কুমার মৃদুল নারায়ণের ইতিহাস থেকে জানা যায়, বিশ্ববীর চিলা রায় (১৪৩২শক,৯১৫বঙ্গাব্দ ) মাঘ মাসের পূর্ণিমা(১৫১০খ্রী )তিথিতে মহারাজা বিশ্বসিংয়ের পত্নী পদ্মাবতীর গর্ভে (দরং বংশাবলিতে উল্লেখিত) সুদাগ্নির গর্ভে (গন্ধর্বনারায়নের বংশাবলিতে উল্লেখিত ) জন্মগ্রহণ করেন । তার প্রকৃত নাম ছিল শুক্লধ্বজ। ছোট বেলা থেকেই তিনি যুদ্ধবিদ্যায় পারদর্শী ছিলেন , ব্যাকারণ , সাহিত্য , জোতিষ, শ্রুতি , স্মৃতি , ন্যায় , মীমাংসা , প্রভৃত বিষয়ে তার ছিল অগাধ পাণ্ডিত্য।মহারাজা বিশ্বসিংহ রাজকুমার মল্লদেব(নরনারায়ণ) ও শুক্লধজ(চিলারায়) এর প্রখর বুদ্ধি ও শক্তির প্রাচুর্য দেখে এই দুই পুত্রকে নিজেদের দায়িত্বশীল করে তুলতে বারানসী পাঠান ব্রহ্মানন্দ বিশারদ এর কাছে।জ্যেষ্ঠ পুত্র নরসিংহ মহারাজার অত্যন্ত স্নেহভাজন ছিলেন।
advertisement
কথিত আছে অতিরিক্ত স্নেহের কারণে তাকে বিদেশে না পাঠিয়ে রাজধানীতেই নানারকম শিক্ষার ব্যবস্থা করেছিলেন মহারাজ। ১৫৩৩খৃস্টাব্দে মহারাজ বিশ্বসিংহর মৃত্যু হলে তার জেষ্ঠপুত্র নরসিংহ সিংহাসনে বসলে গৃহবিবাদ শুরু হয় এবং চিলা রায় তার প্রিয় ভ্রাতা নরনারায়ণের পক্ষ অবলম্বন করে নরসিংহকে কামতাপুর থেকে বিতাড়িত করেন । নরনারায়ণ সিংহাসনে বসলে তিনি তার প্রধান সেনাপতি হিসাবে নিযুক্ত হন এবং রাজঅভিষেক হওয়ার সময় রাজকুমার চিলারায় সংগ্রাম সিংহ উপাধিতে ভূষিত হন । দায়িত্ব পেয়েই চিলারায় রাজ্যের রক্ষণাবেক্ষণ ও সম্প্রসারণে গুরুত্ব দেন । বিশ্বসিংহের সময় থেকেই পাশের রাজ্যে অহমের সাথে Coochbehar রাজ্যের তিক্ততার সম্পৰ্ক ছিল । নরনারায়ণের সময়ে যা চরম আকার ধারণ করে , ফলে যুদ্ধ শুরু হয় এবং দীর্ঘবছর যুদ্ধ চলার পর ১৫৬৩খৃস্টাব্দে অহমরাজ শোচনীয় ভাবে পরাজিত হন । অহম যুদ্ধে শুক্লধ্বজ বিরাট সামরিক দক্ষতার পরিচয় দেন । এক সময়ে ভরলা নদী অশ্বারোহনে লাফ দিয়ে পার হন এবং চিলের মতো তীব্র গতিতে শত্রু পক্ষের উপর ঝাঁপিয়ে পড়তেন বলে "চিলা রায়"অবিধায় ভুষিত হন ।
আরও পড়ুন: হুড়হুড় করে ঢুকল গাড়িটি, আরোহীর শরীরে 'চিপ', অজিত ডোভালের বাড়িতে মারাত্মক কাণ্ড
ফ্রান্সের ঐতিহাসিক আর্নল্ড টয়েনবি মতে, পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ তিনজন বীরের নাম তিনি উল্লেখ করেছিলেন,নেপোলিয়ান, ছত্রপতি শিবাজী এবং চিলা রায় । এদের মধ্যে তিনি শ্রেষ্ঠবীর হিসাবে চিলারায় এর নাম উল্লেখ করেছেন ।"
অহম রাজ্য বিজয়ের পর চিলারায় একে একে পাহাড়ি রাজ্য কাছাড় , মনিপুর , জয়ন্তীয়া , শ্রীহট্ট, ত্রিপুরা জয় করে বঙ্গোপসাগরের তটভূমি পর্যন্ত নরনারায়ণের সম্রাজ্যেভুক্ত করেন । কাছাড়ের রাজা হরমেশ্বর চিলারায়কে প্রথমে বাধা দেওয়ার চেষ্টা করলেও চিলা রায়ের ক্ষিপ্রগতিতে চাবুকের আঘাতে রাজধানীর দরজা খুলে দেওয়ার কান্ড দেখে ভয় পেয়ে গেলেন এবং কাল বিলম্ব না করে আনুগত্য স্বীকার করলেন ।উপঢৌকন হিসেবে বাৎসরিক ৭০০০০ রৌপ্য মুদ্রা,১০০০স্বর্ণমুদ্রা,৬০টি হস্তী দিতে স্বীকৃত হলেন। মনিপুরের রাজা পরাক্রমশালী এই বীরকে বাধা দেওয়ার ক্ষমতা না থাকায় তৎক্ষনাত তার বশ্যতা স্বীকার করেন। তিনি রাজস্ব হিসেবে ২০০০০রৌপ্য মুদ্রা, ৩০০ স্বর্ণমুদ্রা এবং ১০টা হস্তী দিতে স্বীকৃত হয়েছিলেন ।ত্রিপুরারাজের সঙ্গে সরাসরি যুদ্ধ হয় এবং কথিত আছে যে, ত্রিপুরারাজ চিলা রায়ের হাতেই নিহত হয়েছিলেন।উপঢৌকন হিসেবে মৃত রাজার ভাই ১০০০০রৌপ্য মুদ্রা,১০০স্বর্ণ মোহর,৩০টি যুদ্ধের ঘোড়া প্রেরণ করেছিলেন কামতাপুর রাজ্য ।ঘৈরাকরাজ বীর্যবন্ত মহারাজ নর-নারায়ণ এবং চিলা রায়ের পরাক্রম সংবাদ শুনিয়া তার পরিণতির কথা ভেবে কালবিলম্ব না করে বশ্যতা স্বীকার করলেন ।তিনি রাজস্ব হিসেবে দিয়েছিলেন ১৫০০০ রৌপ্য মুদ্রা,৯০০স্বর্ণ মুদ্রা,৫০টি অশ্ব,৩০টি হস্তী।
শুধু তাই নয় তিনি এমনোও কথা দিয়েছিলেন যে,মহারাজ নর-নারায়ণর নামাঙ্কিত ব্যতিরেকে অন্য কোন মুদ্রা তিনি নিজের নামে করবেন না।পরাক্রমশালী চিলারায় এই বিজয় রথ চলতেই থাকে ।পরবর্তী বিজয় বিচারে তিনি ডিমুরিয়ার রাজাকে বন্দী করলেন এবং ৭০০০ মুদ্রা রাজস্ব হিসেবে দিতে স্বীকৃতি হওয়ায় তাঁকে মুক্তিও দিলেন । নরনারায়ণের সময় কালেই কামতাপুরের উপর কালাপাহাড়ের ঝটিকা আক্রমণে বিরাট ক্ষতি হয় , বহু মন্দির ধংস হয় , এর পরিপ্রেক্ষিতে নরনারায়ণ ও চিলা রায় গৌড় আক্রমণ করেন,কিন্তু সফলতা পান নি ।চিলা রায়ের নেতৃত্বে গৌড় অভিযানে দশদিন যুদ্ধের পর গৌড়ের পাশার নিকট তারা পরাজিত হন ।যদিও এই যুদ্ধে তিনি অসীম বীরত্বের পরিচয় দিয়েছিলেন । এই যুদ্ধে পরাজয়ের পর চিলারায় বন্দী হন এবং পরবর্তীতে সন্ধির মাধ্যমে মুক্তি পান।
আরও পড়ুন: 'এখন অন্য হাওয়া', এসেছিল বার্তা, কেন বিজেপি-তে যোগ দিয়েছিলেন বাপ্পি লাহিড়ি?
মহারাজকুমার শুক্লধ্বজ নারায়ন ওরফে চিলারায় এবং মহারাজ নরনারায়ন দুজনেই শিব ভক্ত ছিলেন ।তারা শিব- দুর্গা আরাধনা করার জন্য কামতাপুর রাজ্যে অনেক মন্দির নির্মান করেন।এই সময়ে বৈষ্ণব ধর্মগুরু শঙ্করদেব অহম রাজ্য হতে বিতাড়িত হলে চিলা রায় তাকে কামতাপুর রাজ্যে আশ্রয় দেন ও তার ধর্মমতে দীক্ষিত ও মোহিত হন । মহারাজ নরনারায়ণ মহাপুরুষ শঙ্করদেব এর পাণ্ডিত্যে ও গুণে মুগ্ধ হয়ে তাকে রাজসভায় পণ্ডিতের স্থান দেন এবং কামতাপুর রাজ্যে শ্রীশ্রী মদনমোহন বিগ্রহ প্রতিষ্ঠা করে পূজার ব্যবস্থা করেন।সেই সময় থেকেই Coochbeharএ মদনমোহন বিগ্রহের পূজা-অর্চনা প্রচলিত ,যা আজও বর্তমান । শঙ্করদেব জাতিতে কায়স্থ ছিলেন অথচ তিনি বৈষ্ণব ধর্মের ধর্মগুরু হিসেবে খ্যাতি লাভ করেছিলেন।ব্রাহ্মণরা এই জাতিগত বিদ্বেষ এর বশীভূত হয়ে শঙ্করদেবকে হেনস্থা করতে উঠেপড়ে লেগেছিলেন ।চিলা রায়ের আশ্রয়ে থাকাকালীন তার অনুমতিক্রমে শঙ্করদেব "সীতা স্বয়ংবর" নামক নাটক রচনা করেছিলেন ।চিলারায় শঙ্করদেবের জ্ঞাতি ভ্রাতা রামরায়ের কন্যা কমলাপ্রিয়াকে বিয়ে করেছিলেন ।
মহারাজা নরনারায়ণ চিলারায়কে সংকোষ ও ব্রহ্মপুত্র নদীর পূর্ব দিকের সমগ্র অঞ্চল দান করেছিলেন । চিলারায় রায়ডাক নদীর পশ্চিমে ফুলবাড়ীতে তার বাসস্থান গড়ে তুলেছিলেন। দুর্গের আকারে গড়ে তোলা বাসস্থানটি "চিলারায়কোট" নামে পরিচিত ।দুর্গের গঠনপ্রণালী ব্রিটিশ পর্যটক #রালফ ফিচকে# বিস্মিত করেছিল ।দুর্গের মধ্যে দুইটি মহল ছিল ।উত্তর মহলটি সৈন্যনিবাস, অস্ত্রাগার ও সভাকক্ষ ছিল। দক্ষিণমহলটি ছিল চিলারায় এর অন্দরমহল। দুর্গটি পরিখার দ্বারা পরিবেষ্টিত ছিল ।কথিত আছে যে,উত্তর মহল এবং দক্ষিণমহল দুটি দুর্গের মধ্যে যোগাযোগের জন্য সুরঙ্গ ছিল ।কয়েক বৎসর পূর্বেও কোটের ধ্বংসাবশেষ অনুমান করা যেতো, বর্তমানে পাশে গড়ে ওঠে নতুন জনবসতির চাপে ধ্বংসস্তূপের অনেক কিছুই প্রায় নিশ্চিহ্ন ।শুক্লধ্বজ বারোকোদালী গ্রামে "বড় মহাদেব মন্দির" ও নাককাটি গাছ গ্রামের "ছোট মহাদেব মন্দির "স্থাপন করেন ।এখানে এখনো নিয়মিতভাবে পুজা ক্রিয়াদি হয় ।
মহারাজা নর-নারায়ণ তার কনীয়ান ভ্রাতা চিলা রায় এর পুত্র রঘুদেব নারায়ণকে পুত্রবৎ স্নেহ করিতেন এবং অনেক সময় তাকে কোলে নিয়ে সিংহাসনে বসতেন ।বার্ধক্যের প্রারম্ভ পর্যন্ত মহারাজ নরনারায়নের কোন পুত্র জন্মগ্রহণ না করায় রঘুদেবপুর রাজা হওয়ার সম্ভাবনা ছিল ।তিনি "পাঠকুমার" বলেও অভিহিত হইতেন ।কিন্তু যথাসময়ে রাজকুমার লক্ষ্মীনারায়ণ জন্মগ্রহণ করলে রঘুদেব নারায়ন এর মহারাজ হওয়ার সম্ভাবনা বিলীন হয়ে যায় এবং কবীন্দ্র পাত্র, গদাধর চাউনিয়া,পুরন্দর লস্কর, কবিরাজ গোপাল চাউনীয়া, গদাই বড়কায়স্ত ,শ্রীরাম লস্কর,কনপুর গিরি এদের কুপরামর্শে পিতার আন্তরিক ইচ্ছা এবং সদুপদেশ অগ্রাহ্য করে রাজধানী পরিত্যাগ করেন এবং মানষ নদীর তীরে বড়নগর এর নিকট একটি দুর্গ নির্মাণ করে সপরিবারে বাস করতে শুরু করিলেন ।বর্তমানে অসমের বিজনি, বেলতলা, দরং,অভয়পুরী জেলায় চিলা রায় এর উত্তরপুরুষরা বসবাস করছেন ।ধর্মপ্রাণ চিলারায় অনেক মন্দির স্থাপন এবং সংস্কার করেন ।
শাক্ত এবং শৈবপন্থী চিলা রায় বৈষ্ণব ধর্মের প্রবর্তক শঙ্করদেব ছাড়াও মহাকবি অনিরুদ্ধকেও কামতা রাজ্যসভায় এনে স্থান দিয়েছিলেন।তিনি এবং মহারাজা নর নারায়ণের প্রচেষ্টায় কামাখ্যা মন্দির ১৫৬৫খ্রিস্টাব্দের পুনর্গঠন করেন ।এই মন্দির নির্মাণের দায়িত্ব দিয়েছিলেন মহৎরাম বৈশ্যকে।জনশ্রুতি আছে যে, চিলারায় না থাকলে কামাখ্যা মন্দিরের পুনর্গঠন কোনভাবেই সম্পন্ন হতো না । চিলা রায় এর মৃত্যুকাল সম্বন্ধে মতভেদ আছে ,কথিত আছে যে ,দ্বিতীয়বার গৌড় আক্রমণ কালে এই মহান বীর (১৪৯২শক) ১৫৭১খৃস্টাব্দে চৈত্র মাসে গঙ্গাতীরে বসন্ত রোগে মৃতুবরণ করেন।