‘ওঁরা একটু মানবিক হলে হয়তো ফিরিয়ে আনতে পারতাম আমাদের পেম্বাকে’’

Last Updated:

যাচ্ছে না, কিছুতেই যাচ্ছে না নাছোড়বান্দা কষ্টটা ৷ শৃঙ্গ জয়ের একরাশ দুমড়ে ওটা যন্ত্রণাকে সঙ্গী করে ফিরে এসেছে সবাই ৷ চোখে মৃত্যুর নিঃস্তব্ধতা, অপূরণীয় গ্লানি, প্রিয় অতি প্রিয় মানুষকে ছেড়ে আসার ব্যথা, যন্ত্রণার একা গোটা ্ধ্যায়কে যেন বয়ে বেড়াচ্ছেন সকলে ৷

#কলকাতা: যাচ্ছে না, কিছুতেই যাচ্ছে না নাছোড়বান্দা কষ্টটা ৷ শৃঙ্গ জয়ের একরাশ দুমড়ে ওটা যন্ত্রণাকে সঙ্গী করে ফিরে এসেছে সবাই ৷ চোখে মৃত্যুর নিঃস্তব্ধতা, অপূরণীয় গ্লানি, প্রিয় অতি প্রিয় মানুষকে ছেড়ে আসার ব্যথা, যন্ত্রণার একটা গোটা অধ্যায়কে যেন বয়ে বেড়াচ্ছেন সকলে ৷
সাসের কাংরি শৃঙ্গ জয় করে ফিরে এসেছেন মাউন্টেনিয়ারিং অ্যাসোসিয়েশন অব কৃষ্ণনগর (ম্যাক)-এর সদস্যরা ৷ কিন্তু জয়ের ছিটে ফোঁটা আনন্দও নেই কোথাও ৷ কারও মুখে টুঁ শব্দটি নেই ৷ এই চরম পরাজয়ের গ্লানি কোথায় লুকাবেন তাঁরা ? শুধু এই চিন্তাই কুঁড়ে কুঁড়ে খাচ্ছে সবাইকে ৷
গত ১৩ জুলাই কারাকোরাম পর্বতের সাসের কামরি অভিযানে গিয়ে নিখোঁজ হয়ে গিয়েছেন পেম্বা শেরপা ৷ বরফের ক্রিভাসের তলায় অজানা কোনও এক দেশে হারিয়ে গিয়েছেন সেই মানুষটা, যাঁকে ছাড়া কোনও দিন সাবলকত্বের তকমা পেত না বাংলার পর্বতারোহন ৷ এই পেম্বা শুধুমাত্র শেরপা নন, শুধুমাত্র অভিযাত্রীদের সাহায্য করতে অর্থের বিনিময়ে শ্রম দান করা একজন মানুষ নন, এই পেম্বা ক্লাবটার প্রাণ, সদস্যদের পাঁজরের একটা আস্ত হাড় যেন ৷ ম্যাক-কে প্রতিষ্ঠিত করার কারিগর, স্বপ্ন দেখানোর ফেরেস্তা, ভয়ঙ্করতম বিপদের মুখ থেকে ফিরিয়ে নিয়ে আসা জীবনদাতা ৷ ৮ বারের এভারেস্টজয়ী, কাঞ্চনজঙ্ঘা, অন্নপূর্ণাজয়ী পেম্বার এমন পরিণতি.... যেন কল্পনা করতে পারছেন না কেউ ৷
advertisement
advertisement
ভোলা যাবে না সেই অনাবিল হাসি ৷ ভোলা যাবে না সেই অনাবিল হাসি ৷
কিন্তু হয়তো তাঁকে বাঁচানো যেত ৷ হয়তো বা... ৷ সম্ভাবনাটা তো অন্তত থাকত ! কিন্তু বিতর্কের কালো মেঘটা সমস্ত ‘যদি, কিন্তু, হয়তো, তবু’-কে ঢেকে দিল ৷ গত ১৯ জুলাই কলকাতা পৌঁছেছে সাসের কাংরি দল ৷ অচেনা দেশে পেম্বাকে রেখেই ফিরে এসেছেন ম্যাকের বসন্ত সিংহ রায়, বিশ্বনাথ সাহা, প্রশান্ত সিংহ, রুম্পা দাস, সিদ্ধার্থ শঙ্কর সরকাররা ৷ সঙ্গে ফিরেছেন পেম্বার নিজের দাদা পাসাং শেরপা আর ভাগ্নে পাসাং ছিরিং শেরপা ও লাকপা শেরপা ৷ এ বছর পুণের একটি দলও ম্যাকের সঙ্গে গিয়েছিল এই অভিযানে ৷
advertisement
১২ জুলাই সাসের কাংরি সামিট করেছিলেন ম্যাকের বিশ্বনাথ আর পুণের অনিল ৷ সঙ্গে ছিলেন পেম্বা, পাসাং, ছিরিং ও লাকপা ৷ তবে এই প্রথমবার শেরপা হিসাবে নয়, ম্যাকের সদস্য হিসাবেই এই অভিযানে অংশ নিয়েছিলেন পেম্বা ৷ সম্প্রতি ম্যাকের সদস্যপদ গ্রহণ করেছিলেন তিনি ৷ ১৩ জুলাই সামিট করে ফিরে আসছিলেন সকলে ৷ ক্যাম্প ১-এ পোঁছানোর একটু আগেই ঘটে দুর্ঘটনা ৷ দলের সদস্য প্রশান্তবাবু জানালেন, ‘‘আর মেরেকেটে বাকি ৪০০-৫০০ মিটার বরফের পথ বাকি ছিল ৷ ওই রাস্তা দিয়ে মালপত্র ফেরি করার সময় অন্তত বার দশেক যাতায়াত করেছি আমরা ৷ যে কারও সঙ্গেই এমনটা হতে পারত ৷ কিন্তু পেম্বাজির লসটা আর কখনও পূরণ করা যাবে না ৷’’
advertisement
pemba8
পেম্বা যখন ক্রিভাসে পড়ে যান তখন ঠিক তাঁর পিছনেই ছিলেন ছিরিং ৷ মাত্র কয়েক হাতের দূরত্বে ঘটে যায় দুর্ঘটনা ৷ কিন্তু বিষয়টা এতটাই আকস্মিক ছিল যে ঘটনাটা বুঝে উঠতেই কয়েক সেকেন্ড কেটে যায় ৷ সঙ্গে সঙ্গেই নিজেদের চেষ্টায় উদ্ধারকাজ শুরু করেন অন্য শেরপারা ৷ কিন্তু সরঞ্জাম ছাড়া ফাঁকা হাতে ক্রিভাসের ভিতর বেশিদূর নামা সম্ভব হয়নি ৷ গত শুক্রবার দলের অন্যতম বর্ষীযান ও অভিজ্ঞ পর্বতারোহী বসন্ত সিংহ রায় সাংবাদিক সম্মেলনে বলেন, ‘‘ক্রিভাসটির চরিত্র ছিল আঁকাবাঁকা ৷ যা ভয়ঙ্কর বিপজ্জনক ৷ তার উপর টর্চ, রোপ, হ্যামার, আইস অ্যাক্স, জুমার-সহ যাবতীয় সরঞ্জাম সঙ্গে নিয়ে নীচে পড়ে গিয়েছিল পেম্বা ৷ আবহাওয়া অত্যন্ত ভাল থাকায় রোদে প্রতি মুহূর্তে গলে যাচ্ছিল গ্লেসিয়ার্স ৷ ফাটল ধরছিল বরফের চাদরে ৷ সম্ভবত দলের বাকি মেম্বারদের সুরক্ষিত রাখতে গিয়ে রাস্তা পরীক্ষা করছিল সে ৷ পেম্বা নিজেও বুঝতে পারেনি পরের পদক্ষেপটা যেখানে রাখতে চলেছে সেটা আসলে একটা হিডেন ক্রভাস (লুকানো বরফের ফাটল) ৷ ফলে পা দিতেই দেহ আর সরঞ্জামের বিপুল চাপে হুড়মুড়িয়ে অতল গভীরে তলিয়ে যায় সে ৷’’
advertisement
কিন্তু কষ্টটা অন্য জায়গায় ৷ তবু কি আর একটু তৎপরতা, উদ্যোগ, প্রচেষ্টা আশা করতে পারে না দেশের এই বীর সন্তান ? যাঁর হাত ধরে নিজের পায়ের তলার মাটিটা শক্ত করেছে বাঙালির পর্বতারোহন, যাঁর হাত ধরে নাম তৈরি করেছে এই বসন্ত সিংহ রায়, দেবাশীষ বিশ্বাসরা, তার কি এটাই প্রাপ্য ছিল ? অনুশোচনা বারবার ঝরে পড়ল বসন্তবাবুর গলায় ৷
advertisement
এভারেস্টের মাথায় বসন্ত, দেবাশীষ, পেম্বা আর পাসাং ৷ এভারেস্টের মাথায় বসন্ত, দেবাশীষ, পেম্বা আর পাসাং ৷
রোপ, সরঞ্জাম ছাড়াই নিজেদের উদ্যোগে পেম্বাকে খুঁজতে কালো অন্ধকার ক্রিভাসে নেমে গিয়েছিলেন দলের সদস্যরা ৷ তাতে ব্যর্থ হয়ে নীচে ক্যাম্পে নেমে এসে আবার সমস্ত সরঞ্জাম নিয়ে চলেছিল উদ্ধারের চেষ্টা ৷ কিন্তু আর একটু মানবিকতা হয়তো বাঁচিয়ে দিতে পারত পেম্বাকে ৷ পাশেই ছিল আইটিবিপি (ইন্দো টিবেটিয়ান বর্ডার পুলিশ)-র একটি দল ৷ প্লাটো নামে একটি শৃঙ্গ অভিযানে এসেছিলেন তাঁরা ৷ ওই দলে ছিলেন ৪-৫ জন বাঘা বাঘা শেরপা ৷ ওঁরা সকলেই নেপালের মাকালু অঞ্চলের। পেম্বারাও জন্মসূত্রে মাকালুরই বাসিন্দা ৷ ওই শেরপাদের কেউ নাঙ্গা পর্বত আরোহণ করেছেন, তো কেউ কে-টু। ওঁরা সকলেই সদ্য এসে পৌঁছেছিলেন। ফলে ওঁদের শারীরিক সক্ষমতা ও দক্ষতা অনেক গুণ বেশি ছিল, পাসাংদের থেকে। উদ্ধারকাজে সাহায্য করার জন্য একটা সময় হাতে-পায়ে ধরা হয়েছিল তাঁদের ৷ কিন্তু উপর মহল থেকে অর্ডার আসেনি, এই ‘যুক্তি’ দেখিয়ে আড়াই দিন কার্যত হাত গুটি বসে থাকল অত্যাধুনিক রেসকিউ সরঞ্জামে সজ্জিত আইটিবিপি ৷
advertisement
এভারেস্টের খুম্বু গ্লেসিয়ার্সে ক্লাইম্ব করছেন পেম্বা ৷ এভারেস্টের খুম্বু গ্লেসিয়ার্সে ক্লাইম্ব করছেন পেম্বা ৷
শেষ পর্যন্ত ১৫ জুলাই সকাল সাড়ে ১০টা নাগাদ আইটিবিপি-র তরফে জানানো হয় অর্ডার পেয়েছে তাঁরা ৷ তার মধ্যে দু’বার পুরদমে উদ্ধারের চেষ্টা চালিয়ে ব্যর্থ হয়ে ভেঙে টুকরো টুকরো হয়ে যাওয়া হৃদয়টা নিয়ে ফিরে আসছেন ম্যাকের সদস্য ও শেরপারা ৷ ফিরতিপথে পাসাং-লুকমাদের মুখে সেই কথা শুনে আর উদ্ধারকাজে হাত লাগানোর প্রয়োয়নই বোধ করেনি আইটিবিপি ৷
পেম্বার নামের পাশে আজ একাধিক অতীত কালের ব্যবহার ৷ সাংবাদিক সম্মেলনের শেষে কেঁদেই ফেললেন বসন্তবাবু ৷ বলেন, ‘‘আমরা পেম্বাকে হারালাম ৷ যা গেল তা আমাদেরই গেল ৷ তবু ওঁর পরিবারের পাশে দাঁড়ানোর চেষ্টা করে যাব ৷ আমাদের সামর্থ্য কম ৷  নিজেদের তরফ থেকে এককালীন ১০ লক্ষ টাকা ক্ষতিপূরণ দেওয়ার কথা ভাবছি ৷ যদিও এই ক্ষতির পূরণ হয় না ৷ উপর মহলের নির্দেশের শ্রদ্ধা করি আমরাও ৷ তবু কি মানবিকতা শব্দটা থাকবে না অভিধানে ?’’
এই অভিযানের একমাত্র মহিলা সদস্য রুম্পা কেঁদে উঠলেন ডুকরে ৷ বললেন, ‘‘সামিটে বেরনোর আগে একটা ছবি তুলতে চেয়েছিলাম একসঙ্গে ৷ বলেছিল, খিচ লো, কৌন জানে ফির কভি মওকা মিলে না মিলে ৷’’
দেশ তোমার জন্য গর্বিত ৷ দেশ তোমার জন্য গর্বিত ৷
(ছবি: পেম্বা শেরপার ফেসবুক প্রোফাইলের সৌজন্যে )
বাংলা খবর/ খবর/কলকাতা/
‘ওঁরা একটু মানবিক হলে হয়তো ফিরিয়ে আনতে পারতাম আমাদের পেম্বাকে’’
Next Article
advertisement
পথ দুর্ঘটনায় মৃত্যু হয় ক্লাব এর সদস্যর এক আত্মীয়র! তারপরেই, এই এলাকার পুজোর থিম দেখলে অবাক হবেন!
পথ দুর্ঘটনায় মৃত্যু হয় ক্লাব এর সদস্যর এক আত্মীয়র! অন্যরকম থিম এই এলাকায়
VIEW MORE
advertisement
advertisement