পতিতালয় থেকে উঠে এসে তিনি হয়ে উঠেছিলেন সত্যজিতের ইন্দির ঠাকুরণ
- Published by:Simli Raha
- news18 bangla
Last Updated:
শেষ বয়সে সহায়, সম্বলহীন হয়ে এসে উঠেছিলেন লালবাতি এলাকার এক কামরার ঘরে । আসলে তখনও অনেক বড় কাজ করা বাকি ছিল তাঁর । বাকি ছিল বিশ্ব সিনেমার ইতিহাসে আজীবন নিজের নাম খোদাই করে দেওয়া ।
#কলকাতা: নামকরা বিদেশি কোম্পানির গ্রাফিক্স ডিজাইনিংয়ের নিশ্চিন্ত চাকরি ছেড়ে সেই সময় দীর্ঘাঙ্গী এক ভদ্রলোক হন্যে হয়ে খুঁজছেন তাঁর প্রথম ছবির জন্য এক বৃদ্ধাকে । কিন্তু কিছুতেই মন মতো পাওয়া যাচ্ছে না । বিভূতিভূষণ লিখে গিয়েছিলেন, ‘পঁচাত্তর বৎসরের বৃদ্ধা, গাল তোবড়াইয়া গিয়াছে, মাজা ঈষৎ ভাঙিয়া শরীর সামনের দিকে ঝুঁকিয়া পড়িয়াছে...’ নবীন পরিচালকের ঠিক এমনটাই দরকার ।
অবশেষে কলকাতার পতিতাপল্লীর ভাঙা দাওয়ায় খোঁজ মিলল পরিচালকের সেই পরশপাথরের । সত্যজিৎ রায়ের ইন্দির ঠাকুরণ হয়ে উঠলেন অশিতিপর চুনীবালা দেবী । সেই চুনীবালাই এক দিন উঠলেন দিগ্বিজয়ী সিনেমার ইতিহাস তৈরি করা চরিত্র ।
‘পথের পাঁচালী’র ইন্দিরকে খুঁজতে খুঁজতে সত্যজিৎ যখন প্রায় হাল ছেড়ে দিয়েছেন, তখন ছবিরই এক অভিনেত্রী খোঁজ দেন চুনীবালা দেবীর । বয়সকালে থিয়েটারে টুকটাক অভিনয় করেছিলেন চুনীবালা । দু-একটা ছবিতেও মুখ দেখিয়েছিলেন । তবে ওই পর্যন্তই । শেষ বয়সে সহায়, সম্বলহীন হয়ে এসে উঠেছিলেন লালবাতি এলাকার এক কামরার ঘরে । আসলে তখনও অনেক বড় কাজ করা বাকি ছিল তাঁর । বাকি ছিল বিশ্ব সিনেমার ইতিহাসে আজীবন নিজের নাম খোদাই করে দেওয়া ।
advertisement
advertisement

এই ভাবে একদিন শুরু হয়ে গেল ‘পথের পাঁচালী’র শ্যুটিং । কলকাতার উপকণ্ঠের বোড়ালকে সত্যজিৎ বানিয়ে নিলেন বিভূতিভূষণের পাতায় লেখা নিশ্চিন্দিপুর গ্রাম । সে যেন এক্কেবারে উঠে এসেছিল লেখকের কলম থেকেই । সেই বাঁশবন, পুকুর পাড়, কাশবনের ধারে রেললাইন, জমিদার বাড়ি, আর সর্বজয়ার তুলসীতলা । সেখানেই বইয়ের পাতা থেকে জীবন্ত হয়ে উঠলেন ইন্দির ঠাকুরণ । মাত্র ২০ টাকা রোজের মাইনে । এর বেশি দেওয়ার ক্ষমতা তখন ছিল না সত্যজিতের । তারপরেও নিজের বিমা, স্ত্রী বিজয়ার গয়না...সব বন্ধক দেওয়া । টাকার অভাবে তিন বছর ধরে চলেছিল সেই শ্যুটিং । পরিচালককে আশ্বস্ত করে সে ক’টা দিন বেঁচে ছিলেন চুনীবালা । কিন্তু শেষরক্ষা হয়নি তাতেও ।
advertisement

নিজের অসাধারণ সাবলীল অভিনয় দক্ষতায় খোদ সত্যজিৎকেও অভাবের কথা ভুলিয়েছিলেন চুনীবালা । একটা শট ছিল, নিজের ঘরের দাওয়ায় বসে খাচ্ছেন ইন্দির ঠাকুরণ । আর হাতে রুপোলি জরি পাকাতে পাকাতে তা হাঁ করে দেখছে ছোট্ট দুর্গা । সেই শট এতই ভাল আর সাবলীল হল যে, কাট বলতেই ভুলে গেলেন মানিক । আর ওই যে যখন মরার পাঠ করতে বলা হল, সকলেই ভেবেছিলেন হয়তো মনক্ষুণ্ণ হবেন চুনীবালা । কিন্তু ফোকলা দাঁতে কৌতূকের হাসি হেসে পর্দার ইন্দির বললেন, ‘‘ওমা ও তো অভিনয় ।’’
advertisement
ইন্দির যেমন তাঁর সবটুকু দিয়ে পরিপূর্ণ করেছিলেন ‘পথের পাঁচালী’কে, তেমন পরিচালক মশাইও ছিলেন তাঁর ঠাকুরণের প্রতি সদা যত্নবান । মৃত্যুর দৃশ্যে যখন ইন্দির ঠাকুরণের মাথা গড়িয়ে পড়ার কথা, তখন ছুটে গিয়ে চুনীবালার মাথা নিজের কোলে নিয়ে নিয়েছিলেন সত্যজিৎ । রসবোধও কম ছিল না বৃদ্ধার । বাঁশের খাটিয়ায় যখন ইন্দিরকে নিয়ে যাওয়ার শট ‘ওকে’ হল, তারপরেও চোখ মেললেন না চুনীবালা । কী হল হঠাৎ । সবাই যখন চিন্তায় পড়ে গিয়ে ডাকাডাকি শুরু করেছে, তখন পিটপিট করে তাকিয়ে, এক গাল হেসে চুনীবালা বললেন, ‘‘আমি তো ভাবছি শ্যুটিং এখনও চলছে ।’’
advertisement
সত্যজিতের সিনেমা, চিত্রনাট্য যতটা প্রভাবশালী, ঠিক ততটাই কৃতিত্ব রয়েছে গানেরও । বরাবরই মিউজিক তাঁর ছবির মূল সম্পদ । পরের দিকে সে গুরুদায়িত্ব নিজে সামলালেও, ‘পথের পাঁচালী’র মিউজিক ডিরেক্টর কিন্তু ছিলেন রবি শঙ্কর । তবে সঙ্গীত নিয়ে নিজের অমূল্য চিন্তাভাবনাও ছবিতে সংযোজন করেছিলেন সত্যজিৎ । যেমন, ইন্দির ঠাকুরণের নিজের গাওয়া গান । উপন্যাসে বা চিত্রনাট্যে কোথাও কোনও গান ছিল না । পরে হঠাৎই চুনীবালার নিজের কণ্ঠে একটি গান দিতে চান সত্যজিৎ । প্রথমে ‘মন আমার হরি হরি বল...হরি হরি বল...ভবসিন্ধু পার চল’ এই গানটি রেকর্ড করা হয়েছিল । কিন্তু ঠিক শট দেওয়ার আগে চুনীবালা বললেন, ‘আমার অন্য একটি গানও মনে এসেছে । শোনাব?’ ব্যাস, বিখ্যাত সেই গানটি অমর হয়ে রয়ে গেল ইন্দির ঠাকুরণের ভাঙা ভাঙা কণ্ঠে । ‘হরি দিন তো গেল সন্ধ্যা হল, পার করো আমারে ।’
advertisement
শেষ রক্ষা কিন্তু হল না । এত কষ্টে, এত দিন ধরে বানানো যে ছবি, তার মুক্তি চোখে দেখে যেতে পারলেন না চুনীবালা । সত্যজিৎ বোধহয় বুঝতে পেরেছিলেন । তাই ছবি মুক্তির জন্য অপেক্ষা না করে চুনীবালার বাড়িতে নিয়ে গিয়ে প্রজেকশনে দেখালেন সেই ছবি । তার পরপরই মারা গেলেন চুনীবালা । ১৯৫৫ সালের ২৬ অগস্ট মুক্তি পেল ‘পথের পাঁচালী’ । চুনীবালা দেখে যেতে পারলেন না, কত বড় ইতিহাসের সাক্ষী হয়ে গিয়েছেন তিনি । দেখে যেতে পারলেন না দেশ-বিদেশের অনন্য সমস্ত সম্মান । জানতে পারলেন না, তিনিই প্রথম ভারতীয় অভিনেত্রী, যিনি পুরষ্কৃত হয়েছেন বিদেশি চলচ্চিত্র উৎসবে । ম্যানিলা চলচ্চিত্র উত্সবে শ্রেষ্ঠ অভিনেত্রী বিবেচিত হয়েছিলেন চুনীবালা ।
advertisement
তিনি ছিলেন প্রকৃত অর্থেই ‘ডিরেক্টর্স অ্যাক্ট্রেস’। তাঁকে ছাড়া তৈরিই হত না ‘পথের পাঁচালী’ ।
Location :
First Published :
May 02, 2020 4:31 PM IST