সন্ধ্যায় বর্ধমানের টাউন হল (Bardhaman Town Hall) গেট ও দুপুরে জেলাশাসকের দফতরের সামনে দেখা মিলবে সুনীতার (Sunita Chowdhury)। বাজেপ্রতাপপুরের বাসিন্দা, বছর চৌত্রিশের সুনীতার বরাবরেরই সঙ্গী লড়াই। উদয়চাঁদ মহিলা কলেজ থেকে স্নাতক হওয়ার পরে রাঁচিতে বিয়ে হয় তাঁর। তবে সংসার সুখের হয়নি। সুনীতার অভিযোগ, বিয়ের পর থেকেই নির্যাতন করত শ্বশুরবাড়ির লোকজন। শেষ তিন-চার বছর তা মাত্রা ছাড়ায়। অভিযোগ, প্রায় দিনই মত্ত অবস্থায় রাতে বাড়ি ফিরে স্বামী মারধর করতেন তাঁকে। তিন মাস আগে ন’বছরের মেয়েকে নিয়ে শ্বশুরবাড়ি ছেড়ে বর্তমানে বাপের বাড়িতে ফেরেন।
advertisement
আরও পড়ুন: সৌজন্যে সামাজিক মাধ্যম, ১৪ বছর পর হারিয়ে যাওয়া মানসিক ভারসাম্যহীন ছেলেকে খুঁজে পেল পরিবার
হতাশ হয়ে বসে না থেকে সুনীতা লিখছেন জীবন সংগ্রামের গল্প। হার না মানার মানসিকতা নিয়ে লড়াইটা চালাচ্ছেন, লোকলজ্জার বেড়াজাল ভেঙে বেরিয়ে পড়েছেন সাইকেল নিয়ে। পথচলতি মানুষকে খাওয়াচ্ছেন নিজের হাতে তৈরি দইবড়া।
বাড়িতে ন'বছরের ছোট্ট মেয়ে। তৃতীয় শ্রেণীতে পড়ে। কিন্তু স্কুল বন্ধ। অগত্যা বাড়িতে ছোট্ট মেয়েকে রেখেই প্রতিদিন সকাল হলে বেরিয়ে পড়েন বাজেপ্রতাপপুরের বিএসসি পাশ সুনীতা চৌধুরী।
আরও পড়ুন: কুকুরের সঙ্গে খাবার ভাগ করে খাচ্ছেন ভবঘুরে মহিলা, ভিডিও ভাইরাল হতেই পদক্ষেপ প্রশাসনের
মাথা গোঁজার ঠাঁই মিলেছিল বাপের বাড়িতে। কিন্তু ছোট্ট মেয়ের খাওয়া দাওয়া, পড়াশুনার খরচ? নিজেই বেরিয়ে পড়েন বাঁচার তাগিদে। শুরু করেন নিজে হাতে তৈরি দইবড়া বিক্রি। একেবারে ঘরোয়া স্বাদের দইবড়া। যা খেতে তাঁর সাইকেল ঘিরে ধরে সাধারণ মানুষ। প্রতিদিন বিক্রিও হয় ভালই। দিনের শেষে তিনশো থেকে চারশো টাকা নিয়ে বাড়ি ফেরেন তিনি। এতে কোনওরকম দিন চলে যায় মা ও মেয়ের।
শ্বশুরবাড়ি থেকে নতুন ভাবে এই জীবন শুরু করার জন্য সমাজের ট্যারা চোখের চাউনি কম সহ্য করতে হয়নি তাঁকে! প্রতি পদে লড়াই চালিয়ে গিয়েছেন টিকে থাকার। সমাজের কটু কথার ভ্রূক্ষেপ না করে তিনি আজ 'যোদ্ধা'।
আরও পড়ুন: ১ জানুয়ারি কল্পতরু উৎসবে বন্ধ থাকছে বেলুড় মঠ, ভিড় এড়াতে সিদ্ধান্ত কর্তৃপক্ষের
তিনি বলেন, ‘‘সমাজের দিকে চেয়ে বসে থাকলে আমার চলবে না। আমার সঙ্গে ছোট্ট মেয়ে আছে। তার ভবিষ্যৎ আছে। তাই আমার লড়াইটা আমাকে একাই লড়তে হবে।’’ বর্ধমান শহরে একমাস যাবৎ এইভাবেই জীবন সংগ্রামকে লিপিবদ্ধ করছেন সুনীতা।
সকালে উঠে ঘরের কাজের পাশাপাশি, দই বড়ার নানা সরঞ্জাম জোগাড় করতে হয় তাঁকে। তারপর বেলা হলেই শহরে সাইকেল নিয়ে বেরিয়ে পড়েন তিনি। সারাদিন শহরের আনাচে কানাচে ঘুরে বেরিয়ে বেড়িয়ে পথচলতি মানুষকে খাওয়াচ্ছেন দইবড়া। দিনের শেষে বাড়ি ফিরেও স্বস্তি নেই। আবার ঘরের কাজ, মেয়ের পড়াশুনা সব নিয়েই দিন কাটে তাঁর। সুনীতা দেবীর এই লড়াইকে কুর্নিশ জানাচ্ছে শহরবাসীও।
সুনীতার কথায়, ‘‘বাড়িতে মেয়ে আছে। মেয়ের লেখাপড়া আছে। এখন আমিই ওর মা, আমিই ওর বাবা। ওর কথা ভেবেই আমার এই পথচলা। বহু মানুষ আমার থেকে দইবড়া খেয়ে যান। তারা আবার তার বন্ধুদের নিয়ে আসেন। কেউ আবার খাওয়ার পর তা বাড়িতেও নিয়ে যান। এমনও ক্রেতা আছেন যাঁরা রোজ এসে খেয়ে যান। এতে সারাদিন যা উপার্জন হয় তাতে আমার আর মেয়ের দিন চলে যায়। আগে টাউন হলে টেবিল নিয়ে বসতাম। তারপর আমি নিজেই এই সাইকেলের ব্যবস্থা করি। এখন সাইকেল নিয়েই ঘুরে ঘুরে মানুষকে দইবড়া খাওয়াই।’’