দুর্গা পুজো শুধু পুজো নয়, একটা উৎসব। আর সেটা বোধায় একটু বেশি অনুভব করা যায় যখন নিজের শহর, দেশ ছাড়তে হয়। এমন কিছু অনুভূতি নিয়েই আমি এসেছিলাম পশ্চিম জার্মানির এরল্যাঙ্গেন শহরে। তবে মা দুর্গা সেখানে আগেই উপস্থিত ছিলেন, দুর্গাভিলের মণ্ডপে। আমিও হয়ে গেলাম এই পরিবারের এক সদস্য। আমাদের পুজো যেন বাড়ির পুজো, যার তোড়জোড় শুরু হয়ে যায় আগের পুজোর দশমী পার হলেই। তার পর প্রতি মাসেই চা সিঙ্গাড়া-এ চলতে থাকে চর্চা, প্যান্ডেলের থিম, মঞ্চসজ্জা আর সাংকৃতিক অনুষ্ঠানের পরিকল্পনা। বাঙালি-অবাঙ্গালি মিলেমিশে প্রবাসে যেন এক ছোট ভারতবর্ষ। প্রতি বছরের পুজো মণ্ডপে ভারতের ঐতিহ্য তুলে আনারই প্রচেষ্টা থাকে আমাদের । গতবছর গ্রামবাংলার বনেদি রাজবাড়ি কিংবা এ’বছর বাংলার পটচিত্র কে তুলে ধরা… এভাবেই এরল্যাঙ্গেন-এ সেজে ওঠে দুর্গাপুজোর প্যান্ডেল ।
advertisement
জার্মানির বাভারিয়া রাজ্যের এক ছোট্ট সুন্দর শহর এরল্যাঙ্গেনের দুর্গাপুজো
পুজোর তিন চার মাস আগে থেকেই শনি-রবিবার যেন স্কুলের আর্ট প্রজেক্ট। কাঠ, থার্মোকল, আঠা আর কিছু ইঞ্জিনিয়ারিং বুদ্ধি লাগিয়ে একটু একটু করে গড়ে ওঠে মা দুর্গার ঘর। শুধু ঘর নয়, আমাদের পুজোর আর এক বিশেষত্ব হল আমাদের দুর্গা প্রতিমা। নিজের অফিস রুমকেই কুমোরটুলি বানিয়ে বিদেশের বুকে ডাকের সাজে প্রতিমা তৈরি করেন দুর্গাভিলের প্রতিষ্ঠাতা সদস্য দীপঙ্কর সরকার।
পুজোর তিন চার মাস আগে থেকেই শনি-রবিবার যেন স্কুলের আর্ট প্রজেক্ট। কাঠ, থার্মোকল, আঠা আর কিছু ইঞ্জিনিয়ারিং বুদ্ধি লাগিয়ে একটু একটু করে গড়ে ওঠে মা দুর্গার ঘর
এভাবেই দেখতে দেখতে চলে আসে মহালয়া, আর তার সঙ্গে আগমন হয় আমাদের পুরোহিতমশাই পরিমলবাবুর, যিনি রানাঘাট থেকে প্রতিবছর এসে নিশ্চিত করেন যাতে অষ্টমীর অঞ্জলিটা মিস না হয়। মহালয়া থেকেই সব সদস্যরা দায়িত্ব ভাগ করে কাজে লেগে পড়েন…মণ্ডপ সাজানো, ভোগের আয়োজন! বাঙালির দুর্গাপুজো অসম্পূর্ণ খাওয়াদাওয়া ছাড়া, বিশেষ করে অষ্টমীর খিচুড়ি ভোগ। সেই আমেজেই ষষ্ঠীর বোধন থেকে দশমী পর্যন্ত চলতে থাকে খাওয়া দাওয়া আর সঙ্গে নিপাট আনন্দ। এর মাঝেই সব নিয়ম মেনে এবং সঠিক লগ্নে সম্পূর্ণ হয় মা দুর্গার আরাধনা। অষ্টমী-নবমীতে গান, নাচ, শঙ্খ বাজানোর প্রতিযোগিতা, বাচ্চাদের আঁকা প্রতিযোগিতা, এসবেই মেতে ওঠে সন্ধেগুলো। ভারতীয়দের সঙ্গে কৌতূহলের বশে জুড়ে যায় অনেক স্থানীয় জার্মান, যারা এই আনন্দের লোভে প্রতিবছর ফিরে আসেন। তাদের জন্য এ যেন এক অন্যই চমক। ষষ্ঠীর সন্ধ্যায় উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে উপস্থিত থাকেন মিউনিখের ভারতীয় দূতাবাসের মাননীয় কনসাল-জেনারেল।
মহালয়া থেকেই সব সদস্যরা দায়িত্ব ভাগ করে কাজে লেগে পড়েন…মণ্ডপ সাজানো, ভোগের আয়োজন
ষষ্ঠীর দিনটা এলেই অফুরন্ত আনন্দের সঙ্গে এক টুকরো মন খারাপও উঁকি মারে। আর পাঁচটা দিন পর মা দুর্গাকে বিদায় জানিয়ে আবার দৈনন্দিন জীবনে ফিরে যেতে হবে। তবে এই ‘দুর্গাভিলে’ পরিবারে আমরা সারাবছরই সংস্কৃতির দোহাই দিয়ে একটু উৎসব আর বাঙালির বারো মাসে তেরো পার্বণ খুঁজে নেই, আর এভাবেই শুরু হয়ে যায় আগামী পুজোর জোরদার প্রস্তুতি।
অভিষেক লাহিড়ী