওয়েবসাইটে।
Tags: Maynagarh, Moyna Rajbari, Puja 2021