‘পেম্বা ভুল করেনি, ওঁর ভুল হতেই পারে না’
Last Updated:
আমি বিশ্বাস করি না ৷ পেম্বা কোনও ভুল করতেই পারে না ৷ সবার নিরাপত্তা নিয়ে যে মানুষটা সবচেয়ে বেশি ভাবত, সে ভুল করেনি ৷ এটা দুর্ঘটনা ৷ শুধুই দুর্ঘটনা ৷
পেম্বা শুধু একটা নাম নয় ৷ একটা অধ্যায় ৷ বাঙালির শখের পর্বতারোহনকে হাত ধরে জাতীয়স্তরে নিয়ে গিয়েছিল পেম্বা-ই ৷ আটবারের এভারেস্টজয়ী সেই পেম্বাই আজ নাম না জানা অতল গিরিখাতের তলায় অজানা এক তুষারশুভ্র রাজ্যে চুপটি করে রয়েছে ৷ কারাকোরাম পর্বতের সাসের কাংরি অভিযানে গিয়ে নিখোঁজ পেম্বা শেরপা ৷ তাঁকে ঘিরে হাজারো স্মৃতি, ভালবাসা, আর দলা পাকানো কষ্টের রোমন্থন করলেন বিশিষ্ট পর্বতারোহী দেবাশিস বিশ্বাস ৷
আমি বিশ্বাস করি না ৷ পেম্বা কোনও ভুল করতেই পারে না ৷ সবার নিরাপত্তা নিয়ে যে মানুষটা সবচেয়ে বেশি ভাবত, সে ভুল করেনি ৷ এটা দুর্ঘটনা ৷ শুধুই দুর্ঘটনা ৷
এই ক’টাদিন শুধুই পেম্বা, আর পেম্বাময় ৷ ওঁর কথা বলেই চলেছি, লিখছি পাতার পর পাতা ৷ তবু সেই মানুষটাই নেই ! যাঁর নামে এত কথা, যে মানুষটার জন্য আজ আমার দেবাশিস বিশ্বাস হয়ে ওঠা, সে কোথায় ?
advertisement
advertisement
পেম্বার কথা কোথা থেকে শুরু করব বুঝতে পারছি না ৷ ওঁর কথা বলে শেষ করা যায় না ৷ আমাকে এখনও বাঁচিয়ে রেখেছে এই পেম্বা শেরপা ৷ আমাকে ক্লাইম্বার করে তুলেছে পেম্বা শেরপা ৷ মৃত্যুর মুখ থেকে একাধিকবার ফিরিয়ে এনেছে এই পেম্বা শেরপা ৷ কী করে বিশ্বাস করব মৃত্যুর অতল মুখের সামনে এখন দাঁড়িয়ে রয়েছে আমার সেই জীবনদাতা ?
advertisement
ওঁর সম্বন্ধে বলতে শুরু করলে শেষ হবে না ৷ প্রায় দু’দশকের সম্পর্ক আমাদের ৷ মাউন্টেনিয়ারিং অ্যাসোসিয়েশন অফ কৃষ্ণনগর (ম্যাক)-এর থেকে ২০০৫-এ যখন শিবলিঙ্গ অভিযান হল তখন থেকে পেম্বা-পাসাং জুটি আমাদের সঙ্গী ৷ যদিও তার আগে থেকেই ওরা আমাদের সঙ্গে ছিল ৷ কিন্তু শিবলিঙ্গ সামিট করা বাংলার পর্বতারোহনের ইতিহাসে একটা মাইলফলক ৷ এরপর থালয়সাগর, ইন্দ্রসন, শিবা, পানওয়ালিদুয়ার একেরপর এক সবই হয়েছে ৷ সবেতেই সঙ্গী পেম্বা, আর ওর বড় দাদা পাসাং ৷
advertisement
মাউন্টেনিয়ারিং-এ কিন্তু আগে এসেছিল পাসাংই ৷ দাদার হাত ধরেই ব্যাটন হাতে তুলে নেয় পেম্বা ৷ পরে পেম্বা নিজের দক্ষতায় অনেকটাই এগিয়ে গিয়েছিল পাসাংয়ের থেকে । যখন আমরা আট হাজার মিটার ক্লাইম্বিং শুরু করলাম তখন তো পেম্বা, পেম্বা অ্যান্ড ওনলি পেম্বা ৷
advertisement
এই পেম্বা না থাকলে কোনওদিন এভারেস্টের কথা ভাবতামই না আমরা ৷ বসন্তদা আর আমাকে পেম্বাই এভারেস্টের স্বপ্ন দেখিয়েছিল ৷ ও না থাকলে আমরা এভেরেস্ট যেতাম কিনা সন্দেহ ৷ মনে আছে, এভারেস্টের সবকিছু ঠিক ৷ পেম্বাই বলেছিল, আমরা তিব্বত দিয়ে ক্লাইম্ব করব ৷ কারণ, চিন দিয়ে ক্লাইম্ব করার খরচ অনেকটাই কম ৷ তখন আমাদের মাথায় বিশাল ঋণের বোঝা ৷ তবু একটু নিশ্চিন্ত হলাম যেন ৷ কিন্তু কাঠমাণ্ডু পৌঁছেই পেম্বার মুখে শুনলাম অনেক দৌড়াদৌড়ি করেও তিব্বত দিয়ে ক্লাইম্ব করার অনুমতি জোগাড় করতে পারেনি সে ৷ কারণ, সেসময় চিন সরকার ভারতীয়দের ক্লাইম্ব করার অনুমতি দিচ্ছিল না ৷ আমরা ভাবলাম সব শেষ ৷ এখান থেকেই ফিরে যেতে হবে আমাদের ৷ এমনিতেই বাজারে এত ধার ৷ তার ওপর আরও খরচ হলে.... ৷ পেম্বা কিন্তু নির্বিকার ৷ নির্লিপ্ত মুখে বলে দিল, এখন ৫ লাখ টাকা ধার থাকলে তখন ১৫ লাখ হবে ৷ কিন্তু ক্লাইম্ব তোমাদের করতেই হবে ৷ ঠিক হল আমরা সাউথ কল দিয়ে যাব ৷ ততদিনে কিন্তু পেম্বার ৫ বার এভারেস্ট হয়ে গিয়েছে ৷ তবু মনে হল, আমাদের দিয়ে ক্লাইম্ব করিয়ে নেওয়ার তাগিদ ওরই বেশি ৷
advertisement
এভারেস্টের বেসক্যাম্প ৷ দিনটার কথা আজ বড্ড মনে পড়ছে ৷ বিকেল থেকে তাঁবুর মধ্যে জমিয়ে তাস খেলা চলছে ৷ আমি, বসন্তদা, অশোকদা, সৌরভ, বিভাস সকলেই তুমুল আড্ডাবাজ ৷ তাস খেলতে খেলতে খেয়ালই নেই রাত অনেক হয়ে গিয়েছে ৷ ওখানে তো সাতটা সাড়ে সাতটার মধ্যে রাতের খাবার খেয়ে ঘুমিয়ে পড়া ৷ হঠাৎ দেখি আটটা বাজে ৷ কেউ আমাদের খেতে ডাকছে না ৷ তাঁবুর বাইরে গিয়ে দেখি চারিদিক অন্ধকার ৷ কেউ কোত্থাও নেই ৷ আমাদের ডাইনিং তাঁবুটাও অন্ধকার ৷ কী হল ব্যাপারটা ? হাঁকডাক করতেই পেম্বা ছুটে এল ৷ সম্ভবত ও শুয়ে পড়েছিল ৷ পেম্বাকে জিজ্ঞাসা করলাম, আমাদের ডিনার কোথায় ? ও বলল, তোমরাই তো বলেছ আজ রাতে কিছু খাবে না ! আমরা তো তখন আকাশ থেকে পড়ছি ৷ কিছুক্ষণ পরে বিষয়টা খোলসা হল ৷ কুকরা আমাদের জিজ্ঞাসা করছিল, সাম মে আপ লোগ ক্যয়া লেঙ্গে ? আমরা ভেবেছি সন্ধ্যেবেলার কথা বলছে ৷ তাই বলেছি, কিছু না ৷ শুধু একটু পাঁপড় ভেজে দিলেই হবে ৷ ওরা পাঁপড় ভাজা করে দিয়ে নিজেরা খেয়েদেয়ে শুয়ে পড়েছে ৷ পুরোটাই ভুল বোঝাবুঝির ফলে হয়েছে ৷ পেম্বার তো লজ্জায় মুখ লাল ৷ সঙ্গে সঙ্গে আমাদের জন্য যা পারল করে দিল ৷ পরে সকালে উঠে ও যা বলল, তাতে আমি থ ৷ বলল, ‘তোমদের না খাইয়ে আমরা খেয়ে নিয়েছি, আমার মনে হচ্ছিল সব খাবার বমি হয়ে যাবে !’ কী বলব বুঝতে পারলাম না ৷ জলে ভরা চোখটা তাড়াতাড়ি নীচে নামিয়ে নিলাম ৷
advertisement
কত যে ছোটখাট স্মৃতি জড়িয়ে রয়েছে ওর সঙ্গে ৷ যেমন, আমি সবরকম খেতে ভালবাসি ৷ খাওয়া নিয়ে অত বাছবিচারও নেই ৷ কিন্তু বসন্তদা সব খান না ৷ ওরা ইয়াকের মাংস রান্না করত ৷ আমাকে জিজ্ঞাসা করত, তুমি খাবে ? আমি বসন্তদার সামনে কিছু না বললেও ও বুঝতে পারত যে আমার ইচ্ছা আছে ৷ সত্যিই লুকিয়ে লুকিয়ে মাংস নিয়ে আসত আমার জন্য ৷ এমনই ছিল আমাদের পেম্বা ৷
এরপর কাঞ্চনজঙ্ঘা ৷ মোট ৬২ দিনের এক্সপিডিশন ৷ কত স্মৃতি লেখাজোখা নেই ৷ আগের দিন সাড়ে ৪টেয় রওনা হয়ে পরের দিন সকাল সাতটায় সামিট করলাম ৷ আবার নেমে এলাম যখন তখন রাত সাড়ে ৮ টা ৷ মানে টানা ২৮ ঘণ্টা ক্লাইম্ব করছি ৷ তখন আর শরীরে কিছু নেই ৷ বুঝতেই পারছি না, যে পা ফেলছি কি ফেলছি না ৷ পেম্বা দৌড়ে ঢুকল টেন্টে ৷ জল গরম করল ৷ তাঁবুর সামনে এসে একদম ধপাস করে পড়ে গিয়েছি আমি ৷ আমাকে ধরে টেনে তাঁবুতে এনে জুতো-মোজা খুলিয়ে, গায়ের জামাকাপড় আলগা করে দিল ৷ গরম গরম খাবার খাইয়ে দিল নিজের হাতে ৷ ওই জনমানবহীন ধূ ধূ বরফভূমি, প্রিয়জনদের ছেড়ে হাজার কিলোমিটার দূরে এইভাবে মায়ের ভালবাসা দিতে পারে একমাত্র পেম্বা শেরপাই ৷
কেন জানি না ও সবার মধ্যে আমাকে একটু বেশিই ভালবাসত ৷ কখনও নাম ধরে ডাকতে দেখিনি ৷ দেবাশিস দাদা বা স্যার বলত ৷ এই পেম্বা না থাকলে ধৌলাগিরি থেকে আমি বেঁচে ফিরতাম কিনা সন্দেহ ৷ ধৌলাগিরি থেকে নামার সময় সাময়িক অন্ধ হয়ে গিয়েছিলাম আমি ৷ বরফের ওপর রোদ পড়ে চোখে লাগলে এরকম হয় ৷ পেম্বাকে বললাম, আমাকে এখানে স্যাক দিয়ে ভাল করে বেঁধে তোমরা চলে যাও ৷ জানতাম ঘণ্টা চারেক চোখ বুজে এখানে শুয়ে থাকলেই ঠিক হয়ে যাব আমি ৷ কিন্তু পেম্বা নাছোড়বান্দা ৷ কিছুতেই আমাকে একা রেখে ও যাবে না ৷ তখনও বসন্তদা একদম সুস্থ আছেন ৷ তাই পাসাং (পেম্বার দাদা নয়) শেরপাকে বসন্তদার দায়িত্ব দিয়ে পাঠিয়ে দিল ৷ নিজে থাকল আমার দায়িত্বে ৷ কিন্তু ও বুঝতে পারেনি বসন্তদার অক্সিজেন শেষ হয়ে গিয়েছিল ৷ সে কারণেই বসন্তদা শেষ পর্যন্ত ওই ভয়ঙ্কর বিপদে পড়েছিলেন ৷
এরপর নেমে আসাটা যেন একটা মির্যাকেল ৷ দাদা ডান দিকে, একটু বাম দিকে, এবার বিশ্রাম নাও...’ এই ভাবে নির্দেশ দিয়ে গোটা পথটা আমাকে নামিয়েছিল ৷ আমি তখন পুরো অন্ধ ৷ সত্যি বলছি, পেম্বা না থাকলে আমি বেঁচে ফিরতাম না ৷ যষ্ঠি হয়ে আমার সঙ্গে সঙ্গে ছিল সেদিন ৷ সমতলে খবরও চলে গিয়েছিল ৷ আমার স্ত্রী তো কাঠমাণ্ডু ছুটে গিয়েছেন, তখনও জানেন ডেডবডি আনতে যাচ্ছেন ৷ আমাকে দেখে হাউ হাউ কান্না ৷ তারপরেই জিজ্ঞাসা করল পেম্বা কোথায় ? ওর ঘরে ছুটে গেল ৷ ও নিজেও জানত, পেম্বা না থাকলে কফিবন্দি হয়েই ফিরতাম আমি ৷
আর শুধু পর্বতারোহন কেন ? মানুষ হিসাবেও কি তুলনা হয় ওর ? মনে পড়ে না কোনওদিন একটাও মিথ্যে কথা বলতে শুনেছি বলে ৷ এই তো সেদিন, মাস তিনেক আগেও একবার এসেছিল কলকাতায় ৷ আমার অফিসে এসেছে ৷ সেদিন আনেক বন্ধুবান্ধব জড়ো হয়েছি, খুব আড্ডা হচ্ছে ৷ পেম্বা কিন্তু উশখুশ করছে ৷ বসন্তদা ডেকেছেন, তাই ওকে এক্ষুণি যেতে হবে ৷ আমি বললাম, একটু বসোই না ৷ বসন্তদাকে বলো, রাস্তায় জ্যাম ছিল ৷ ফোন ধরতে পারলাম না মিটিংয়ে আছি বলে, দেরি হল বৃষ্টি পড়ছিল বলে... ৷ এমন কত টুকটাক মিথ্যে কথাই তো আমরা বলি ৷ পেম্বা কিন্তু পৃথিবীর সরলতম একটা হাসি হাসল ৷ আমি বুঝলাম, এই মিথ্যে কথাটা বসন্তদাকে কিছুতেই বলবে না ও ৷
আরোহীদের সুরক্ষা নিয়ে ও এত ভাবত, সেই পেম্বার ভুল ? হতেই পারে না ৷ পেম্বার কোনওদিন ভুল হতে পারে বলে আমি বিশ্বাস করি না ৷ পেম্বা বলত, ‘সেফটি লাগাকে চলনা ৷’ সেই কথাটাই কানে বাজছে আজ ৷ আবার পাহাড়ে গেলে এই সাবধানবাণী তো আর শুনতে পাব না...
পেম্বার থেকে বছর খানেকের বড় আমি ৷ যাওয়ার সময় বোধহয় ও আমাকে বার্তা দিয়ে গেল, "দেবাশিস দাদা, এবার তোমাকেও থামতে হবে ৷"
(অনুলিখন: সিমলি রাহা)
(ছবি: দেবাশিস বিশ্বাস ও পেম্বা শেরপার ফেসবুক সৌজন্যে ৷)
Location :
First Published :
July 18, 2018 3:06 PM IST