#নয়াদিল্লি: মুম্বই থেকে অন্ডাল আসছিল একটি যাত্রীবাহী বিমান। অবতরণের ঠিক আগেই কালবৈশাখীর কবলে পড়ে সেটি। তাতেই বিপত্তি। গত রবিবার দুই বিমান চালক, চার জন কেবিন সদস্য-সহ মোট ১৯৫ জন যাত্রী নিয়ে মাঝ আকাশে টারবুল্যান্সে (Mid-air-turbulence) পড়ে মুম্বই-দুর্গাপুর SG_945 বিমানটি। ১ মে বিকেল ৫টা বেজে ১৩ মিনিটে এই ঘটনায় চাঞ্চল্য ছড়িয়েছে গোটা দেশে। সে দিন চালকের তৎপরতায় নিরাপদে দুর্গাপুরের মাটি ছুঁতে পেরেছিল বিমানটি, তবে মাঝ আকাশের বিমান-বিপত্তির জেরে বেশ কয়েকজন যাত্রী গুরুতর জখম হন।
কিন্তু কী এই গোলমাল, কেন হল এমন সমস্যা? জেনে নেওয়া যাক বিস্তারিত!
সূত্রের খবর, বোয়িং B737 Max বিমানটি গত ১ মে, রবিবার দুর্গাপুরের বিমান বন্দরে অবতরণের সময় ঝড়ের মধ্যে পড়ে। তারই ফলে মুম্বই থেকে পশ্চিমবঙ্গের দুর্গাপুরগামী স্পাইসজেট (SpiceJet)-এর ওই বিমানে থাকা অন্তত ৪০ জন যাত্রী জখম হয়েছেন বলে জানা গিয়েছে। তাঁদের মধ্যে দু’জন গুরুতর জখম। একজনের মাথায় আঘাত রয়েছে। অন্যজনের মেরুদণ্ডে। বিমান দুর্গাপুর পৌঁছনোর পরই এই দু’জনকেই হাসপাতালে স্থানান্তর করা হয়। জানা গিয়েছে, দু’জনকেই আইসিইউ (ICU)-তে চিকিৎসা করানো হচ্ছে।
আরও পড়ুন : ঘনিষ্ঠ 'রোমান্সের' মুহূর্তে কী চিন্তা করেন নারীরা? শুনলে চোখ কপালে উঠবে!
স্পাইসজেট (SpiceJet) এক বিবৃতিতে জানিয়েছে ১ মে, ২০২২ তারিখে স্পাইসজেট বোয়িং B737 বিমানটি মুম্বই-দুর্গাপুর SG-945 রুটে চলছিল। অবতরণের সময় বৈকালিক ঝড়ের কবলে পড়ে গুরুতর সমস্যা দেখা দেয়। দুর্ভাগ্যবশত কয়েকজন যাত্রী জখম হয়েছেন। দুর্গাপুরে পৌঁছানোর পর কাল বিলম্ব না করে চিকিৎসা সহায়তা দেওয়া হয়েছিল। ঘটনার পরই, অসামরিক বিমান পরিষেবা আইন (Civil Aviation Regulation) অনুযায়ী পদক্ষেপ করেছেন ডিরেক্টরেট জেনারেল অফ সিভিল এভিয়েশন (DGCA)। নিয়ম মেনে বিমানের ক্রু মেম্বার, এয়ারক্রাফ্ট রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্বে থাকা ইঞ্জিনিয়ার (AME) এবং স্পাইসজেটের মেন্টেন্যান্স কন্ট্রোল সেন্টারের দায়িত্বপ্রাপ্ত আধিকারিককে সরিয়ে দেওয়া হয়েছে।
এয়ার টারবুল্যান্স কী? আসলে আকাশে চলাচলের সময় বিমান এ ধরনের সমস্যার সম্মুখীন হয়ে থাকে। মূলত, বায়ুপ্রবাহের চাপ এবং বিমানের গতিবেগের আকস্মিক পরিবর্তন হলে বিমানে একটি ধাক্কা লাগতে পারে। অথবা, বিমানে টানও অনুভূত হতে পারে। আবহাওয়ার কারণে ঘটা সমস্যাগুলির মধ্যে অন্যতম। আগে থেকে এমন সমস্যার কোনও আন্দাজও পাওয়া যায় না। ফলে বিমান চালকদের কাছে এ ধরনের ঘটনা বেশ অপ্রত্যাশিত।
টারবুল্যান্স (Turbulence) হল বায়ুর এক অনিয়মিত প্রবাহ যা, বাতাসের ঘূর্ণমান এবং উল্লম্ব স্রোতের মিশ্রনে হঠাৎ তৈরি হতে পারে। এর ফলে হঠাৎই বিমানে এক বা একাধিক মারাত্মক ঝাঁকুনি লাগতে পারে। আবার হাওয়ার চাপ খুব বেশি থাকলে বিমান নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলতেও পারে। এমনকী বিমানের কাঠামোতে বড়সড় ক্ষতিও হয়ে যেতে পারে। এ ধরনের সমস্যা হতে পারে বজ্রবিদ্যুৎ পাতের সময়ও। আবার হাওয়ার প্রবাহ ছিন্ন হলেও এমনটা হওয়া সম্ভব।
একটি বিমান যে কোনও সময় প্রায় ৭ ধরনের টারবুল্যান্সের মধ্যে পড়তে পারে। কখনও তা আবহাওয়া সংক্রান্ত সমস্যার কারণে হতে পারে। আবার কখনও বায়ু প্রবাহ বা জেট স্ট্রিম (Jet Stream)-এর কারণে হতে পারে। জেট স্ট্রিম হল বায়ুর স্রোতের এক শক্তিশালী বেড় যা ভূপৃষ্ঠ থেকে কয়েক মাইল উপরে পৃথিবীকে ঘিরে রেখেছে। উত্তর ও দক্ষিণ গোলার্ধে দু’তিনটি করে জেট স্ট্রিম থাকতে পারে। আবহাওয়া সংক্রান্ত টার্ব্যুলেন্স হলে, অর্থাৎ ঘন মেঘ বা বজ্রবিদ্যুতের মধ্যে দিয়েও বিমান উড়তে পারে।
আরও পড়ুন : মা উড়ালপুলে বৃদ্ধের 'মরণ ঝাঁপ'! নেপথ্যে কী? পরিবার কী বলছে? বাড়ছে রহস্য...
টারবুল্যান্স হলে আঘাত এড়াতে যাত্রীদের কী করা উচিত? বিমান যাত্রীরা তাঁদের ‘সিট বেল্ট’ সব সময় বেঁধে রেখে সহজেই অপ্রত্যাশিত কোনও আঘাত থেকে বাঁচতে পারেন। এর বাইরে বিমানে নিরাপদ থাকার জন্য নচে টিপস দেওয়া হল: ১. বিমান সেবক বা ফ্লাইট অ্যাটেনডেন্টদের কথা মন দিয়ে শুনতে হবে। ২. উড়ান শুরুর আগে ‘সেফটি ব্রিফিং’-এ মনোযোগ দিতে হবে এবং প্রয়োজনে ‘সেফটি ব্রিফিং’ কার্ডটি ভাল করে পড়ে রাখতে হবে। ৩. নিজের এবং নিজের পরিবারের সকলের ‘সিট বেল্ট’ সব সময় বাঁধা আছে কি না খেয়াল রাখতে হবে। ৪. সন্তানের বয়স দুই বছরের কম হলে অনুমোদিত শিশু নিরাপত্তা আসন বা ডিভাইস ব্যবহার করতে হবে। ৫. উড়ানের সময় অবশ্যই এয়ারলাইনের Carry-on বিধি-নিষেধ মেনে চলতে হবে।
এ ধরনের ঘটনায় বিপদের সম্ভাবনা কতখানি? প্রাকৃতিক নানা দুর্যোগ এবং এ ধরনের টারবুল্যান্স উড়ানের সময় খুবই স্বাভাবিক ঘটনা। তা হলে প্রশ্ন উঠতেই পারে, বিপদের সম্ভাবনা কতটা! সাধারণত, বিমান চালকদের টারবুল্যান্স মোকাবিলা করার উপযুক্ত প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়। কিন্তু টারবুল্যান্সের ভয়াবহতা নির্ভর করে তার প্রকৃতি এবং তীব্রতার উপর। বজ্রপাতের সময় কোনও রকম টারবুল্যান্স তৈরি হলে তা মারাত্মক হতে পারে। কারণ এ রকম সময়ে বিমানের উপর অতিরিক্ত চাপ তৈরি হতে পারে, যাতে বিমান নিয়ন্ত্রণও হারাতে পারে। সমীক্ষা বলছে, ১২ থেকে ২০ হাজার ফুট উচ্চতায় ঝড়ের মধ্য-স্তরে টারবুল্যান্স হওয়ার সম্ভাবনা সব থেকে বেশি থাকে। উল্লম্ব মেঘের অবস্থানে এই সমস্যা আরও গুরুতর হয়ে উঠতে পারে। এর বাইরে মানুষের ভুলেও কিছু সমস্যা তৈরি হতে পারে, যেমন বিমান চালকের উপযুক্ত প্রশিক্ষণের অভাব বা আবহাওয়া সম্পর্কে সঠিক পূর্বাভাস না থাকা।
টারবুল্যান্সের সময় আসলে ঠিক কী ঘটে? টারবুল্যান্সের মাত্রার উপর নির্ভর করে তা থেকে বিপদের সম্ভাবনা কতখানি। সামান্য টারবুল্যান্সের ফলে অনেক সময় বিমান এক ধাক্কায় অনেকখানি নেমে আসতে পারে। আবার ঝাঁকুনিও লাগতে পারে। বিমানযাত্রীদের মনে হতে পারে সিটবেল্টটি খুব চেপে বসছে শরীরে। মাঝারি ধরনের টারবুল্যান্সের ক্ষেত্রেও একই অনুভূতি হতে পারে, তবে তার মাত্রা খানিকটা বেশি হবে। তবে এই দুই ক্ষেত্রে বিমানের নিয়ন্ত্রণ হারানোর সম্ভাবনা প্রায় থাকেই না। তবে এতে ভয়ের কোনও কারণ নেই। গুরুতর টারবুল্যান্সের ক্ষেত্রে বিমানের উচ্চতার হঠাৎ পরিবর্তন হতে পারে। বিমানের অস্বাভাবিক আচরণও সম্ভব। সাধারণত, বিমানের গতির উপর মারাত্মক প্রভাব পড়ে। মুহূর্তের মধ্যে বিমানের নিয়ন্ত্রণ হারাতে পারে। সিট বেল্ট আর শক্ত করে এঁটে বসবে কোমরে। সর্বোচ্চ পর্যায়ের টারবুল্যান্স হলে বিমান সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে লাফাতে থাকতে পারে। এতে বিমানের দেহের ক্ষতি হতে পারে। ‘Chop’ এক ধরনের টারবুল্যান্স যা মাঝে মধ্যেই হতে পারে, আর বিমানে একটা ছন্দোময় ঝাঁকুনি অনুভূত হতে পারে।
স্পাইসজেটের বিমানে সে দিন ঠিক কী হয়েছিল? সে দিনের বিমানে থাকা এক যাত্রী জানিয়েছেন, প্রথম থেকে বিমানে কোনও সমস্যা ছিল না। সকলেই নিজের নিজের মতো ব্যস্ত ছিলেন। অবতরণের ঠিক আধঘণ্টা আগে বিমানে ঝাঁকুনি লাগতে শুরু করে। বিমান নামতে শুরু করার সময় থেকে শেষ ১৫ মিনিট সব থেকে খারাপ অবস্থা হয়েছিল বলে তাঁর দাবি। তিনি জানান, মনে হচ্ছিল, যেন কোনও একশো তলা ভবন থেকে নিচে পড়ে যাচ্ছেন তাঁরা। আবার মুহূর্তের মধ্যেই কে যেন ধাক্কা দিয়ে একশো তলা উপরে পাঠিয়ে দিচ্ছে। তিনি নিজের সিট বেল্ট সজোরে বেঁধে রেখেছিলেন। কিন্তু অনেকেই তা করে উঠতে পারেননি। তাঁরা ছিটকে পড়েছেন। অনেকে মাথার উপরে ব্যাগেজ রাখার কম্পার্টমেন্টের সঙ্গে ধাক্কা খেয়েছেন। অনেকে ভয়ে অসুস্থ হয়ে পড়েন। DGCA রবিবারের ঘটনার তদন্ত শুরু করেছে। সে দিন স্পাইসজেটের বিমানটি মাঝ আকাশের ঝড়ের সম্মুখীন হওয়ার পর কী ভাবে অতজন যাত্রী আহত হলেন সে দিকটি খতিয়ে দেখা হচ্ছে। তদন্তে খতিয়ে দেখা হবে সে দিনের আবহাওয়ার পরিস্থিতি কেমন ছিল, বিমান চালক অপ্রস্তুত ছিলেন কি না অথবা তাঁরা আদৌ কেবিনে প্রস্তুত থাকার বিষয়টি জানিয়েছিলেন কি না!
বর্তমানে, দুর্ঘটনাগ্রস্ত বিমানটিকে কলকাতা বিমানবন্দরে নিয়ে যাওয়া হয়েছে বলে জানিয়েছে DGCA। স্পাইসজেটের অন্য বিমানগুলি অবশ্য পরিষেবার সঙ্গে যুক্ত রয়েছে। মোট ৯১টি বিমান নিয়ে সারা ভারতে পরিষেবা দেয় স্পাইসজেট।
অসামরিক বিমান পরিবহণ দফতরের কেন্দ্রীয় মন্ত্রী জ্যোতিরাদিত্য সিন্ধিয়া (Jyotiraditya Scindia) বলেন, ‘দুর্গাপুরে অবতরণের সময় ঝড় বাদলের সম্মুখীন হয়েছিল একটি বিমান। দুর্ভাগ্যবশত, বেশ কয়েকজন যাত্রী সে দিনের ঘটনায় জখম হয়েছেন। গোটা ঘটনার তদন্ত করার জন্য DGCA-র তরফে এক প্রতিনিধি দল গঠন করা হয়েছে।’ কেন্দ্রীয় মন্ত্রীর দাবি, গোটা ঘটনার তদন্ত গুরুত্ব দিয়ে করা হবে বলে আশ্বাস দিয়েছেন। তিনি আরও বলেন, তদন্ত শেষ হলে ঘটনার বিশদ বিবরণ সম্পর্কে আরও তথ্য জানান হবে।
নিউজ১৮ বাংলায় সবার আগে পড়ুন ব্রেকিং নিউজ। থাকছে দৈনিক টাটকা খবর, খবরের লাইভ আপডেট। সবচেয়ে ভরসাযোগ্য বাংলা খবর পড়ুন নিউজ১৮ বাংলার ওয়েবসাইটে।
Tags: Flight, Safety measures