#কলকাতা: ঘরে ফেরার আনন্দের মাঝেও পরিযায়ী শ্রমিকদের দুশ্চিন্তা গ্রাস করছে প্রতিমুহূর্তে। কীভাবে চলবে আগামী দিন? প্রশ্ন থাকলেও উত্তর এখনও অজানা সবার কাছেই। সকাল দশটা বেজে চল্লিশ মিনিট। ডানকুনি রেল স্টেশনের চার নম্বর প্লাটফর্মে পৌঁছল এ রাজ্যের প্রথম বিশেষ ট্রেন। গতকাল সকাল এগারোটা নাগাদ রাজস্থানের আজমের থেকে পরিযায়ী শ্রমিকদের পাশাপাশি ওখানে আটকে পড়া তীর্থযাত্রী থেকে শুরু করে পর্যটক মিলিয়ে ১০৮৬ জন পশ্চিমবঙ্গের বাসিন্দাকে নিয়ে রওনা দেয় বিশেষ ট্রেন । মঙ্গলবার রাজ্য সরকারের উদ্যোগে রাজ্যে ফিরলেন সবাই।
সকাল থেকে হুগলির ডানকুনি রেল স্টেশন চত্বরে থিক থিক করছে রাজ্য আর রেল পুলিশে। স্টেশন চত্বরেই স্বাস্থ্য দফতরের তরফ থেকে ব্যবস্থা রাখা হয়েছিল বিশেষ মেডিকেল ক্যাম্পের। ট্রেন প্লাটফর্মে পৌঁছতেই শুরু হয় পুষ্পবৃষ্টি। ট্রেনের ভেতর থেকে তখন অনেক যাত্রীর মুখেই আনন্দের ছাপ স্পষ্ট। কার্যত যুদ্ধ জয় করে ঘরে ফেরার আনন্দ।
ট্রেন ডানকুনি স্টেশনে পৌঁছানোর অনেক আগেই যাত্রীদের অভ্যর্থনা জানাতে স্টেশনে পৌঁছে গিয়েছিলেন রাজ্যের দুই মন্ত্রী মলয় ঘটক এবং তপন দাশগুপ্ত। পুলিশ এবং প্রশাসনের শীর্ষ কর্তারাও হাজির ছিলেন। কিছুক্ষণের মধ্যে আসেন রাজ্যের আরও এক মন্ত্রী রাজীব বন্দ্যোপাধ্যায়। ২৪ কামরার ট্রেনটি প্লাটফর্মে দাঁড়ানো মাত্রই যাত্রীদের স্বাগত জানান উপস্থিত প্রশাসনের কর্তাব্যক্তিরা। সামাজিক দূরত্বের কথা মাথায় রাখা হয়, এবং ট্রেনের সমস্ত যাত্রী একসঙ্গে প্ল্যাটফর্মে নামলে সুরক্ষা বিধি লঙ্ঘিত হতে পারে, এই আশঙ্কাও ছিল। এই আশঙ্কা থেকে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়, একেকটি কামরার একটি করে দরজা খুলে নামানো হবে যাত্রীদের ৷ যাত্রীরা নেমে যাওয়ার পর তাঁরা যখন স্টেশনের বাইরে গিয়ে পৌঁছবেন তখন অন্য কামরার দরজা খুলে যাত্রীদের বের করা হবে। এভাবেই পরপর ট্রেনের কামরা থেকে নামান হয় ভিন রাজ্য থেকে আসা যাত্রীদের।
গোটা প্ল্যাটফর্ম চত্বর থেকে একেবারে স্টেশনের বাইরের অংশ পর্যন্ত দড়ির ব্যারিকেড দিয়ে মুড়ে ফেলা হয়। যাত্রীদের স্বাগত জানিয়ে লেখা হয় 'ওয়েলকাম বোর্ড'। ডানকুনি স্টেশনের ৩ এবং ৪ নম্বর প্ল্যাটফর্মের সিঁড়ি ভেঙে ওভারব্রিজ দিয়ে নিচে নেমেই ভিন রাজ্য থেকে আসা যাত্রীদের জন্য ব্যবস্থা রাখা হয়েছিল স্বাস্থ্য পরীক্ষার। স্যানিটাইজার দিয়ে হাত ধুইয়ে প্রত্যেক যাত্রীর হাতে মাস্ক তুলে দেওয়া হয়। এরপর এক এক করে সমস্ত যাত্রীকে 'থার্মাল গান' এর মাধ্যমে শরীরের তাপমাত্রা মাপার পাশাপাশি বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক এবং স্বাস্থ্যকর্মীরা তাঁদের কাছ থেকে প্রয়োজনীয় করোনা উপসর্গের তথ্য সংগ্রহ করেন। ভিন রাজ্য থেকে এদিন আসা সমস্ত যাত্রীর নাম ঠিকানা এবং অন্যান্য প্রয়োজনীয় তথ্য স্বাস্থ্য দফতরের কর্মীরা লিপিবদ্ধ করে রাখেন।
রাজ্য সরকারের তরফে মন্ত্রী মলয় ঘটক ও রাজীব বন্দ্যোপাধ্যায়ের কথায়, 'মুখ্যমন্ত্রীর উদ্যোগে লকডাউনের কারণে আটকে থাকা এরাজ্যের মানুষরা বাড়ি ফিরতে পারলেন। ওঁদের সকলের প্রয়োজনীয় স্বাস্থ্য পরীক্ষা করার পর সরকারি বাসে করে নিখরচায় সবাইকেই নিজের নিজের বাড়ি পৌঁছে দেওয়া হবে'। স্বাস্থ্য পরীক্ষা করার পর কলকাতা ও সংলগ্ন এলাকা ছাড়াও রাজ্যের বিভিন্ন প্রান্তের জন্য পরিবহণ দফতরের কর্তাদের তত্ত্বাবধানে একের পর এক বাস নির্দিষ্ট গন্তব্যের উদ্দেশ্যে রওনা দেয়। কোনও বাস রওনা দিল মুর্শিদাবাদের উদ্দেশ্যে। আবার কোনও বাস রওনা দিল বীরভূম, নদিয়া, বর্ধমান কিম্বা অন্য কোনও জেলার উদ্দেশ্যে। সূত্রের খবর , ট্রেনটি এদিন ডানকুনি স্টেশন পৌঁছতেই নিজের ঘনিষ্ঠমহলে ফোন করে যাত্রীদের ব্যাপারে খোঁজখবর নেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়।
লকডাউনে বন্দিদশা কাটিয়ে অবশেষে ঘরে ফেরায় খুশি পরিযায়ী শ্রমিক থেকে শুরু করে তীর্থযাত্রী কিম্বা পর্যটকেরা। প্রত্যেকেই রাজ্য সরকার এবং মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের উদ্যোগের প্রশংসা করেন। দীর্ঘদিন যাবৎ কার্যত ঘরবন্দি হয়ে থাকা অনেক শিশুকেও দেখা গেল খোশমেজাজে। বাড়ি ফেরার আনন্দ ওদেরও মুখের হাসি চওড়া করেছে। জিয়াউল আলম, প্রমদ সাউ, নাসিমা খাতুনের মত অনেকেই বললেন, এই অবস্থায় যে বাড়ি ফিরতে পারবন তা কখনও ভাবিনি। গত এক মাসেরও বেশি সময় ধরে এমন অনেক দিন গিয়েছে কোনও খাবার পাইনি। ছোট ছোট শিশুরাও কার্যত অভুক্ত থেকে গিয়েছে'।
বাড়ি ফেরার আনন্দে প্রত্যেকেরই চোখে-মুখে আনন্দের ছাপ স্পষ্ট। আতঙ্কের দিনযাপনের কাহিনি শোনানোর পর একগাল হেসে কেউ কেউ বললেন, মনে হল যুদ্ধক্ষেত্র থেকে ফিরলাম। কিন্তু আবার কেউ কেউ আগামী দিনে আরও কঠিন লড়াইয়ের সম্মুখীন হওয়ার দুশ্চিন্তায় মগ্ন। পেটের জ্বালা মেটাতে পরিবার-পরিজন ছেড়ে রাজস্থানে শ্রমিকের কাজ করতে গিয়েছিলেন সিদ্দিকুল্লাহ। লকডাউনে রোজগার বন্ধ। হাতে কাজ নেই। পেটে ভাত নেই। দিনের পর দিন দুশ্চিন্তাকে সঙ্গী করেই দিন গুজরান করেছেন সিদ্দিকুল্লাহর মতো আরও অনেক এরাজ্যের পরিযায়ী শ্রমিকরা। সংসার চলবে কী করে ? প্রশ্নের উত্তরে কিছুক্ষণ থমকে যান আসানসোলের জনৈক এক শ্রমিক। পরে বললেন, কবে সবকিছু ঠিক হবে জানিনা। ভয় তো লাগছেই। তবে পেট তো আর ভয়কে ভয় পাবে না। রোজগার বন্ধ থাকলে খাবো কী'। ঘরে ফেরার আনন্দের মাঝেও অনেকের কাছেই এদিনের ঘরে ফেরা তাই এক অনিশ্চিত ভবিষ্যতের সামনে দাঁড় করানোর সমান। কেননা, লকডাউন কিংবা করোনাকে যে ভয় করেনা পেট !
নিউজ১৮ বাংলায় সবার আগে পড়ুন ব্রেকিং নিউজ। থাকছে দৈনিক টাটকা খবর, খবরের লাইভ আপডেট। সবচেয়ে ভরসাযোগ্য বাংলা খবর পড়ুন নিউজ১৮ বাংলার ওয়েবসাইটে।