যখন আমরা জীবনের তুচ্ছ অসুবিধা গুলো নিয়ে অভিযোগ করতে থাকি আর নিজেদের ব্যর্থতার স্বপক্ষে অজুহাত খুঁজতে থাকি, তখন কিছু মানুষ আমাদের চোখ খুলে দেন, যাদের দেখে আমরা ভাবতে বাধ্য হই যে, আমাদের অসুবিধা বা অজুহাত গুলো কি আদৌ যথাযথ ? এই মানুষদের মধ্যেই একজন হলেন নদিয়ার কৃষ্ণনগরের ৪৩ বছরের শিক্ষক অরুণাংশু জেমস বিশ্বাস (Arunangshu James Biswas) ৷ মাত্র ১১ মাস বয়সেই পোলিওয়ে আক্রান্ত হয়ে শরীরের ৮৫ শতাংশ অচল হয়ে পড়লেও জীবন যুদ্ধে হার মানেননি তিনি ৷ প্রবল শারীরিক কষ্ট, অক্ষমতা জনিত অনেক অসুবিধা ও বাধাবিঘ্নকে অতিক্রম করে জীবনের দৌড়ে আর পাঁচটা সুস্থ মানুষের পায়ে পা মিলিয়ে এগিয়ে চলেছেন ৷
advertisement
যে মানুষটিকে তাঁর শিক্ষা জীবনের শুরুতে বিকলাঙ্গতার কারণে একটি খ্যাতনামা ইংরেজি মাধ্যম শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ভর্তি নিতে অস্বীকার করেছিল, সেই মানুষটি নিজেই আজ একজন শিক্ষক ৷ শিক্ষকতার পাশাপাশি তিনি একজন সঙ্গীত শিল্পী, লেখক এবং সমাজ সেবী ৷ বর্ধমান বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইতিহাস নিয়ে স্নাতোকত্তর পাশ করার পর একটি ডায়াগনস্টিক সেন্টারের ব্যবসা শুরু করেন ৷ এর পাশাপাশি চলে সমাজসেবা ও সঙ্গীত চর্চা ৷ দুস্থ ছাত্র-ছাত্রীদের তিনি বিনামূল্যে পড়ানো শুরু করেন এবং যে সমস্ত দরিদ্র পরিবারের ছেলেমেয়েদের পয়সা খরচ করে সংস্কৃতি চর্চা করার সামর্থ্য নেই, তাদের নিয়ে তৈরি করেন একটি সাংস্কৃতিক দল ৷ যেখানে তাদের নাচ, গান এবং নাটক শেখানো হয় ৷
এই সংস্কতি চর্চা থেকেই একসময় তাঁর মাথায় বাংলা ব্যান্ড তৈরির পরিকল্পনাও আসে ৷ অরুণাংশুবাবুর ছাত্র-ছাত্রীরা কয়েকজন বাংলা গানের ব্যান্ড ৷ নাম দেন ‘ডেসপেরাডো’ অর্থাৎ বেপরোয়া ৷ জীবনের এত বড় প্রতিবন্ধকতাকে কোনওরকম পরোয়া না করে যে এভাবে এগিয়ে চলে, তার পক্ষে এরকম একটা নাম দেওয়া যথাযথ ৷ সেই ব্যান্ডের কনসার্ট থেকে উপার্জিত টাকার একটা বড় অংশ অরুণাংশুবাবু খরচ করতে বিশেষ চাহিদা সম্পন্ন শিশুদের জন্যই ৷ একসময়ে তাঁর নিজের লেখা, সুর দেওয়া গানগুলি নিয়ে কলকাতার এক মিউজিক সংস্থা একটি অডিও অ্যালবামও প্রকাশ করে ৷ যার নাম ‘কলেজ ক্যাম্পাস’ ৷
আরও পড়ুন-৫০ হাজার টাকা বিনিয়োগে প্রতি মাসে ১ লাখ টাকা আয় এই ব্যবসায়; সরকারের তরফেও মিলবে ভর্তুকি!
এরপর দুস্থ ছাত্র-ছাত্রীদের পড়াতে পড়াতেই তিনি উপলব্ধি করেন যে, একজন শিক্ষক হয়েই তিনি ছাত্র-ছাত্রীদের প্রকৃত অর্থে গড়ে তুলতে পারবেন ৷ তাই তিনি ব্যবসা ছেড়ে দেন ৷ শিক্ষকতার পরীক্ষার জন্য প্রস্তুতি নিতে শুরু করেন এবং পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন ৷ তারপর সরকারি অনুদানে নির্মিত একটি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে সহকারী শিক্ষক হিসেবে নিযুক্ত হন ৷ স্কুলে চাকরি করার সময়েই শিক্ষকতার প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেন ৷ শিক্ষকতার পাশাপাশি তিনি সংস্কৃতি চর্চা, সমাজ সেবা এবং সাহিত্য চর্চা করতে থাকেন ৷ তাঁর লেখা গল্প, প্রবন্ধ এবং প্রচ্ছদ বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায় প্রকাশিত হতে থাকে ৷ ‘রোদ্দুর’ নামে একটি সমাজসেবামূলক দলও গড়েন এবং প্রতিবন্ধী ও বৃদ্ধ-বৃদ্ধাদের সেবায় ব্রতী হন ৷ ২০১৫ সালে সঙ্গীতে অসাধারণ পারদর্শীতা এবং রোল মডেল সম্মানে রাজ্য সরকারের পক্ষ থেকে পুরস্কার পান অরুণাংশু জেমস বিশ্বাস ৷