তিস্তা হারাল তাঁর প্রিয় সন্তান...
- Published by:Arka Deb
- news18 bangla
Last Updated:
দেবেশ রায়ের গদ্য লেখনি যেন অনেকটা প্রতিমার পিছনের নগ্ন কাঠামোর মত। পেরেক দিয়ে, কাঠ দিয়ে শক্ত করে বাঁধা। তাতে হয়তো গর্জন তেলের চাকচিক্য নেই, সৌন্দর্য নেই, কিন্তু কঠিন অস্তিত্ব রয়েছে। লিখছেন সাম্যব্রত জোয়ারদার।
মালদা মুর্শিদাবাদ পার করে গঙ্গা ঢুকে পড়ল বাংলাদেশ। নাম বদলে গেল নদীর। পদ্মা পেল রাজশাহীর মাটি। আর তার পরই পাবনা। পাবনা দেবেশ রায়ের দেশ। এক নদীর দেশ।
ছোটবেলাটা কাটল উদ্দাম উত্তাল যমুনার পাড়ে। কিশোর দেবেশের চেতনায় তখন থেকেই জড়িয়ে গেল নদী ভরা ঢেউ। তখনও মানুষ খুন করতে শেখেনি। তখনো মানুষ ধর্ম নিয়ে দেশভাগ চায়নি। তখনও মানুষ লালনের গান গায়। দেশভাগের আগেই দেবেশ রায় চলে এলেন উত্তরবঙ্গে। জলপাইগুড়ি শহরে। যমুনার ছেলের সঙ্গী হল তিস্তা আর করলা। পরে কাজের জন্য কলকাতায় বাসাবদল করতে হয়েছে ঠিকই। কিন্তু দেবেশ বরাবরই নিজেকে জলপাইগুড়ির মানুষ ছাড়া আর কিছুই ভাবেননি।
advertisement
আনন্দচন্দ্র কলেজের ছাত্র। তার উপর ইউনিয়নের সর্দার। লেখার হাত দুর্দান্ত। দারুণ হিউমার। চমৎকার গল্প বলেন। সুপুরুষ দেবেশের ফ্যান ফলোয়ারের তালিকা ছিল অনেকটা লম্বা। উনিশ বছর বয়সেই দেশ পত্রিকায় গল্প বেরোল। সাগরময় ঘোষের চিঠি এল ডাকে।
advertisement
চা বাগানের আধিয়ার শ্রমিকরা তখন একটু একটু করে দলবদ্ধ হচ্ছেন। নিজেদের অধিকার বুঝে নিতে মুঠোয় তুলে ধরছেন লালপতাকা। পাটের নৌকা চলেছে করলার বুকে। কিং সাহেবের ঘাট থেকে নিজের দেশকে বুঝতে চাইছেন দেবেশ। লেখালেখি নিয়ে কোনও দিনই খুব একটা প্রত্যাশা করেনি দেবেশ রায়। বই না বেরোলে মনখারাপ করেননি। বলতেন: আমার কাজ নিজের লেখা নিজের মতো করে লেখা। নিজের বই বের করা নয়।
advertisement
পার্টি ভাগ হয়ে গেল। উত্তাল নকশালবাড়ি। জরুরি অবস্থার নিকষ আঁধার। দেবেশ রায় রয়ে গেলেন কাস্তে ধানের শিসে। লিখলেন-মানুষ খুন করে কেন। দল থেকে আলাদা হয়ে পড়া বন্ধুদের প্রশ্ন করতে শুরু করলেন তাঁদের মত আর আদর্শ নিয়ে।
১৯৭৬ সাল। এত উত্তাল সময়ে প্রকাশিত হল দেবেশ রায়ের উপন্যাস-মানুষ খুন করে কেন।advertisement
দেবেশ রায়ের গদ্য লেখনি যেন অনেকটা প্রতিমার পিছনের নগ্ন কাঠামোর মত। পেরেক দিয়ে, কাঠ দিয়ে শক্ত করে বাঁধা। তাতে হয়তো গর্জন তেলের চাকচিক্য নেই, সৌন্দর্য নেই, কিন্তু কঠিন অস্তিত্ব রয়েছে। লড়াই রয়েছে। তাই তা হয়তো কখনও কখনও পাঠককে সুখপাঠ দিতে ক্রমাগত অস্বীকার করে গেছে।
কলকাতায় এলেন দেবেশ রায়। পৃথ্বীশ গঙ্গোপাধ্যায়ের সঙ্গে একদিন গেলেন বেলেঘাটায় কবি সুকান্ত ভট্টাচার্যের বাড়ি। ততদিনে কলেজ স্ট্রিটের পরিচয় অফিসে যাতায়াত শুরু হয়ে গেছে। নাড়িতে জড়িয়ে গেছে বইপাড়ার অলিগলি। পরে এই পরিচয় পত্রিকার সম্পাদনার কাজে দীর্ঘ দিন যুক্ত থাকবেন দেবেশ রায়। দীপেন বন্দ্য়োপাধ্য়ায়ের যোগ্য় উত্তরসুরী তিনিই।
advertisement
আটের দশকে আজকাল ও প্রতিক্ষণ পত্রিকা প্রকাশের সময় থাকে বাঙালি পাঠক এক আলাদা ঘরানা এক আলাদা লেখক শ্রেণিকে চিনতে শুরু করল। প্রতিক্ষণকে ঘিরে নতুন লেখা শুরু করলেন একদল লেখক। যাঁর কেন্দ্রে দেবেশ রায়।
বাগুইআটিতে তখন মার্টিন-রেল চলাচল বন্ধ হয়ে গেছে। দেবেশ রায় পড়শি হলেন অতীন বন্দ্যোপাধ্যায়, যুগান্তর চক্রবর্তী, অমিতাভ দাশগুপ্তের মত চরিত্রের।
advertisement
দেবেশ তিস্তার চরে ঘর বাঁধা মানুষগুলোকে নিয়ে ভাবতে শুরু করলেন। লিখলেন- তিস্তাপারের বৃত্তান্ত। সাহিত্য একাডেমির সম্মান এনে দিল ১৯৯০ সালে। বাঙালি পাঠক খুঁজে পেলেন তাঁদের ভাষার এক পরিশ্রমী কারিগরকে। দেবেশের উপন্যাস নিয়ে নাটক হলো। মানুষ ভাবতে বাধ্য হলেন বাঘারুকে নিয়ে। বাঘারুর বেঁচে থাকা নিয়ে।
দেবেশ রায়কে সবচেয়ে বেশি জনপ্রিয়তা দিয়েছিল তিস্তাপারের বৃত্তান্ত।advertisement
বয়স হয়েছিল। তবুও পড়াশোনা থেমে থাকেনি। কানে শুনতে পেতেন না। তাও পরোয়া নেই। লিটল ম্যাগাজিনের প্রতি ছিল তাঁর আজন্মের টান। খুঁজে খুঁজে লেখা পড়ার রোগ ছিল দেবেশের। আসলে দেবেশ রায় বাঙালির এমন এক মেধা যাঁকে উইকিপিডিয়াতে খুঁজে পাওয়া যাবে না। যাঁকে খুঁজে নিতে হবে কোনও এক নদীর পাড়ের কথ্যভাষায়। নৌকার চলাচলে। বাংলা ভাষা হারালো তার অসামান্য এক সৈনিককে। তিস্তা হারালো তাঁর প্রিয় সন্তানকে।
(সাম্যব্রত জোয়ারদার পেশায় সাংবাদিক। নব্বই দশকের কবি। 'ইঁদুরলিখিত', 'যখন ফানুসেরা ওড়ে' তাঁর উল্লেখযোগ্য কাব্যগ্রন্থ।)
view commentsLocation :
First Published :
May 15, 2020 3:55 PM IST

