ডুলুং নদীর পাড়ে মুঘল ও ব্রিটিশদের মিলিত স্থাপত্য শৈলীতে তৈরি দোতালা এই রাজবাড়ির দেওয়ালে রয়েছে বাংলা রীতির শিল্পকলার ছাপ। ঝাড়গ্রাম শহর থেকে মাত্র ১৩ কিলোমিটার দূরে এই চিল্কিগড় রাজবাড়ি। প্রধান রাস্তার উপরেই রয়েছে প্রবেশের বড় তোরনদ্বার। রয়েছে একটি বিশাল পুরোনো অশ্বথ গাছ। রাজবাড়ির চত্বরের মধ্যে রয়েছে তিনটি জীর্ণকায় মন্দির। এর মধ্যে সবথেকে বড় নবরত্ন রাধা কৃষ্ণের মন্দির।
advertisement
পর্যটকদের দাবি, ইতিহাস সমৃদ্ধ এই স্থানগুলিকে সংরক্ষণ করা হোক। কথিত আছে, জঙ্গলমহলের রাজা ছিলেন গোপীনাথ সিং মত্তগজ। তাঁর রাজ্যের নাম জাম্বনি, যার রাজধানী চিলকিগড়। ডুলুং নদীর পশ্চিম তীরে অবস্থিত তাঁর প্রাসাদ। গবেষক ড. মধুপ দে বলেন অষ্টাদশ শতকের মাঝামাঝি চিলকিগড়ের সামন্ত রাজা গোপীনাথ সিংহ তার ৩ রাণীর হাতের কাঁকন দিয়ে তৈরি করেন দেবী কনকদুর্গার মূর্তি৷ চতুর্ভুজা এই দেবী অশ্ববাহিনী৷ বাঁদিকের দুই হাতে রয়েছে খর্পর ও অশ্বের লাগাম৷ ডানহাতে খড়্গ ও বরাভয়৷ অলঙ্কারে সজ্জিত দেবীর গায়ে ছিল নীল বস্ত্র৷
১৯৬০ সালে আসল মূর্তিটি চুরি হয়ে যায়৷ ১৯৯৬ সালে গোপীনাথের বংশধররা অষ্টধাতুর কনকদুর্গার একটি রেপ্লিকা মন্দিরে প্রতিষ্ঠিত করেন৷ গোপীনাথ সিংয়ের ছিল ৪ পত্নী। রাণী গোবিন্দমনি, চম্পামনি, ঠাকুরমনি ও দুর্গামনি। চার রানির মধ্যে একমাত্র চম্পামনির একটি কন্যা সন্তানের জন্ম হয়, যার নাম সুবর্ণমণি। রাজার কোনও পুত্রসন্তান ছিল না। পার্শ্ববর্তী ধলভূমগড়ের রাজা ছিলেন জগন্নাথ দেও ধবলদেব।
সপ্তম রাজা জগন্নাথের সঙ্গে বিয়ে হয় চিলকিগড়ের রাজার মেয়ে সুবর্ণমণির। সুবর্ণমণি হলেন জগন্নাথের তৃতীয় স্ত্রী। ফলে জামবনি রাজ্যের সঙ্গে ধলভূমগড় রাজ্যের যোগসূত্র তৈরি হল। গোপীনাথ সিং মারা যান ১৭৬৫ সালে। তাঁর চিতায় ‘সতী’ হয়ে প্রাণত্যাগ করেন দুই রাণী, চম্পামনি ও ঠাকুরমনি। অন্য দুই রানির মধ্যে, গোবিন্দমনি মারা যান ১৮১৮ সালে। ১৮২২ সালে মেদিনীপুর ডিস্ট্রিক্ট কোর্টে একটি মামলার আদেশ অনুযায়ী চিলকিগড়ের উত্তরাধিকারী হন ধলভূমগড়ের সুবর্ণমনির পুত্র অর্থাৎ গোপীনাথের দৌহিত্র, কমলাকান্ত দেও ধবলদেব।
আরও পড়ুন- কালীপুজোর রাতে ১০৮ প্রদীপে আরতি হয় মা চণ্ডীর! পুজো শেষে ভোগ খেয়ে বাড়ি ফেরা
তাঁর সময়কেই বলা হয় চিলকিগড়ের স্বর্নযুগ বলে মনে করা হয়। তিনি শিল্প সংস্কৃতির ব্যাপারে অত্যন্ত উৎসাহী ছিলেন। চিলকিগড়ের শেষ রাজা ছিলেন জগদীশচন্দ্র । তিনি বিয়ে করেছিলেন ত্রিপুরার রাজকন্যা তড়িৎপ্রভা দেবীকে। তাঁদের ছিল ৭ পুত্র ও ৬ কন্যা। জগদীশচন্দ্রের সঙ্গে সঙ্গেই চিলকিগড়ের রাজত্বের অবসান হয়। তবে এই রাজবাড়ীর সঙ্গে আরও একটি ইতিহাস জুড়ে আছে ওতপ্রোতভাবে। ঐতিহাসিক চুয়াড় বিদ্রোহ চলাকালীন রাজা জগন্নাথ সিংহ এই চিল্কিগড় রাজবাড়ি থেকেই ১৭৬৯ সালে ধল বিদ্রোহের ঘোষণা করেন। বিদ্রোহ সংঘটিত হলেও ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি কড়া হাতে এই বিদ্রোহ দমন করতে সফল হয়।