নয়াদিল্লি: বিল পরিণত হয়ে গিয়েছে আইনে। কিন্তু বিতর্ক এতটুকুও কম হয়নি। নতুন ওয়াকফ (সংশোধন) আইন, ২০২৫-এ এবার জটিলতা দেখা দিয়েছে ‘ওয়াকফ বাই ইউজার’-কে কেন্দ্র করে। চলছে বিরোধী পক্ষের আবেদনের ভিত্তিতে সুপ্রিম কোর্টে মামলা। অতএব, সবার আগে এই ‘ওয়াকফ বাই ইউজার’ (Waqf By User) কী, তা স্পষ্ট করে দেওয়া উচিত হবে। সহজ করে বললে বহু বছর ধরে কোনও ধর্মীয় বা দাতব্য সম্পত্তি যদি প্রতিষ্ঠিত থাকে, দলিল না থাকলেও, তাকেই বলা হয় ‘ওয়াকফ বাই ইউজার’।
advertisement
বুধবার সরকারি সূত্র জানিয়েছে মামলার কার্যক্রম চলাকালীন সুপ্রিম কোর্টের ‘ওয়াকফ বাই ইউজার’ ধারণার প্রতি সমর্থন কেন্দ্রের জন্য বড় উদ্বেগের বিষয় হয়ে উঠবে, কারণ এটি নতুন আইনকে মারাত্মকভাবে দুর্বল করে দিতে পারে। বৃহস্পতিবার সুপ্রিম কোর্টের সামনে সরকার নতুন আইনের এই বিধানের সপক্ষে একটি জোরালো যুক্তি উত্থাপন করবে বলে আশা করা হচ্ছে।
বুধবার, সুপ্রিম কোর্ট প্রস্তাব করে যে, ওয়াকফ হিসেবে ঘোষিত সম্পত্তি, যার মধ্যে ‘ওয়াকফ বাই ইউজার’ হিসেবে মনোনীত সম্পত্তিও অন্তর্ভুক্ত, তা বাতিল করা হবে না। কেন্দ্র এই পরামর্শের বিরোধিতা করে এবং এই ধরনের কোনও নির্দেশ জারি করার আগে শুনানির অনুরোধ করে। সংসদে পাস হওয়া নতুন আইনে বলা হয়েছে যে ওয়াকফ (সংশোধন) আইন, ২০২৫ (Waqf (Amendment) Act, 2025) শুরু হওয়ার আগে বা তার আগে রেজিস্টারড বিদ্যমান ‘ওয়াকফ বাই ইউজার’ সম্পত্তি ওয়াকফ সম্পত্তি হিসেবেই থাকবে, ‘‘সম্পূর্ণ বা আংশিকভাবে সম্পত্তিটি বিতর্কিত বা সরকারি সম্পত্তি না হলে।’’
আর এই জায়গা থেকেই দেখা দিয়েছে জটিলতা। বিরোধীরা বরাবর এই দাবি উত্থাপন করে এসেছে যে এই আইন আদতে দেশের সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের স্বার্থ রক্ষা করতে ব্যর্থ হবে। এবার ওয়াকফ সম্পত্তি এবং ‘ওয়াকফ বাই ইউজার’ সম্পত্তির সূক্ষ্ম ভেদরেখা বিষয়টিকে সেই দিকে নিয়ে যাচ্ছে বলে দাবি উঠতে শুরু করেছে। কেন না, দেশে এমন অনেক ‘ওয়াকফ বাই ইউজার’ সম্পত্তির অস্তিত্ব রয়েছে যার দলিল কোনও ভাবেই পেশ করা সম্ভব নয়। দেশের সর্বোচ্চ আদালতও সেই যুক্তি দর্শিয়েছে।
আবেদনকারীদের আর্জি মেনে সমগ্র সংশোধিত ওয়াকফ আইন (২০২৫)-এ বুধবার স্থগিতাদেশ দেয়নি সুপ্রিম কোর্ট। তবে নতুন এই আইনের তিনটি বিষয় বিবেচনা করে অন্তর্বর্তী নির্দেশ দিতে চেয়েছিল প্রধান বিচারপতি সঞ্জীব খন্নার ডিভিশন বেঞ্চ। কিন্তু কেন্দ্রীয় সরকারের অনুরোধে শেষ মুহূর্তে সেই অন্তর্বর্তী নির্দেশ দেয়নি শীর্ষ আদালত।
সুপ্রিম কোর্ট এবার এই বিধান সরকারকে স্পষ্ট করতে বলেছে। আদালত খতিয়ে দেখেছে যে চতুর্দশ শতাব্দী থেকে নির্মিত বেশিরভাগ মসজিদের সেল ডিড বা বিক্রয় দলিল থাকবে না, এর ফলে তাদের পক্ষে দলিল সরবরাহ করা সম্ভবও হবে না। সুপ্রিম কোর্ট তাই জিজ্ঞাসা করেছে যে সরকার যদি এই জমিগুলোকে সরকারি সম্পত্তি হিসাবে দাবি করে তখন কী হবে! বিরোধী পক্ষের আবেদনকারীদের প্রতিনিধিত্ব করছেন কপিল সিব্বল, তিনি যুক্তি দিয়েছেন যে সরকার নতুন আইনের অধীনে ‘ওয়াকফ বাই ইউজার’ বাতিল করেছে এবং এই ধরনের সম্পত্তির জন্য দলিল দাবি করবে। অন্য দিকে, আর কে ধাওয়ান আদালতকে ‘ওয়াকফ বাই ইউজার’-এর গুরুত্বের উপর জোর দিয়েছিলেন।
সুপ্রিম কোর্ট স্বীকার করেছে যে ‘ওয়াকফ বাই ইউজার’ বাতিল করলে অসংখ্য জটিলতা তৈরি হবে, তাই আদালত এই বিষয়ে কেন্দ্রীয় সরকারের প্রতিক্রিয়া চেয়েছে। সরকার নতুন আইনে সংশোধিত ‘ওয়াকফ বাই ইউজার’ বিধানকে জোরালোভাবে রক্ষা করবে এবং এর অন্তর্ভুক্তির পিছনে যুক্তি দেবে বলে আশা করা হচ্ছে।
তৃণমূল কংগ্রেসের সাংসদ মহুয়া মৈত্র, যিনি বিরোধী পক্ষের আবেদনকারীদের একজন, দাবি করেছেন যে সুপ্রিম কোর্টের “ওয়াকফ হিসাবে ঘোষিত বিদ্যমান সম্পত্তিগুলো ওয়াকফ নয় বলে বাতিল করা উচিত নয়, তা সে ওয়াকফ বাই ইউজার হোক বা ওয়াকফ ডিড অনুসারে হোক”!
আরেক আবেদনকারী অ্যাডভোকেট বিষ্ণু শঙ্কর জৈন বলেন, ‘ওয়াকফ বাই ইউজার’ একটি অতীব কঠোর ধারণা, ভারতে ‘টেম্পল বাই ইউজার’-এর বিধান বিশেষত যখন নেই। তিনি আরও বলেন, বর্তমান সংশোধনী ‘ওয়াকফ বাই ইউজার’ ধারণাটি সমাজের বৃহৎ অংশকে ওয়াকফ বোর্ডের স্বেচ্ছাচারী ক্ষমতা থেকে রক্ষা করে।
তীব্র বিতর্কের মধ্যে সংসদে পাস হওয়ার পর ৫ এপ্রিল, ২০২৫ তারিখে রাষ্ট্রপতির অনুমোদন পায় ওয়াকফ (সংশোধনী) আইন, ২০২৫। লোকসভায় এটির পক্ষে ২৮৮ ভোট এবং বিপক্ষে ২৩২ ভোট পড়ে। পরে রাজ্যসভায় এটি পাস হয়, যেখানে ১২৮ জন সদস্য এটিকে সমর্থন করেন এবং ৯৫ জন বিরোধিতা করেন।
কিন্তু, জটিলতা এখনও রয়ে গিয়েছে। এখনও পর্যন্ত আইনটির বৈধতা তথা প্রয়োজনীয়তা চ্যালেঞ্জ করে ৭২টি আবেদন দাখিল করা হয়েছে। আবেদনকারীদের মধ্যে রয়েছেন AIMIM প্রধান আসাদুদ্দিন ওয়াইসি, অল ইন্ডিয়া মুসলিম পার্সোনাল ল বোর্ড (AIMPLB), জমিয়ত উলামা-ই-হিন্দ, DMK এবং কংগ্রেস সাংসদ ইমরান প্রতাপগড়ী এবং মহম্মদ জাভেদ।
সংশোধিত ওয়াকফ আইন দেশে কার্যকর করেছে নরেন্দ্র মোদি সরকার। তাকে চ্যালেঞ্জ করে সুপ্রিম কোর্টে বেশ কয়েকটি পিটিশন দায়ের করা হয়েছে। বুধবার সে রকম ৭৩টি আবেদন একত্রিত করে শোনে সুপ্রিম কোর্টের প্রধান বিচারপতি সঞ্জীব খন্নার বেঞ্চ। বেঞ্চে ছিলেন বিচারপতি সঞ্জয় কুমার এবং বিচারপতি কেভি বিশ্বনাথন। সেই শুনানিতে নতুন আইন নিয়ে কেন্দ্রীয় সরকারকে বেশ কিছু প্রশ্ন করেছে সুপ্রিম কোর্ট। নতুন আইনে ওয়াকফ বোর্ডের সদস্য হতে পারবেন অমুসলিমেরাও। সুপ্রিম কোর্টের প্রশ্ন, হিন্দুদের সম্পত্তি সংক্রান্ত বোর্ডে কি কোনও মুসলিমকে সদস্য হতে দেবে সরকার?