ভালোবাসা কারে কয় ? বুঝিয়েছিলেন বেণু
Last Updated:
‘আমি যতই ভালোবাসি না কেন, সমাজের চোখে খলনায়িকা হিসাবেই পরিচিত থাকব’
#কলকাতা: হঠাৎই এক়দিন তাঁর উপর ঋত্বিক ঘটকের চোখে পড়ে ৷ আর তাঁকে দেখামাত্রই বাঙাল ভাষায় বিচিত্র সম্বোধনে তিনি বলে উঠেছিলেন, “অ্যাই ছেমড়ি, একটা ছবি করতাসি ‘চেনা মুখ’ গল্প নিয়া। তর লিগা একটা পার্ট আছে ‘নীতা’। সব কাম প্যাক-আপ কইরা দশ দিনের লাইগা শিলং চল…” নিজের চোখ কানকে বিশ্বাস করতে পারছিলেন না সুপ্রিয়া। এরপরেরটা তো ইতিহাস ৷ বাংলা আর বাঙালি যতদিন থাকবে ততদিন থাকবেন তিনি ৷ স্বর্ণযুগের নায়িকা হয়েও তথাকথিত বাঙালি সুন্দরীর সংজ্ঞা তাঁর জন্য খাপ খায় না ৷ তাঁর সৌন্দর্য আন্তর্জাতিক ৷ এককালের স্টাইল আইকন ৷ তিনি সুপ্রিয়া চৌধুরী ৷
তাঁর বয়স তখন মাত্র সাতবছর ৷ অভিনয় জগতে হাতেখড়ি ৷ অ্যাডভোকেট বাবার নির্দেশনায় দুটি নাটকে অভিনয় করেছিলেন তিনি ৷ ছোট থেকে নাচটা ছিল হৃদয়ের খুব কাছের ৷ নৃত্যশৈলীতে তিনি এতটাই পটিয়সী ছিলেন যে, তৎকালীন বর্মার প্রধানমন্ত্রীর থাকিন নুর থেকে পুরষ্কৃতও হয়েছিলেন সুন্দরী বেণু। কলকাতায় এসেও নাচ চলেছে পুরোদমে ৷ সে সময় তাঁদের প্রতিবেশী ছিলেন চন্দ্রাবতী দেবী। তিনিই তাঁর পরিচিতি ব্যবহার করে বাংলা সিনেমার জগতে নামার সুযোগ করে দেন সুপ্রিয়া দেবীকে।
advertisement
advertisement
বাংলা ছবির স্বর্ণযুগের অভিনেত্রী হয়েছিলেন সুপ্রিয়া, দর্শকদের মনে জায়গা জুড়ে ছিলেন উত্তম- সুপ্রিয়া জুটিও । উত্তম ছাড়াও সুপ্রিয়া দাপট দেখিয়েছেন ঋত্বিক ঘটক এবং বাংলার তাবড় পরিচালকদের ছবিতে, নিজের অভিনয় ক্ষমতার প্রকাশ দেখিয়েছেন মেঘে ঢাকা তারা, কোমল গান্ধার-সহ বহু ছবিতে, ‘মেঘে ঢাকা তারা’-র নীতা কিংবা ‘দেবদাস’–এর চন্দ্রমুখী, বা ‘দুই পুরুষ’-এর বিমলা অথবা ‘বন পলাশীর পদাবলী’র পদ্মা বাঙালি হৃদয়ে থাকবে অমলিন ! তাঁর প্রাপ্তির ঝুলিতে, দু’বার বাংলা ফিল্ম জার্নালিস্ট অ্যাসোসিয়েশন থেকে সম্মাননা । ২০১১ সালে বঙ্গ বিভূষণ সম্মানে সম্মানিত করা হয় তাঁকে। ২০১৪ সালে পদ্মশ্রী সম্মানে তাঁকে সম্মানিত করে কেন্দ্রীয় সরকার।
advertisement
উত্তম কুমার নিজে পছন্দ করে বিয়ে করেছিলেন গৌরী দেবীকে, কিন্তু সময়ের সঙ্গে সঙ্গে মানসিক দূরত্ব বাড়তে থাকে দু’জনের । আর অন্যদিকে, সুপ্রিয়া দেবীর বিয়ে হয়েছিল বিশ্বনাথ চৌধুরীর সঙ্গে ৷ বিয়ের কয়েক বছর পর তাঁর একটি কন্যা সন্তান হয়। সে সময় কয়েক বছরের জন্যে ছবির জগৎ থেকে বিরতি নেন সুপ্রিয়া চৌধুরী। তারপর ফের তিনি ফেরেন বড় পর্দায়। সম্পর্কের টানাপড়েন শুরু হয় তাঁরও ! ব্যক্তি জীবনের শূন্যতা থেকে জন্ম নেয় ভালো লাগা ৷ দুজনের মধ্যে গড়ে ওঠে গভীর ভালোবাসার নির্ভরতা ।
advertisement
যা নিয়ে কোনও লুকোচুরি ছিল না ৷ লোকনিন্দা, অপবাদকে উপেক্ষা করে ১৯৬৩ সালের ২৬শে সেপ্টেম্বর গিরীশ মুখার্জি রোডের পৈতৃক বাসভবন থেকে বেরিয়ে আসেন উত্তমকুমার । চলে আসেন সুপ্রিয়া দেবীর ময়রা রোডের ফ্ল্যাটে। জীবনের শেষ ১৭ বছর থেকে গিয়েছেন সুপ্রিয়া দেবীর বাড়িতেই মহানায়ক উত্তম কুমার ৷ আইনত বিয়ে হয়েছে বলে বারবার দাবি করেছিলেন তিনি ৷ এমনকী প্রয়াত অভিনেত্রী ললিতা চট্টোপাধ্যায় নিজে দাবি করেছিলেন যে, মহানায়ক ও সুপ্রিয়াদেবীর বিয়েতে হাজির ছিলেন তিনি ৷ উত্তমবাবু ও সুপ্রিয়াদেবীর গলায় মালা পরা একটি প্রমাণমাপের একটি ছবি সুপ্রিয়াদেবীর বাড়ির দরজা দিয়ে ঢোকার পথের সামনেই রাখা ছিল ৷
advertisement
এখনকার সমাজের খুব কম মানুষই এই ধরণের সম্পর্ককে সম্মান দিতে জানে বা পারে! তখনকার সামাজিক প্রেক্ষাপটে একজন নারী হিসাবে সুপ্রিয়া দেবীকে কী পরিস্থিতির মধ্যে দিয়ে যেতে হয়েছে তা সহজেই আমরা সবাই অনুমান করতে পারি।
advertisement
তারপরেও সকলের কাছে সুপ্রিয়া দেবীর প্রশংসা, তাঁর হাতের রান্নার প্রশংসা উত্তমকুমার যেমন খোলাখুলি করে গিয়েছেন, ঠিক তেমনি সুপ্রিয়া দেবীও সমাজের রক্ষণশীলতা ভেঙে তিনি তাঁর ভালোবাসার কথা লিখে বলে প্রকাশ করেছেন, বলেছেন ‘‘আমরা নিজেরা জানতাম আমরা মেন্টালি ম্যারেড, সবার আগে মন কথা বলে। সেটাই তো রায় দিয়ে দিয়েছিল।’’ যদিও সুপ্রিয়া দেবী নিজেও জানতেন এবং উত্তমকুমারকে বলেওছিলেন, ‘‘তুমি আমার প্রাণ, তোমাকে আমি যতই ভালোবাসি না কেন সমাজের চোখে আমি খলনায়িকা হিসাবেই পরিচিত থাকব”!
advertisement
উত্তম যেমন খুব রোম্যান্টিক ছিলেন এবং তেমনি ছিলেন কখনও কখনও বেশ ঈর্ষাকাতর। উত্তম কুমারের বারণ মেনেই হিন্দি ছবির জগত ত্যাগ করেন সুপ্রিয়াদেবী । বাড়িতে প্রযোজক ও পরিচালকদের বেশি আসা-যাওয়া এবং সুপ্রিয়া দেবীর সঙ্গে তাঁদের আড্ডা একেবারেই পছন্দ করতেন না তিনি। একটি সাক্ষাৎকারে সুপ্রিয়াদেবী বলেছিলেন, ‘‘কথাপ্রসঙ্গে উত্তমকুমারকে রেগে বললাম, তোমার যা অ্যাটিটিউড, একটা মদ্দা মাছিও বাড়িতে ঢুকতে পারবে না। এক প্রস্ত ঝগড়া হল, তার পর দু’জনেই জোর হাসলাম”।
সুচিত্রা সেন সম্পর্কে দেওয়া একটি সাক্ষাৎকারে তিনি জানিয়েছিলেন, ‘‘ তখন আমার উনিশ-কুড়ি বছর বয়স। শেওড়াফুলির একটা হলে উত্তম কুমার ও সুচিত্রা সেন অভিনীত অগ্নিপরীক্ষা ছবিটি দেখতে গিয়েছিলাম। ১৯৫৪ সালের কথা। সেই সময় এই ছবিটিকে নিয়ে দর্শকদের মধ্যে বিরাট উন্মাদনার সৃষ্টি হয়েছিল। হলের বাইরে প্রচন্ড ভিড়। টিকিটের জন্য হাহাকার। আমার সঙ্গে লোক ছিল। কোনওরকমে দু-তিনটে টিকিট জোগাড় করে ছবি দেখলাম। বেশ ভাল লেগেছিল অগ্নিপরীক্ষা। এরপর বেশ কিছুদিন উত্তম-সুচিত্রার রোমান্টিসিজম আমাকে একেবারে ঘিরে রেখেছিল। রমাদি’র সঙ্গে আমার প্রথম পরিচয় সিঁথির মোড়ে এমপি স্টুডিওতে। সুচিত্রা সেনের সঙ্গে আলাপ করিয়ে দিলেন পরিচালক নির্মল দে। নির্মলদার বসু পরিবার ছবিতে আমি প্রথম কাজ করেছিলাম। ভদ্রমহিলার সৌন্দর্যের থেকে ব্যক্তিত্বই আমাকে আকর্ষণ করেছিল বেশি। এরপর ধীরে ধীরে তাঁর সঙ্গে সুন্দর একটা সম্পর্ক গড়ে ওঠে আমার। তাঁকে আমি রমাদি বলেই ডাকতাম, আমাদের ময়রা স্ট্রিটের বাড়িতে রমাদি কতবার এসেছে! আমরা তিনজন একসঙ্গে লাঞ্চ করেছি, ডিনার করেছি, আড্ডা মেরেছি ঘন্টার পর ঘন্টা। রমাদির বাড়িতেও গিয়েছি। রমাদির জন্মদিনে প্রতিবছর উত্তম ও আমি নিয়ম করে তাকে ফুল পাঠাতাম। এমন একটা বছরও হয়নি, রমাদির জন্মদিনে আমি উইশ করিনি”।
ফের আসা যাক উত্তম কুমার প্রসঙ্গে ৷ ১৯৮০ সালে ৫২ বছর বয়সে হঠাৎ হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে প্রয়াত হন উত্তম কুমার ৷ কিন্তু তাঁর মৃত্যুর পর সুপ্রিয়ার জীবনে আর কোনও প্রেম আসেনি ৷ মহানায়কের মৃত্যুর পর থেকে পর থেকে উত্তমকুমারের ছবিতে মালা দিয়েই জীবনের শেষ দিন পার করে গেলেন সুপ্রিয়া দেবী ।
জন্মান্তরে বিশ্বাসী ছিলেন না সুপ্রিয়াদেবী ৷ তাঁর নিজের ভাষাতে, ” জীবন একটাই । তার পর সব শেষ । আর সেটা খুব নির্মমও। তুমি যা দিলে টিলে, এখনই যদি পেলে তো পেলে । পরে কেউ মনে রাখবে না । শক্তি সামন্ত খুব বলতেন, “রাত গ্যায়ী , বাত গ্যয়ি”
ছবি: শন বন্দ্যোপাধ্যায়ের ফেসবুক থেকে নেওয়া ৷
বিনোদন জগতের লেটেস্ট সব খবর ( Entertainment News in Bengali ) পান নিউজ 18 বাংলায় ৷ বলিউড, টলিউড থেকে হলিউড সব খবরই পাবেন এখানে ৷ দেখুন ব্রেকিং নিউজ এবং টপ হেডলাইন ন নিউজ 18 বাংলার লাইভ টিভিতে ৷ এর পাশাপাশি ডাউনলোড করতে পারেন নিউজ 18 বাংলার অ্যাপ অ্যান্ড্রয়েড এবং আইওএস-এ ৷ News18 Bangla-কে গুগলে ফলো করতে ক্লিক করুন এখানে ৷
Location :
First Published :
January 08, 2019 4:19 PM IST







