মিত্র সম্মিলনীর ইতিহাস:
কোনও বড় পুজো হোক কিংবা কোনও বাড়ির পুজো। সবই বহন করে এক ইতিহাস, যা অনেকের কাছেই অজানা। ১৯০৯ সালে শিলিগুড়ির ব্যস্ত হিলকার্ট রোডের ধারে তৈরি হয়েছিল মিত্র সম্মিলনী। বন্ধুর সমার্থক শব্দই 'মিত্র'। সেই থেকেই এই নাম। প্রতিষ্ঠাতা ও সাধারণ সম্পাদক ছিলেন সুরেন্দ্রনাথ ভট্টাচার্য। রাজ্যের প্রয়াত প্রাক্তন প্রধান বিচারপতি আনন্দময় ভট্টাচার্যের দাদু ছিলেন সুরেন্দ্র ভট্টাচার্য। প্রায় ১১২ বছর আগের শিলিগুড়ির কাছে এটা ছিল মহামিলনের ক্ষেত্র। কিন্তু তখন নাম ছিল, 'ফ্রেন্ডস অফ ইউনিয়ন'।
advertisement
১৪ কাঠা জমির উপর শুরু হয় ক্লাবের কাজ। তবে জমি দেওয়ার সময় কিছু শর্ত রেখেছিলেন সুরেন্দ্রবাবু। শর্ত হল, প্রতি বছর সরস্বতী পুজো ও দুর্গাপুজো এখানেই করতে হবে। কয়েকটি উদ্দেশ্য নিয়েই এই মিত্র সম্মিলনী তৈরি। ইন্ডোর গেমস (indoor games), অভিনয়, সাহিত্য চর্চা, পত্রপত্রিকা পরিচালনা এবং অন্যান্য সামাজিক উন্নয়নমূলক কাজকে গুরুত্ব দিয়ে শিলিগুড়িবাসীর জন্য তৈরি হয় মিত্র সম্মিলনী। শিলিগুড়িকে সাংস্কৃতিক ও সামাজিক দিকে এগিয়ে রাখতে উদ্যোগী ছিলেন সদস্যরা।তখনকার দিনে শিলিগুড়িতে মিত্র সম্মিলনীর নাটক বিখ্যাত ছিল। প্রয়াত নকশাল নেতা চারু মজুমদার এক সময় মিত্র সম্মিলনীতে নাটক করেছেন। বিশের দশকে ‘সীতা’ নাটক করতে এখানে এসেছিলেন শিশির ভাদুড়ি। অনেক প্রতিভাবান ব্যক্তিত্ব এখানে পা রেখেছিলেন।
আরও পড়ুন: পুজোয় একেবারে নিরিবিলি কোথাও বেড়াতে যেতে চান? ঘুরে আসুন পলাশবাসিনি-দ্বারবাসিনী মন্দির
প্রচুর ছোট ছোট ঘটনা ও ইতিহাস জড়িয়ে রয়েছে এই জায়গার সঙ্গে। স্মৃতি ঘেঁটে দেখলেন মিত্র সম্মিলনীর সাধারণ সম্পাদক অশোক ভট্টাচার্য। সেই স্মৃতির পাতা উল্টে-পালটে তিনি জানান, ১৯০৯-১৯১০ সালের মাঝে দুর্গা পুজোর সময় তেমনভাবে পুজো না হলেও নাটক হত। তখন 'রাজা হরিশচন্দ্র' নামক একটি নাটক মঞ্চস্থ হয়েছিল। সেসময় খুঁটি গেড়ে ত্রিপল দিয়ে প্যান্ডেল হত। কিন্তু হঠাৎ দারুণ ঝড়-বৃষ্টিতে নাটকটি পন্ড হয়ে যায়। মন খারাপ হয়ে যায় সবার। তবে, পরবর্তীকালে কোনও এক সময় সেই নাটকটি মঞ্চস্থ হয়। মঞ্চস্থ হওয়ার প্রায় ১০০ বছর পর, ২০১৪ সালে দীনবন্ধু মঞ্চে আবার এক নাটক অভিনয় করা হয়। অভিনেতারা কলকাতা থেকে নাটকের স্ক্রিপ্ট (script) ও বই নিয়ে এসে নাট্য পরিচালক ব্যোমকেশ ঘোষের নেতৃত্বে অনুশীলন করেন। আড়াই ঘন্টা ধরে চলে সেই নাটকটি।
প্রথম মূর্তি তৈরি করেন ব্যোমকেশ পাল। তিনি কৃষ্ণনগর থেকে এসে কাজ করেন। বর্তমানে সম্মিলনীর পাশে একটি নাট মন্দির ছিল। সেখানে তিনি প্রতিমা তৈরি করতেন। তারপর সরস্বতীর প্রতিমা তৈরি করে তিনি নিজের দেশের বাড়িতে চলে যেতেন। ফের একবছর পর তিনি এসে প্রতিমা গড়তেন। তাই তো এখনও এক ডাকেই সক্কলে চেনে শিলিগুড়ির 'মিত্র সম্মিলনী'।
কবে শুরু হয়েছিল পুজো?
৯৫ বছর আগে ১৯২৬ সালে মাত্র ৪০ জন নিয়ে পুজো শুরু হয়েছিল। এখন সেই সদস্য সংখ্যা বেড়ে দাঁড়িয়েছে দু'শতে। বর্তমানে পুজোর পরিচিতি শহর পেরিয়ে জেলা ও রাজ্যে ছড়িয়েছে। বর্ধমানের মৃৎশিল্পীরা ডাকের সাজের প্রতিমা গড়ে দিতেন শিলিগুড়ির এই ক্লাবের জন্য। সেই সময় পুজোর তিনদিন শহর চা বাগানের মানুষ স্বপরিবারে প্রতিমা দর্শন ও নাটক দেখতে আসতেন এখানে। প্রবীণদের মুখে শোনা যায়, অনেকেই নাকি মোষের গাড়িতে চেপে চা বাগান থেকে এই পুজো দেখতে আসতেন। সপ্তমী ও নবমীর রাতে বিনা টিকিটে ডে লাইট ঝুলিয়ে নাটকও মঞ্চস্থ করা হত। এককথায় জমে যেত মিত্র সম্মেলনির আয়োজন।
মিত্র সম্মিলনীর সাধারণ সম্পাদক জানান, সেই সময় টয়ট্রেন (toy train) চলত হিলকার্ট রোড ধরে মিত্র সম্মিলনীর সামনে দিয়ে। পরবর্তীতে টয়ট্রেন (toy train) করে মিত্র সম্মিলনী থেকে প্রতিমা তোলা হতো এবং মহানন্দা ব্রিজের কাছে গিয়ে প্রতিমা নামিয়ে নিরঞ্জন করা হত। এমনই ইতিহাস বহনকারী শিলিগুড়ির এই মিত্র সম্মিলনীর। বর্তমানে নীলনলিনী বিদ্যামন্দিরের বেলতলায় ষষ্ঠী পুজো হয়। সপ্তমী, অষ্টমী, নবমী ও দশমী মণ্ডপেই পুজো হয়। দশমীর দিন রাত ১২ টার পর আর প্রতিমা মণ্ডপে রাখা হয় না। ১২ টার পরপরই প্রতিমা বের করে বিসর্জনের ব্যবস্থা করা হয়। সপ্তমী থেকে নবমী দুবেলা ভোগ পান মা। এক ব্রাহ্মণ মহিলা এসে মায়ের ভোগ তৈরি করে দিয়ে যান। লুচি পায়েস ভোগ তো হয়। এছাড়াও বৈকালিক একটা আয়োজন হয়। সেখানে থাকে লুচি ও পাঁচরকমের ভাজা এবং হালুয়া। গতানুগতিক ভাবেই চলে আসছে এই প্রথা।
আরও পড়ুন: পুজোয় একেবারে অন্যরকম বেড়ানোর প্ল্যান চান? ডেস্টিনেশন হোক 'মৌসুনি দ্বীপ'
মিত্র সম্মিলনী সাধারণ সম্পাদক অশোক ভট্টাচার্য বলেন, 'বর্তমানে এই কোভিড পরিস্থিতিতে সবকিছু পালটে গেলেও পাল্টায়নি সাবেকিয়ানা। তাই শিল্পী উমেশ পালকে দিয়ে আমরা সাবেকি প্রতিমা বানিয়েছি কয়েকবছর। তবে এবার আমরা তাঁকে দিতে পারছি না, কারণ ওঁর কারখানা নেই, নাট মন্দিরও খুব নোংরা হয়ে পড়ে। তাই কারখানা থেকেই আনাব।' কাঠাম পুজো প্রসঙ্গে বলেন, 'গত ১০-১২ বছর আগে কাঠাম পুজো শুরু হয়েছে। এর আগে হত না। আগে মৃৎশিল্পীরা যেমন বানাতেন তেমনি আসত। রথযাত্রার দিন কাঠাম পুজো শেষ হওয়ার পর মৃৎশিল্পীরা সেটা নিয়ে গিয়ে প্রতিমা বানানোর সময় ব্যবহার করেন।'
অনেকের মুখে শোনা গিয়েছে, এই মিত্র সম্মিলনীতে নাকি একাধিক গুণীজনের পায়ের ধুলো পড়েছিল। সংস্কৃতি চর্চা ছিল সম্মিলনীর মূলমন্ত্র ও পীঠস্থান। এছাড়াও সেসময় শহরকে সামাজিকগত দিক থেকে উন্নত করা ছিল এখানকার সদস্যদের উদ্দেশ্য। মিত্র সম্মিলনীর সহ-সাধারণ সম্পাদক দেবাশীষ ঘোষ বলেন, 'প্রাক-স্বাধীনতা আমল থেকেই এখানে নাটক হত। তখন এত জনবসতি ছিল না শিলিগুড়িতে। শহর হিসেবেও তেমন স্বীকৃতি লাভ করেনি তখনকার শিলিগুড়ি। ছিল চা বাগান ঘেরা এলাকা। রাতে নাটক হত। মোষের বা গরুর গাড়ি করে চা বাগানের বাবুরা আসতেন। তখন ক্ষুদিরামপল্লির এখানে একটা মাঠ ছিল। এখন সেটা অবশ্য নেই। সেখানে সেই গাড়ি রাখার ব্যবস্থা হত। ভোরবেলা যখন নাটক শেষ হত, তখন তাঁরা বাড়ি ফিরে যেতেন।'
আরও পড়ুন: আলমারি থেকে নেমেছে শাড়ি-পাঞ্জাবি, মা দুর্গার আরাধনায় কোমর বাঁধছেন অস্ট্রেলিয়ার পার্থের বাঙালিরা
তিনি আরও বলেন, 'কয়েকটি নাটক; যেমন সীতা, লব, কৃষ্ণ এই নাটকগুলির নাম আমি শুনেছিলাম। সময় কথা বলে। সেসময় বিনোদন বলতে তো আর সোশ্যাল মিডিয়া বা, অন্যকিছু ছিল না! ছিল নাটক। নাটকটাই ছিল তখনকার মানুষের বিনোদনের জায়গা। সবাই এতটাই নাটক ভালোবাসতেন সেসময়, যে গরুর গাড়ি, মোষের গাড়ি নিয়ে দূর-দূরান্ত থেকে চলে আসতেন। গাড়ি বলতে তখন এটাই ছিল এখানে। তাঁদের চাহিদা ছিল রাত ১১টার সময় খাওয়া-দাওয়ার পর নাটক শুরু করত্র হবে। সারারাত টানতে হবে। হ্যাজাকের আলোতে নাটক হত।'
এ প্রসঙ্গে মিত্র সম্মিলনীর সামাজিক সম্পাদক প্রদীপ কুমার সরকার ওরফে গোপাল বলেন, 'আমাদের এই পুজো টানা ৯৫ বছর ধরে হয়ে আসছে। সরস্বতী পুজো দিয়েই আমাদের এই পুজো শুরু হয়। সেই থেকে আজ পর্যন্ত একবারও বন্ধ হয়নি পুজো। সরস্বতী পুজো ১১৩ বছর ধরে হয়ে আসছে। সেই সরস্বতী পুজোর দিনই আমাদের প্রতিষ্ঠা দিবস। সেদিন মিত্র সম্মেলনির পতাকা উত্তোলন করা হয়। সেই ধারা এখনও বজায় রয়েছে। তবে যুক্ত হয়েছেন অনেক নতুন সদস্য।'
এভাবেই ইতিহাস বহন করে আসছে মিত্র সম্মিলনী। মিত্র সম্মিলনী অর্থাৎ বন্ধুদের মিলনস্থল শহরের বুকে এমন এক ঐতিহাসিক ও আভিজাত্য সম্পন্ন হলঘর রয়েছে, যা এককালে গমগম করত গুণীদের সমাগমে। পুরোনো মানুষগুলো না থাকলেও আজও সেই নিয়মের পুজো বহাল রয়েছে। শুধু নেই সঙ্গে বিনোদন, সমাগম ও নাটক। পুরোনো সেই মিত্র সম্মিলনীর উপভোগ আমরা করতে পারি বা না পারি, এই ইতিহাস চিরকাল বহাল থাকবে শিলিগুড়ির বুকে!
ভাস্কর চক্রবর্তী