ছোটবেলায় আর পাঁচটি সাধারণ ছেলের মতোই বড় হচ্ছিল সুমনা, যদিও তখন তার নাম ছিল সুমন। তবে বাড়ির বড় ছেলে হওয়ায় প্রথম থেকেই তার প্রতি আস্থা ছিল বাড়ির লোকেদের অনেক বেশি। কিন্তু ছোটবেলা থেকেই তার স্বভাব অনেকটা মেয়েদের মতো। তাই অচিরেই বন্ধ হয়ে গেল বাড়ির দরজা। দ্বিতীয় শ্রেণিতে পড়ার সময় তার ঠাই হল করিমপুরের একটি অনাথ আশ্রমে, তবে সেটিও ছিল ছেলেদের অনাথ আশ্রম তাই সেখানেও খুব একটা ভাল অভিজ্ঞতা নেই তার। জুটেছে বন্ধুদের কাছ থেকে শুধুই অবহেলা এবং অবজ্ঞা। কিন্তু শত বাধা বিপত্তির মধ্যেও নিরন্তর ভাবে সে চালিয়ে গিয়েছে নিজের পড়াশোনা।
advertisement
“আপনার শহরের হাসপাতাল এবং চিকিৎসকদের নামের তালিকা পেতে এখানে Click করুন”
পড়াশোনার শুরুর থেকেই সে ছিল অত্যন্ত মেধাবী ক্লাসে বরাবরই ভাল নম্বর পেত সুমনা। মাধ্যমিকে ৮২ শতাংশ নম্বর নিয়ে পাস করে শুরু হল জীবনের আরেক অধ্যায়। মাধ্যমিক দেওয়ার পরই নিজের বাড়ি করিমপুর ছেড়ে সে চলে আসে কৃষ্ণনগরে। প্রথমদিকে আত্মীয়-স্বজনের বাড়িতে আশ্রয় পেলেও খুব বেশি দিন তাও কপালে জোটেনি। ক্লাস টুয়েলভ থেকেই নিজের পেটের ভাত নিজেই যোগান দেয় সে। টিউশন পড়িয়েই সেই পয়সায় নিজের খাওয়া খরচ থেকে শুরু করে লেখাপড়া সবই করে সুমনা। যদিও এই কঠিন সময় বেশ কিছু মানুষকে পেয়েছে যারা তাকে এগিয়ে যেতে সাহায্য করেছে।
আরও পড়ুন: কলকাতার কাছেই রয়েছে এই জমিদার বাড়ি! ইতিহাসের খনি! জানুন কীভাবে যাবেন, কোথায় থাকবেন
এরপর উচ্চমাধ্যমিকে পাস করে কলেজে ভর্তি হয়ে অঙ্কে স্নাতক হয় সে। এদিকে পাশাপাশি চলছে জীবনের চরম পর্যায়ের লড়াই। যেহেতু ছোটবেলা থেকে তার মধ্যে ছিল নারীত্বের ছোঁয়া সেটি সে বুঝতে পারে নবম শ্রেণিতে থাকতেই। বাইরে থেকে পুরুষ হলেও ভেতর থেকে সে নারীদের মতোই। তাই কলেজে উঠে সিদ্ধান্ত নেয় সুমনের পরিচয় আর রাখবেন না তিনি আর তারপরেই তিনি হয়ে উঠলেন সুমনা।
তবে এখানেই শেষ নয়। এরপরও জীবনে একাধিক অপমান এবং লাঞ্ছনা পোহাতে হয়েছে তাকে। একদিকে প্রচলিত তালি বাজানোর হাতছানি অন্যদিকে সমাজের বাঁকা চাহনি। নিজের এক শিক্ষিকা যার কাছে সুমনা টিউশন পড়ত তিনিও সুমনার এই নারীর সত্তাকে সমাজের বাকি পাঁচজনের মতোই মানসিক রোগ বলে বিধে দিলেন তাকে। এরপর কল্যাণী বিশ্ববিদ্যালয় অঙ্কে স্নাতকোত্তর পড়াশোনা করে ট্রান্সজেন্ডার হিসেবে প্রথম অঙ্কে গোল্ড মেডেল পান সুমনা। তিনি জানান তার নাম প্রথম সুপারিশ করেন ওপর এক সফল রূপান্তরকারী অধ্যাপিকা মানবী বন্দ্যোপাধ্যায়।
স্নাতকোত্তর স্তরে পড়াশোনা শেষ করার পর বিএড করে তিনি। ২০১৯ সালে শুরু হয় সেট পরীক্ষা দেওয়া এবং দীর্ঘ পাঁচ বছরের প্রচেষ্টায় সম্প্রতি উত্তীর্ণ হন এবং এর সঙ্গেই গত এক বছরে বেশি সময় ধরে তিনি গেস্ট লেকচারার হিসেবে একটি কলেজে শিক্ষকতা করেন। পড়াশোনাই শুধু নয়, তার সঙ্গে তার হাতের কাজও অত্যন্ত সুনিপুণ। মাটির মূর্তি বানাতে তিনি সিদ্ধ হস্ত। ট্রান্সজেন্ডার হিসেবেই একদিনের জন্য লোক আদালতে বিচারকের পদ পেয়েছিলেন সুমনা।
সুমনা বলেন, “রূপান্তরকামী মানেই যে তারা শুধু সিগনালে কিংবা ট্রেনে বাসে তাহলে বাজিয়ে ভিক্ষে করবে সেই ধারণাকে নিঃশেষ করতেই আরও অনেকটা পথ আমি হাঁটতে চাই। অত্যন্ত গ্রাম শহরে তৃতীয় লিঙ্গের অনেক মনই হয়তো সুমন থেকে সুমনা হতে চাইছে । তাদের পড়াশোনা কিংবা আর্থিকভাবে স্বনির্ভর হওয়াটা ভীষণ জরুরি।”
Mainak Debnath