Rajiv Kumar
#নয়াদিল্লি: বুধবারই ভারতের হাতে আসছে প্রথম পর্যায়ের পাঁচটি রাফাল যুদ্ধবিমান৷ ফ্রান্সের থেকে সব মিলিয়ে ৩৬টি রাফাল পাবে ভারত৷ বিশেষজ্ঞরা বলছেন, একবার রাফাল হাতে পেয়ে গেলে একধাক্কায় ভারতীয় বায়ুসেনার অনেকটাই শক্তিবৃদ্ধি হবে৷ কারণ এতদিন চিন তো বটেই, পাকিস্তানের এফ-১৬ বা জেএফ ১৭-র মোকাবিলা করার মতো আধুনিক যুদ্ধবিমানও ভারতের হাতে ছিল না৷ সেই ঘাটতি মিটিয়ে ভারতীয় বায়ুসেনাকে অনেকটাই এগিয়ে দেবে রাফাল৷
পাকিস্তানের বায়ুসেনায় আমেরিকায় তৈরি এফ ১৬ যুদ্ধবিমান ছাড়াও চিনে তৈরি চেংগডু জেএফ ১৭ যুদ্ধবিমান ব্যবহার করে৷ অন্যদিকে পিপলস লিবারেশন আর্মি এয়ার ফোর্স বা চিনের বায়ুসেনার মূল অস্ত্র চেংগডু জে ২০এস যুদ্ধবিমান৷ একনজরে দেখে নেওয়া যাক, পাকিস্তানের হাতে থাকা জেএফ ১৭ থান্ডার এবং চিনের হাতে থাকা জে ২০এস যুদ্ধবিমানগুলির তুলনায় ফ্রান্সে তৈরি রাফাল ঠিক কতটা এগিয়ে বা পিছিয়ে৷
পাকিস্তান এবং চিনের বায়ুসেনা যে জেএফ ১৭ এবং জে ২০ যুদ্ধবিমানগুলি ব্যবহার করছে, সেগুলি দিনে এবং রাতে উড়তে এবং যুদ্ধক্ষেত্রে লড়াই চালাতে সক্ষম৷ চিনের দাবি অনুযায়ী, জেএফ ১৭ ফোর্থ জেনারেশন এবং জে ২০ ফিফথ জেনারেশন এয়ারক্রাফট৷
অন্যদিকে রাফালকে বলা হচ্ছে ৪.৫ জেনারেশন এয়ারক্রাফট৷ রাফালের নির্মাণকারী সংস্থা দাসল্ট-এর দাবি, এগুলি omnirole এয়ারক্রাফট৷ অর্থাৎ প্রত্যেকটি মিশনে এই যুদ্ধবিমানকে যে লক্ষ্যে কাজে লাগানো হয়, প্রয়োজনে রাফাল তার থেকেও অতিরিক্ত করার ক্ষমতা রাখে৷
দাসল্টের দাবি অনুযায়ী, যখন রাফাল যুদ্ধবিমান তৈরির পরিকল্পনা হচ্ছিল, তখন ফরাসি বায়ুসেনা এবং নৌসেনা এমন একটি যুদ্ধবিমান চেয়েছিল যা ওই দুই বাহিনীর হাতে থাকা সাত ধরনের যুদ্ধবিমানের কাজ একা করতে পারবে৷
রাফাল এবং পাকিস্তানের ব্যবহৃত জেএফ ১৭ যুদ্ধবিমান সিঙ্গল এবং ডবল সিটে পাওয়া যায়৷ অন্যদিকে চিনের জে ২০ যুদ্ধবিমানে একটি আসনই থাকে৷ চুক্তি অনুযায়ী ভারত ২৮টি একক সিটের এবং প্রশিক্ষণের জন্য ৮টি ডবল সিটের রাফাল কিনছে৷
সূত্র অনুযায়ী, এই তিন ধরনের যুদ্ধবিমানের মধ্যে চিনের জে ২০ সবথেকে ভারী৷ খালি অবস্থায় এর ওজন ১৯০০০ কেজি আর টেক অফ করার সময় সর্বোচ্চ ৩৭,০১৩ কেজি ওজন থাকতে পারে এই যুদ্ধবিমানের৷ অন্যদিকে খালি অবস্থায় রাফালের ওজন ৯৯০০ থেকে ১০৬০০ কেজি৷ আর সর্বোচ্চ টেক অফ ওয়েট ২৪৫০০ কেজি৷ এই তিন ধরনের যুদ্ধবিমানের মধ্যে জেএফ ১৭- এর ওজন সবথেকে হাল্কা৷ খালি অবস্থায় ৬৪১১ কেজি এবং সর্বোচ্চ টেক অফ ওয়েট ১২৪৭৪ কেজি৷ অর্থাৎ জেএফ ১৭-এর তুলনায় রাফাল ও জে ২০ অনেক বেশি জ্বালানি এবং অস্ত্র বহনে সক্ষম৷
চিনের চেংগডু জে ২০ এস যুদ্ধবিমান৷
চেহারার দিক থেকে বিচার করলে মাথা থেকে লেজ পর্যন্ত রাফালের দৈর্ঘ্য ১৫.৩০ মিটার৷ দু'পাশের ডানাই ১০.৯ মিটার করে লম্বা আর উচ্চতাও ৫.৩ মিটার, যা তিনটি যুদ্ধবিমানের মধ্যে সবথেকে কম৷ অন্যদিকে চেংগডু জে ২০-র বেশ দশাসই চেহারা৷ এর দৈর্ঘ্যে ২০.৩ থেকে ২০.৫ মিটার, দু' পাশের ডানা ১২.৮৮ থেকে ১৩.৫৫ মিটার করে লম্বা৷ আর জেএফ ১৭ দৈর্ঘ্যে ১৪.৯৩ মিটার, দু' পাশের ডানা ৯.৪৮ মিটার এবং উচ্চতা ৪.৭৭ মিটার৷
রাফালের নির্মাণকারী সংস্থা দাসল্টের দাবি অনুযায়ী, পাখার নকশার জন্য উঁচু কোণ থেকেও শত্রুপক্ষের উপরে তীব্র হামলা চালাতে সক্ষম রাফাল, যা আকাশে লড়াইয়ের সময় এই যুদ্ধবিমানকে প্রতিপক্ষের থেকে অনেকটাই এগিয়ে রাখে৷
রাফালের সর্বোচ্চ গতি মাখ ১.৮/৭৫০ কেটি(ঘণ্টায় ২২২২.৬ কিলোমিটার)৷ অন্যদিকে জে ২০-র সর্বোচ্চ মাখ ২.০ বা ঘণ্টায় ২৪০০ কিলোমিটারের আশেপাশে৷ জেএফ ১৭ থান্ডারের সর্বোচ্চ গতি উঠতে পারে ১.৬ মাখ বা ঘণ্টায় ১৯৭৫.৬৮ কিলোমিটার মতো৷ আকাশে যুদ্ধের সময় অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ বিষয় দাঁড়ায় কোন যুদ্ধবিমান কত উচ্চতা থেকে লড়াই চালাতে পারে৷ এক্ষেত্রে রাফাল সর্বোচ্চ ৫০ হাজার ফুট উচ্চতায় উঠতে পারে, জেএফ থান্ডার উঠতে পারে ৫৪ হাজার ফুট উচ্চতায়৷ কিন্তু এ দিক থেকে অনেকটাই এগিয়ে চিনের হাতে থাকা জে ২০এস৷ কারণ এই যুদ্ধবিমান প্রয়োজনে ৬৫,৬২০ ফুট উচ্চতায় উড়তে সক্ষম বলে দাবি করেছে GlobalSecurity.org৷
পাকিস্তানকে জেএফ ১৭ থান্ডার যুদ্ধবিমান সরবরাহ করেছে চিন৷
আবার অপারেশনাল রেঞ্জ-এর দিক থেকে জেএফ ১৭ বা জে ২০ থেকে অনেকটাই এগিয়ে রাফাল৷ অর্থাৎ নিজের ঘাঁটি থেকে ওড়ার পর রাফাল যতটা দূরত্ব অতিক্রম করতে, তা অন্য দু'টি যুদ্ধবিমানের পক্ষে সম্ভব নয়৷ একবার আকাশে ওড়ার পর রাফাল ৩৭০০ কিলোমিটার উড়তে সক্ষম৷ মাঝ আকাশে জ্বালানি ভরে নিলে এই দূরত্ব আরও বাড়াতে পারে ফরাসি এই যুদ্ধবিমান৷ সেখানে জে ২০ উড়তে পারে ২০০০ কিলোমিটার, আর জেএফ ১৭ থান্ডার ২০৩৭ কিলোমিটার উড়তে সক্ষম৷ দাবি করা হয়, জে ২০ ওড়ার সময় তা শত্রুপক্ষের রাডারে সহজে ধরা পড়ে না, যদিও ভারতের SU-30 MKIs যুদ্ধবিমান চিনের এই যুদ্ধবিমানের গতিবিধি ধরে ফেলতে সফল হয়েছে৷
তবে যুদ্ধবিমান যতই অত্যাধুনিক এবং ক্ষমতাসম্পন্ন হোক না কেন, তার সাফল্য নির্ভর করে অস্ত্রশস্ত্র এবং রাডারের উপর৷ সামরিক বিশেষজ্ঞদের মতে, রাফাল যে ধরনের মিসাইল এবং অস্ত্রশস্ত্র বহনে সক্ষম, তা পৃথিবীর মধ্যে অন্যতম সেরা এবং সর্বাধুনিক৷ রাফাল যে ধরনের METEOR এয়ার টু এয়ার লং রেঞ্জ মিসাইল ব্যবহার করে, তা দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় আকাশে যুদ্ধের গতিপ্রকৃতি আমূল বদলে দেবে বলেই মনে করা হচ্ছে৷ এই ধরনের মিসাইল ছুড়তে সক্ষম হওয়ায় রাফালের ধারেকাছে ঘেঁষার সাহস পাবে না প্রতিপক্ষ বিমান৷
এর পাশাপাশি রাফাল SCALP লং রেঞ্জ এয়ার টু ল্যান্ড মিসাইল ব্যবহার করতে সক্ষম৷ এই ক্ষেপনাস্ত্র অনেকটা নীচে থাকা প্রতিপক্ষ শিবির ধ্বংস করার ক্ষমতা রাখে৷ এছাড়াও রাফালে AM39 EXOCET অ্যান্টি শিপ মিসাইলও যুক্ত করা যায়, তাছাড়া ৫০০ থেকে ২০০০ পাউন্ড পর্যন্ত ক্ষমতার লেসার গাইডেড এবং নন গাইডেড বোমাও রাফাল থেকে নিক্ষেপ করা সম্ভব৷
দাসল্টের দাবি অনুযায়ী, রাফাল ইউরোপে তৈরি একমাত্র যুদ্ধবিমান যাতে ইলেক্ট্রনিক রাডার রয়েছে৷ যার পোশাকি নাম অ্যাক্টিভ ইলেক্ট্রনিক্যালি স্ক্যানড অ্যারে রাডার সিস্টেম, যা এই শ্রেণিতে সেরা৷ মেকানিক্যাল রাডার এবং অ্যান্টেনার তুলনা ইলেক্ট্রনিক রাডার দ্রুত শত্রুপক্ষকে চিহ্নিত করার পাশাপাশি একাধিক লক্ষবস্তুকেও খুঁজে বের করতে পারে৷
এখনও পর্যন্ত যুদ্ধক্ষেত্রে সাফল্যের সঙ্গে ৩০ হাজার ঘণ্টারও বেশি সময় উড়েছে রাফাল৷ লিবিয়া, ইরাক, আফগানিস্তান, সিরিয়া এবং মালির যুদ্ধেক্ষেত্রে এর সফল ব্যবহার হয়েছে৷ সেই তুলনায় জেএফ ১৭ বা জে ২০ এখনও পর্যন্ত যুদ্ধক্ষেত্র বা সেই ধরনের পরিস্থিতিতে পরীক্ষিত নয়৷
রেট অফ ক্লাইম্ব বা কত দ্রুত যুদ্ধবিমান বেশি উচ্চতায় উঠতে পারে, তা আকাশে লড়াইয়ের ক্ষেত্রে অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ বিষয়৷ সেদিক দিয়েও রাফাল এই দুই প্রতিপক্ষের থেকে এগিয়ে৷ বিভিন্ন রিপোর্টের দাবি অনুযায়ী, প্রতি মিনিটে ৬০ হাজার ফুট উচ্চতায় উঠতে পারে রাফাল৷ সেখানে চেংগডু জে ২০ ৫৯,৮৪২.৫২ ফুট উঠতে পারে৷ আর জেএফ থান্ডারের ক্লাইম্ব রেট ৫৯০০০ ফুট প্রতি মিনিট৷