যদিও চিনের এই দাবিকে আমলই দিতে চাননি অসমের মুখ্যমন্ত্রী হিমন্ত বিশ্বশর্মা৷ তিনি পাল্টা দাবি করেছেন, ব্রহ্মপুত্রের জলের মূল উৎস উত্তর পূর্ব ভারতের রাজ্যগুলিতে ভারী বর্ষণ এবং ব্রহ্মপুত্রের শাখা নদীগুলির জল৷ অসমের মুখ্যমন্ত্রীর কথায়, ব্রহ্মপুত্র ভারতে প্রবেশের পরই ফুলেফেঁপে ওঠে৷ চিন যদি একান্তই ব্রহ্মপুত্রে জল আসা বন্ধ করেও, সেক্ষেত্রে উপকারই হবে ভারতের৷ কারণ অতিরিক্ত জল কমে অসমের বিস্তীর্ণ এলাকা প্রতি বছরের বন্যার সমস্যা থেকে মুক্তি পাবে৷
advertisement
শুধু হিমন্ত বিশ্বশর্মার দাবি নয়, বাস্তবেও কি সত্যিই ব্রহ্মপুত্রে জলের প্রবাহ বন্ধ করে দেওয়ার ক্ষমতা রয়েছে চিনের হাতে? প্রযুক্তগত, ভৌগলিক এবং ভূরাজনৈতিক বিষয়গুলি বিচার করে বলা যায়, ব্রহ্মপুত্রের গতিপথ কিছুটা বদলে দেওয়ার চেষ্টা করলেও পুরোপুরি বন্ধ করার সুযোগ বা ক্ষমতা চিনের হাতেও নেই৷ এমন কি, গতিপথ আংশিক বদলের প্রভাবও অনেক বড়সড় হতে পারে৷
একনজরে দেখে নেওয়া যাক কেন চিনের পক্ষে ব্রহ্মপুত্রের গতিপথ পুরোপুরি বন্ধ করা অসম্ভব?
natstratb.org-তে প্রকাশিত একটি প্রতিবেদন অনুযায়ী, ব্রহ্মপুত্রের অববাহিকায় যে পরিমাণ জল থাকে তার ২২ থেকে ৩০ শতাংশ আসে চিন থেকে৷ ওই প্রতিবেদনটির দুই লেখকের মধ্যে একজন হলেন পি কে সাক্সেনা৷ তিনি ভারতে সিন্ধু জলবণ্টন প্রকল্পের প্রাক্তন কমিশনার হিসেবে দায়িত্ব সামলেছেন এবং ভোপালের কেন বাটওয়া লিঙ্ক প্রকল্পের পরামর্শদাতা হিসেবেও কাজ করেছেন৷ ওই প্রতিবেদনের দ্বিতীয় লেখক তীর্থ সিং মেহতা ব্রহ্মপুত্র এবং বরাক নদীর জন্য ভারতের জলশক্তি মন্ত্রকের প্রাক্তন কমিশনার ছিলেন৷ এই দুই বিশেষজ্ঞই দাবি করেছেন, যেহেতু তিব্বতে বৃষ্টিপাত অথবা তুষারপাতের পরিমাণ খুব বেশি হয় না, সেই কারণেই ব্রহ্মপুত্রের জলে চিনের অবদান খুব বেশি থাকেও না৷
বরং তাঁরা দাবি করেছেন, ব্রহ্মপুত্রের অববাহিকার মাত্র ৬.৭ শতাংশ তাদের ভাগে থাকলেও ব্রহ্মপুত্রের জলের প্রায় ২১ শতাংশ আসে ছোট্ট দেশ ভুটান থেকে৷ অন্যদিকে ভারতে ব্রহ্মপুত্র নদের অববাহিকার ৩৪.২ শতাংশ রয়েছে৷ ব্রহ্মপুত্রে মোট যে জল এসে মেশে, তার ৩৯ শতাংশই ভারত থেকে আসে বলে ওই প্রতিবেদনে দাবি করা হয়েছে৷
আরও পড়ুন: মে মাসে আবহাওয়ার ভোলবদল! ২০২৫-এ যা ঘটল, ১২৪ বছরে প্রথমবার সাক্ষী থাকল দেশ
এক্স হ্যান্ডেলে অসমের মুখ্যমন্ত্রী হিমন্ত বিশ্বশর্মাও লিখেছেন, বহ্মপুত্রের ৬০ থেকে ৬৫ শতাংশ জলের উৎস ভারতেই রয়েছে৷ তাঁর কথায়, ব্রহ্মপুত্রের বাকি ৬৫ থেকে ৭০ শতাংশ জলের উৎস ভারতের মধ্যেই রয়েছে৷ মূলত অসম, মেঘালয়, নাগাল্যান্ড এবং অরুণাচল প্রদেশে ভারী বর্ষণ এবং সুবানসিরি, মানস, লোহিত, কামেং, ধানসিরির মতো প্রধান শাখা নদীগুলির জলে পুষ্ট হয় ব্রহ্মপুত্র৷ এ ছাড়াও খাসি, গারো এবং জয়ন্তীয়া পাহাড়ের কৃষ্ণানই, দিগারু এবং কুলসির মতো ছোট ছোট নদীর জলও এসে ব্রহ্মপুত্রে মেশে৷ তথ্য দিয়ে হিমন্ত দাবি করেছেন, ভারতে প্রবেশের পরেই ব্রহ্মপুত্র আরও ফুলেফেঁপে ওঠে৷ তিনি লিখেছেন, তুতিংয়ে চিন-ভারত সীমান্তে ব্রহ্মপুত্রের জলের প্রবাহ থেকে প্রতি সেকেন্ডে ২০০০ থেকে ৩০০০ কিউবিক মিটার৷ সেখানে বর্ষার সময়ে গুয়াহাটির মতো অসমের সমতলে সেই প্রবাহই বেড়ে দাঁড়ায় ১৫০০০ থেকে ২০০০০ কিউবিক মিটার প্রতি সেকেন্ড৷
চিনের তিব্বতে ইয়ারলুং সাংপ্রো, ভারতে যা ব্রহ্মপুত্র নদ৷ ছবি এএফপি
চিনের বাঁধ তৈরিতে ভারতের চিন্তা কতটা?
ব্রহ্মপুত্রের তিব্বতি নাম ইয়ারলুং সাংপ্রো৷ সেই নদীর উপরেই বিশ্বের সর্ববৃহৎ জলবিদ্যুৎ প্রকল্প তৈরির পরিকল্পনা করেছে চিন৷ এই প্রকল্পের অংশ হিসেবেই জলবিদ্যুৎ তৈরি করতে নদীর গতিমুখগুলিকে বিভিন্ন সুড়ঙ্গের দিকে ঘুরিয়ে দেওয়া হবে৷ নদীর এই গতিপথ বদলের চেষ্টা হলে ভারতের জন্য অবশ্যই উদ্বেগের, কিন্তু তা শুধুই বছরের যে সময়ে বর্ষা থাকে না, সেই সময়টুকুর জন্য৷ অসমের মুখ্যমন্ত্রী হিমন্ত বিশ্বশর্মাই গত জানুয়ারি মাসে ব্রহ্মপুত্রের বুকে চিনের এই বাঁধ তৈরি নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছিলেন৷ তিনি দাবি করেছিলেন, এর ফলে ব্রহ্মপুত্রের উপরে নির্ভরশীল গোটা বাস্তুতন্ত্রই ভেঙে পড়বে এবং জলসঙ্কটে ভুগবে৷ অসমের মুখ্যমন্ত্রী আরও দাবি করেন, এই বাঁধ তৈরি হলে অসমকে অরুণাচল প্রদেশ এবং ভুটানের বৃষ্টির জলের উপরে বেশি নির্ভরশীল হয়ে পড়তে হবে৷ ভারতের এই উদ্বেগের বিষয়টি কূটনৈতিক মাধ্যমে চিনকে জানানো হয়েছে বলেও জানিয়েছিলেন হিমন্ত৷
চিনের বাধ্যবাধকতা
হংকংয়ের সংবাদমাধ্যম সাউথ চায়না মর্নিং পোস্ট-এর দাবি অনুযায়ী, তিব্বতের যে অংশে চিন এই জলবিদ্যুৎ প্রকল্প তৈরির পরিকল্পনা করেছে, সেটি অত্যন্ত ভূমিকম্প প্রবণ৷ ওই এলাকায় বড়মাপের কোনও জলবিদ্যুৎ প্রকল্প তৈরি করলে তাতে হিতে বিপরীত হওয়ার আশঙ্কাও ভাবাচ্ছে বেজিংকে৷ কারণ ওই এলাকায় বড় বাঁধ নির্মাণ করলে ভূমিকম্পের সম্ভাবনাকে বাড়িয়ে দেবে৷ আর সত্যিই সেরকম কোনও বিপর্যয় ঘটে গেলে তিব্বতে ব্রহ্মপুত্রের নিম্ন অববাহিকায় ভয়াল বন্যার আশঙ্কা তৈরি হবে৷ যা চিনের নিজের স্বার্থের পক্ষেই খুব একটা সুবিধাজনক হবে না৷
অন্যদিকে একতরফা ভাবে চিন যদি ব্রহ্মপুত্রে গতিপথ বদলে দেওয়ার বা আটকানোর চেষ্টা করে, তাহলে ভারতের সঙ্গে তাদের সম্পর্কে আরও অবনতি হবে৷ যা সার্বিক ভাবে এই অঞ্চলের ভূ-রাজনীতি এবং নিরাপত্তার উপরে প্রভাব ফেলবে৷ আর ভারতে ব্রহ্মপুত্রের জল আসা আটকালে ভুগতে হবে বাংলাদেশকেও৷ ফলে ব্রহ্মপুত্রের জল আটকানোর আগে সবদিক ভেবেই মেপে পা ফেলতে হচ্ছে বেজিংকে৷