কলকাতার পয়লা: নবগোপালের হাত ধরে প্রথম মেলা বসল তিলোত্তমায়

Last Updated:

হুজুগে বাঙালির কাছে মেলার মতন এমন একটা জিনিস আর দ্বিতীয় আছে নাকি? শীতকালের অপেক্ষায় হা-পিত্যেশ বাঙালি দিন গুণতে থাকে।

#কলকাতা: হুজুগে বাঙালির কাছে মেলার মতন এমন একটা জিনিস আর দ্বিতীয় আছে নাকি? শীতকালের অপেক্ষায় হা-পিত্যেশ বাঙালি দিন গুণতে থাকে। নতুন নতুন সোয়েটার-জ্যাকেটের লোভ আছে, নলেন গুড়ের সন্দেশও আছে বহাল তবিয়তে, পিকনিক আর চিড়িয়াখানা তো থাকবেই— তবু হাজার হলেও মেলার ইউএসপিটা কিন্তু এক্কেবারে আলাদা। ওটার মধ্যে যে একটা ‘ইয়ে’ আছে সেটা আর কিছুর মধ্যে নেই। হাত ধরাধরি প্রেমটা আছে, ধুলো আর রসে মাখামাখি জিলিপিটা আছে, বুদবুদ ফেনা আর মাথার ক্লিপটা আছে, ফ্যাশন দুরস্থ মেলায় এক্সক্লুসিভ বুটিক কালেকশনটা আছে। আরও যে কত কিছু আছে, সে কী এক লেখায় শেষ হয় কখনও? কিন্তু আর যাই থাকুক, সেই মেলার ধুলোটা, বালিটা, ফুচকাটা, নাগোরদোলাটার সঙ্গে পাক খেতে অন্তত কোথাও নবগোপাল মিত্রের নামটি নেই। কিন্তু এই মানুষটা না থাকলে কোথায় বাঙালির মেলা, কোথায় এত আদিখ্যেতা? কলকাতার বুকে পয়লা মেলাটি শুরু করলেন তিনিই।
লোকে তাঁকে বলত ‘ন্যাশনাল নবকৃষ্ণ’। ওই ইংরেজি শব্দটি এমন সার্ব্বজনীনভাবে শহরের বুকে আমদানি করেছিলেন তিনিই। তার পিছনে অবশ্য কারণ একটি ছিল। কারণ হল, মনে প্রাণে জাতীয়তাবাদী ছিলেন এই নবগোপাল। স্বদেশপ্রেম, জাত্যাভিমান কাকে বলে তা বোঝাতে নবগোপালের উদাহরণ টানতেন লোকে। মনে-প্রাণে শুধু একটাই ইচ্ছে, গোটা জাতিকে এক করতে হবে। যেমন ইচ্ছে সে যুগে ছিল গণেন্দ্রনাথের মধ্যে। মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথের ভাই গিরীন্দ্রনাথের বড় ছেলে। গান গাওয়া, ছবি আঁকা, নাটক করার পাশাপাশি ওই এক সাধ— সকলকে বাঁধতে হবে এক সুতোয়। রবি ঠাকুর তাঁর জীবনস্মৃতিতে তাঁর গণদাদা সম্বন্ধে লিখেছেন, ‘‘সকল বিষয়েই তাঁর মনে একটি সর্বাঙ্গ সম্পূর্ণ জাতীয়তার আদর্শ জাগিয়া উঠিতেছিল।’’ গুণের মানুষ গণেন্দ্রনাথ জনগণের মানুষ হতে চেয়েছিলেন। কিন্তু বিধাতা তাঁকে মাত্র ২৮ বছর রেখেছিলেন এই পৃথিবীতে।
advertisement
সে যাক, গণেন্দ্রের কথা। ফিরে আসি মেলার জনকের কাছে। অস্থি-মজ্জায় একজন খাঁটি বাঙালি ছিলেন নবগোপাল। বাঙালি ছেলেদের স্বাস্থ্যচর্চা করতে হবে। খুলে ফেললেন আখড়া। তাঁকে বলা হত ‘ফাদার অব ফিসিক্যাল এডুকেশন’। এতেই থেমে থাকার লোক নন তিনি। জাতীয় রঙ্গালয় চাই, জাতীয় সংবাদপত্র চাই, চাই জাতীয় মেলাও, এমনকী জাতীয় সার্কাসও। তাঁর প্রবল ইচ্ছে, সকল জাতিকে একত্র করতে কলকাতার বুকে একটা মেলা শুরু করতে হবে। যেমন বলা তেমন কাজ। শুরু হল তোড়তোড়।
advertisement
advertisement
১৮৬৭। এপ্রিলের ১২ তারিখ বেলগাছিয়ার ডনকিন সাহেবের বাগানবাড়িতে প্রথম শুরু হল হিন্দু মেলা। অবনীন্দ্রনাথ তাঁর ‘ঘরোয়া’য় এই নবগোপাল মিত্রের মেলা নিয়ে অসাধারণ লিখে গিয়েছেন। ‘‘এইবারে হিন্দু মেলার গল্প বলি শোনা। একটা ন্যাশনাল স্পিরিট কী করে য়েন তখন জেগেছিল জানিনে, কিন্তু চারিদিকেই ন্যাশনাল ভাবের ঢেউ উঠেছিল। নবগোপাল মিত্তিরকে সবাই বলতেন ন্যাশনাল নবগোপাল। তিনিই প্রথম ‘নাযাশনাল’ শব্দ শুরু করেন। তিনিই চাঁদা তুলে ‘হিন্দু মেলা’ শুরু করলেন। জ্যাঠামশায় গান বাঁধলেন—
advertisement
‘‘মিলে সব ভারত সন্তান
একতান মনপ্রাণ
গাও ভারতের জয় গান।’’
এই হল তখনকার জাতীয় সঙ্গীত। ফি বছর বসন্ত কালে মেলা হত। যাবতীয় দেশি জিনিস তাতে থাকত। শেষ যে বার আমরা দেখতে গিয়েছিলুম, এখনও স্পষ্ট মনে পড়ে— বাগানময় মাটির মূর্তি সাজিয়ে রাখত। কোনোটাতে দশরথের মৃত্যু, কৌশন্যা বসে কাঁদছেন, এই রকম পৌরাণিক নানা গল্প মাটির পুতুল দিয়ে গড়ে বাগানময় সাজানো হত। কী সুন্দর তাদের সাজাত, মনে হত যেন জীবন্ত।’’
advertisement
আজকের মেলার চালচিত্র ৷ আজকের মেলার চালচিত্র ৷
১৮৭২-এ তৈরি হল ন্যাশনাল থিয়েটার। তারপরেই নবগোপাল নিয়ে এলেন ন্যাশনাল সার্কাস। জ্যোতিরিন্দ্রনাথ এই সার্কাস নিয়ে মজা করে লিখেছেন, ‘‘কতকগুলো মড়াখেগো ঘোড়া লইয়া নবগোপালবাবুই সর্বপ্রথম বাঙালি সার্কাসের সূত্রপাত করেন। আজ যে বোসের সার্কাসের কৃতিত্ব এবং নানা প্রশংসাবাণী শোনা যায়, উহা তাহারই পরিণতি এবং নবগোপালবাবুর অনুষ্ঠিত সেই প্রথম বাঙালি সার্কাসেরই চরম ক্রমোন্নতি বলিতে হইবে।’’
advertisement
সত্যেন্দ্রনাথের ‘আমার বাল্যকথা’তে নবগোপালের জাত্যাভিমানের একটি উল্লেখ পাই। সেখানে একটি ঘটনার কথা লিখে গিয়েছেন সত্যেন্দ্রনাথ। তিনি থাকতেন মুম্বইয়ে। মাঝেমধ্যে কলকাতা এলে সভায় বক্তৃতা দেওয়ার ডাক পড়ত তাঁর। তিনি প্রথম ভারতীয় সিভিলিয়ান বলে কথা, তাও আবার বাঙালি। একবার এক সভায় বাঙালি-অবাঙালি খাবার নিয়ে কথা হচ্ছে। সত্যেন্দ্রনাথ বললেন, বাঙালির স্বাভাবের দুর্বলতা তার মূলে অনেকখানিই রয়েছে ভাতের হাত। ‘‘এই কথা শুনে নবগোপালবাবু মহা চোটে উঠলেন। চিৎকার করে বললেন, ‘তা কখনই হতে পারে না। তোমরা যাই বলো, আমরা একবার ভাত খাব, দু’বার ভাত খাব, তিনবার ভাত খাব।’ নবগোপালের এই গর্জনের পর সভার সব গুঞ্জন চুপ।’’
advertisement
সেটাও ছিল এক এপ্রিল মাস। চৈত্র সংক্রান্তির দিন হিন্দু মেলা বসল। মেলার প্রথমদিনে যে আনুষ্ঠানিক কমিটি গঠন হল তার প্রথম সচিব হলেন গণেন্দ্রনাথ ঠাকুর আর মেলার মূল আয়োজক ও সহকারী সচিব হলেন নবগোপাল মিত্র। এ ছাড়াও রাজা কমল কৃষ্ণ বাহাদুর, গিরিশচন্দ্র ঘোষ, রামানাথ ঠাকুর, পেয়ারীচরণ সরকার, রাজনারায়ণ বসু, দ্বিজেন্দ্রনাথ ঠাকুর, কৃষ্টদাস পাল, সকলেই মেলার উৎসাহক হিসেবে যুক্ত রইলেন।
মেলার বার্ষিক অনুষ্ঠান ছিল এক মারকাটারি ব্যপার। উদ্বোধনও হত জমিয়ে। প্রথম বছর তেমন না জমলেও মেলা গমগম করে উঠল দ্বিতীয় বছর থেকেই। বেলগাছিয়ায় আশুতোষ দেবের বাগান বাড়িতে বসল সেই মেলা। মেলায় সভাপতি গণেন্দ্রনাথ নিজের ভাষণে বললেন, ‘এই মেলার প্রধান উদ্দেশ্য বছরের শেষে হিন্দু জাতিকে একত্রিত করা, এইরূপ একত্র হওয়ার ফল যদ্যাপি আপাতত কিছুই দৃষ্টিগোচর হইতেছে না, কিন্তু আমাদের পরস্পরের মিলন এবং একত্র হওয়া যে কত আবশ্যক ও তাহা যে আমাদের পক্ষে কত উপকারী তাহা বোধহয় কাহারও অগোচর নাই।’’
উদ্বোধন উপলক্ষ্যে নানা অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হত। দেশাত্মবোধক গান, কবিতা, বাঙালি-পাঞ্জবি ছেলেদের কুস্তি, প্রদর্শনী আরও হরেক স্বাদের অনুষ্ঠান। এই বার্ষিক অনুষ্ঠানেই দ্বিজেন্দ্রনাথের দেশাত্মবোধক সংগীত ‘মলিন মুখচন্দ্র মা ভারত তোমারি’ দিয়ে উদ্বোধন করা হয়। জ্ঞানেন্দ্রনাথ ঠাকুরের সভাপতিত্বে বেলগাছিয়ায় অনুষ্ঠিত দ্বিতীয় বার্ষিক মেলায় (১৮৬৮) সত্যেন্দ্রনাথ ঠাকুরের দেশাত্মবোধক সংগীত ‘গাও ভারতের জয়’ গাওয়া হয়। এরপরের সব মেলা এই সঙ্গীত দিয়ে উদ্বোধন করা হত। এটি এত জনপ্রিয়তা অর্জন করে যে, সদ্যোজাত জাতীয়তাবাদীদের জাতীয় সঙ্গীতে পরিণত হয়। পরে বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের ‘বন্দে মাতরম’ এর স্থান অধিকার করে।
আরও প্রায় ছ’বছর ধরে বিরাট আড়ম্বর ও জাঁকজমকপূর্ণভাবে মেলার বার্ষিক সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়েছিল। এর কার্যবিবরণী তখন প্রায় সব সংবাদপত্র আর সাময়িকীতে বিশদভাবে প্রকাশিত হত। শেষ পর্যন্ত সাফল্যের উচ্চ শিখরে পৌঁছয় ১৮৭৫ সালের বার্ষিক সমাবেশে। রাজনারায়ণ বসু এতে সভাপতিত্ব করেন। এ সমাবেশেই ১৪ বছরের রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তাঁর স্বরচিত কবিতা ‘হিন্দু মেলার উপহার’ আবৃত্তি করলেন। কবিতাটি অমৃত বাজার পত্রিকায় ১৮৭৫ সালের ২৫ ফেব্রুয়ারি প্রকাশিত হল। বলা বাহ‌ুল্য প্রশংসিতও হয়েছিল।
এরপর থেকে কিন্তু হিন্দু মেলার জৌলুস কমতে লাগল। এর প্রধান কারণ ছিল ধর্মনিরপেক্ষ জাতীয়তাবাদের পাশাপাশি চলার অক্ষমতা। ফলে মধ্যবিত্ত নতুন প্রজন্মের থেকে দুরত্ব বাড়তে লাগল মেলার। সাম্প্রদায়িকতা ছাড়াও হিন্দু মেলার আরেকটি বিরাট দুর্বলতা ছিল - এর সংগঠকদের রাজনৈতিক কর্মকান্ডের সাথে সম্পৃক্ত না হওয়ার দৃঢ় সঙ্কল্প। সে সময় অধিকাংশ শিক্ষিত বাঙালি রাজনৈতিক বিষয়ে যুক্ত হয়ে পড়ছিলেন। তাঁরা মনে করতেন রাজনীতি ছাড়া দেশাত্মবোধ অসম্ভব। ফলে উনিশ শতকের আশি ও নববইয়ের দশকের নতুন ও জটিল প্রয়োজনের সঙ্গে খাপ খাওয়াতে না পেরে উনিশ শতকের নববইয়ের দশকে হিন্দু মেলা ক্রমশ ম্লান হয়ে বিলুপ্ত হয়ে যায়। কিন্তু এই সংগঠন যে স্বদেশী চেতনা জাগিয়ে তুলতে সক্ষম হয়েছিল তাতে কোন সন্দেহ নেই। বিশ শতকের প্রথমদিকে স্বদেশী আন্দোলনের অবয়বে এই চেতনারই প্রকাশ ঘটেছিল।
view comments
বাংলা খবর/ খবর/লাইফস্টাইল/
কলকাতার পয়লা: নবগোপালের হাত ধরে প্রথম মেলা বসল তিলোত্তমায়
Next Article
advertisement
Rhino rescue: বিপর্যয়ের সময় ভেসে গিয়েছিল তারা, অবশেষে ঘরে ফিরল ১০ গন্ডার! সফল 'অপারেশন রাইনো'
বিপর্যয়ের সময় ভেসে গিয়েছিল তারা, অবশেষে ঘরে ফিরল ১০ গন্ডার! সফল 'অপারেশন রাইনো'
  • ১৩ দিনের অপারেশন রাইনোতে ১০টি গন্ডার উদ্ধার করেছেন বনকর্মীরা

  • বিপর্যয়ের সময় জলদাপাড়া থেকে ভেসে গিয়েছিল বেশ কয়েকটি গন্ডার

  • অক্লান্ত পরিশ্রমের পর বনকর্মীরা গন্ডারগুলোকে জঙ্গলে ফেরাতে সক্ষম হন

VIEW MORE
advertisement
advertisement