পানের পাঁচনামা: অগ্রভাগে পরমায়ু , মূলভাগে যশ এবং মধ্যে লক্ষীর অবস্থান
- Published by:Rukmini Mazumder
- news18 bangla
Last Updated:
ব্রহ্মা তুষ্ট সুপারিতে, বিষ্ণু পানে এবং মহাবেদ চুনে। পানের খিলিতেই বাস করেন ত্রীদেব
#কলকাতা: সে বহু যুগ আগের কথা! রাজার নির্দেশে ধনপতিকে যেতে হবে সিংহলে। বহুদিন ওদেশ থেকে কোনও সওদাগর আসেনি। দেশে তাই গুয়ারের বড় অভাব! রাজা চিন্তিত! কীসে সাজা হবে তম্বুল, কি দিয়ে রাখবে অতিথিদের মান? কাজেই, রাজ-নির্দেশে ধনপতি নোকা ভাসালেন নোনাজলে। হাত পেতে নিতে হল রাজার দেওয়া তাম্বূল। সেইসঙ্গে শালবস্ত্র, লক্ষ মুদ্রা, তুরঙ্গ, বর্ম ও ফলা কাটারি। যথাসময়ে যাত্রা শুরু হল। পিছনে পরে রইল উজানিনগর, দুই স্ত্রী লহনা আর খুল্লনা।
তা হলেই ভাবুন, কেমন ছিল পানের কদর! আজও কিছু কমেনি! চব্য, চষ্য, লেহ্য, পেয় যতই উদরস্ত হোক, যতক্ষণ না মুখে পানটি পড়ছে, মন খুশ হয় না! পুজোপার্বন থকে শান্তিস্বস্ত্যয়ন...বাঙালির যে-কোনও অনুষ্ঠান তাকে ছাড়া অসম্পূর্ণ! বাঙালির বড় প্রিয় বন্ধু এই পান! বাঙালিরা মনে করেন, ব্রহ্মা তুষ্ট সুপারিতে, বিষ্ণু পানে এবং মহাবেদ চুনে। পানের খিলিতেই বাস করেন ত্রীদেব।
advertisement
কিন্তু কোথা থেকে এল পান? পন্দিতদের মতে, পান অস্ট্রো-এশিয়াটিক। ইন্দো-আরিয়ান নয়। আদিঠিকানা ফিলিপিন্স, সেবিস কিংবা জাভা, বোর্নি। তবে, ভারতীয়দের ধারণা, পান একান্ত স্বদেশি। যদিও আদিকালে পৃথিবীতে পান ছিল না!
advertisement
অশ্বমেধ যজ্ঞের সময় পানের জন্য দুনিয়া তোলপাড় করেন পঞ্চপাণ্ডব। হস্তীনাপুর ছাড়িয়ে নানা দিকে খোঁজ পড়ে যায়। কিন্তু কোথাও পান নেই! খুঁজতে খুঁজতে সন্ধানীরা পৌঁছান পাতালপুরীতে। সাপের রানির ঘরে। তখন বাসুকী তাঁদের খোঁজে সন্তুষ্ট হয়ে উপহার দেন হাতের কনিষ্ঠ আঙুল। সেই আঙুল মাটিতে পুঁতলে জন্মায় পানের বল্লরী। সে গাছের ফুল নেই, ফল নেই। কেবল কচি সবুজ পাতা। সংস্কৃতে তাই পানের আর এক নাম 'নাগবল্লরী'।
advertisement
এখানেই শেষ নয়! পুরাণে রয়েছে, সমুদ্রমন্থনে উঠেছিল হলাহল। সেই বিষের ভাণ্ড নিয়ে মহাবিপদে পড়েন দেবকুল! অবশেষে সেই বিষ গলায় ধারণ করে দেবাদিদেব হলেন নীলকন্ঠ। বিষের জ্বালায় কিছুক্ষণের জন্য তিনি মূর্ছা যান। তখন তাঁর কপালের ঘাম আর শরীরের ময়লা জমানো হল তামার পাত্রে। সেই মিশ্রণ থেকে জন্মায় এক সুদর্শন পুরুষ। নারায়ণ তাঁর নাম রাখেন তাম্বূল পুত্র। জন্মানোর পর সে যায় নাগলোক। তাঁর রূপে মুগ্ধ হয় নাগকন্যা। বিয়ে হয় দুজনের। জন্মায়, পানরূপী নাগবল্লরী।
advertisement
অনেকে আবার মনে করেন, অর্জুন স্বর্গ থেকে চুরি করে এনেছিল পানের চারা। পুঁতেছিল রাজবাড়ির বাগানে। সেখান থেকেই মর্তে পানের প্রচলন।
পান এককালে ছিল খুবই দামি। কিন্তু বহু দেশের লোক এই পাতার ব্যবহার পর্যন্ত জানত না। মনসামঙ্গল রয়েছে এমনই এক গল্প। চাঁদ সওদাগর বাণিজ্য করতে গিয়ে উপস্থিত হন আজব এক দেশে। সপ্তডিঙ্গা নোঙর হয়। সওদাগরের সঙ্গে দেখা করতে আসেন কোতোয়াল। সওদাগর তখন পান খেতে ব্যস্ত। সোনার বাটা থেকে পান-সুপারি-চুন দিলেন অতিথিকে। কোতোয়াল চুনকে দই ভেবে চেটে খেলেন, পান দিলেন ফেলে। চাঁদ বুঝলেন, এদশের লোক পানের ব্যবহার জানেন না। ব্যবসায়ী বুদ্ধি উসকে উঠল। পান পাতার বদলে দেশে নিয়ে ফিরলেন হিরে-মাণিক। এত গেল পুরাণের গল্পকথা! বাস্তবেও রয়েছে পানের ঝুড়ি ঝুড়ি কিসসা ! আরবি হেকিম আতা ইবন আহামদ বলেছিলেন, পানের অনেক গুণ। দোষ একটাই-- আরব মুলুকে আনতে না আনতেই পান শুকিয়ে যায়। উপায়? ইয়েমেন-এর লোকজন তাই এদেশ থেকে ওদেশ খাঁটি মধুতে ভিজিয়ে নিয়ে যেত পানপাতা। এতে পাতা শুকিয়ে তো যেতই না, উলটে হল আরও মিঠে।
advertisement
ইংরেজ ভারত ছাড়ল! দেশভাগ হল । চারদিকে হাহাকার, রক্তারক্তি! সেই দুঃসময়েও পাকিস্তান কিন্তু পানের কথা ভোলেনি। পান ছাড়া নাকী তাঁদের খাবার হজম হবে না! কাজেই, ভারত থেকে ওদেশে গেল পান!
১২৯৫ সালে মার্কোপোলো গুজরাতে আসেন। সেখানকার বাসিন্দাদের দাঁতের হাল দেখে অবাক হয়ে যান! লিখেছিলেন, এটা একধরণের পাতা চিবানোর ফল। সেই পাতা চিবোলে চেহারা খোলতাই হয়।
advertisement
১৫ শতকে বিজয়নগর আসেন আবদুর রজ্জাক। রাজদরবারে পৌঁছতেই রাজা তাঁর হাতে তুলে দেন সুগন্ধী পান। সিংহাসনের পাশে সবসময় থাকত মজুত তাম্বূলকরঙ্কবাহিনী। হাতে নিয়ে তাম্বূল-সম্পুট।
১৫৪৮ সালে এদেশে এসেছিলেন পর্তুগিজ পর্যটক বারবোসা। পান নিয়ে তিনি বলেন, '' চিবুলে মুখ লাল হয়, দাঁত কালো। তা ছাড়া পান তৃষ্ণা হরে, মাথা ঠান্ডা রাখে।''
advertisement
একই শতকে আসেন গার্সিয়া ওরটা। পান সম্পর্কে তিনি লিখেছিলেন, '' ভারতীয়রা সব সময়ইপান চিবুচ্ছে। বিশেষ করে মেয়েরা। পানের সঙ্গে থাকে সুপারি, চুন, খয়ের, কর্পূর। লক্ষ্য করলে দেখবে, ওদেশের মানুষের বুড়ো আঙুলের নখ বড়। কেননা, তাতে পানের শিরা ছিঁড়তে সুবিধা হয়। পান খুবই উপকারী। পানে মাথা সাফ, পেট সাফ, দাঁত ও মাড়ি অটুট।''
পান তৈরির সময় নখ বা বোঁটা দিয়ে পানের মাঝবরাবর ছিঁড়ে ফেলা হয়। খাওয়ার সময় দাঁত দিয়ে কেটে ফেলা হয় খিলির আগা। কিন্তু কেন? ফের দারস্থ পুরাণের। মার্কণ্ডেও পুরাণে রয়েছে,
পানের অগ্রভাগে পররমায়ু, মূলভাগে যশ এবং মধ্যে লক্ষীর অবস্থান। সেইজন্যই এই তিন ভাগ ফেলে পান খেতে হয়। না হলেই গণ্ডগোল। মূলভাগ খেলে কঠিন রোগ, অগ্রভাগ খেলে হবেন পাপের ভাগী, কমবে আয়ু আর পানের বোটা খেলে নষ্ট হবে বুদ্ধি। পিকও ফেলতে হবে নিয়ম মেনে। পান-সুপারি-মশলায় তৈরি প্রথম রস বিষের মতো। দ্বিতীয় রস রেচন। তৃতীয় রসই হল অমৃত। সেজজন্যই প্রথম দুবারের রস খাওয়া চলবে না। শুধু পানই নয়, রয়েছে পান মশলা খাওয়ার নিয়মও। সকালের পানে থাকবে বেশি সুপারি, দুপুরের পানে খয়ের এবং রাতে চুন। সুপারি ছাড়া পান খেলে রেহাই নেই। দোষ কাটাতে যেতে হবে গঙ্গাস্নানে। না হলে পরের জন্মে জন্ম হবে চণ্ডালের ঘরে!
view commentsLocation :
First Published :
October 06, 2020 8:30 PM IST