ইতিহাস আর দীর্ঘ গবেষণাধর্মী এই উপন্যাসে লেখক তুলে ধরেছেন অজয়তীরের কেন্দুলী, মন্দিরা আর কাঁকসার সেনাপাহাড়ি অঞ্চলের ইতিবৃত্ত।
এই কথাটুকু বললেই এই উপন্যাসটির প্রতি সুবিচার করা হবে না। নিরন্তর শ্রমদানে এবং গভীর গবেষণায় এই উপন্যাসের ভিত্তি রচিত হয়েছে, তা পাঠমাত্রই বোঝা যায়। রাঢ়ের মানুষ হওয়ার জন্যই বোধহয় রাধামাধব এইরকম একটি উপন্যাস রচনার গুরুদায়িত্ব নিজের কাঁধে তুলে নিতে পেরেছেন। তাঁর লেখালেখির সূত্রপাতও সম্ভবত কেন্দুলিকে ঘিরেই, সেই কেন্দুলি যা আজও বিখ্যাত জয়দেবের নাম মাহাত্ম্যে। মকর মেলার প্রাচীন এই নদীতীরের ইতিহাসটিও কবি জয়দেবকে ঘিরেই আবর্তিত।
advertisement
এই উপন্যাসের কেন্দ্রীয় চরিত্র জয়দেব হলেও উপন্যাসটি আসলে রাঢ়বঙ্গের একটি সময়ের সমাজ-জীবনের দলিলও হয়ে উঠতে চলেছে। তাই এই উপন্যাসে সে সময়ের বঙ্গদেশের রাজা লক্ষ্মণ সেন যেমন হাজির, তেমনই হাজির অন্ত্যজ শ্রেণির মানুষজনরাও। উপন্যাসের শুরুতেই দেখা মেলে ঢেকারো কামারদের। কাহিনিতে মিশে গিয়েছে ইতিহাস, পুরাণ, লোককথা। আবার ইতিহাস-আশ্রিত এবং ঘটনানির্ভর হওয়া সত্ত্বেও মানব জীবনের নানা জটিলতাকেও এই কবি জীবনের কাহিনিটির পরতে পরতে বুনে দিতে সক্ষম হয়েছেন লেখক। ঐতিহাসিক পটভূমিতে নির্মিত যে কোনও উত্তম উপন্যাস প্রশ্রয় দেয় কল্পনাকেও।
আরও পড়ুন: ওরাকল স্পিকস ১৮ জানুয়ারি; দেখে নিন ভাগ্যফল, আজ কোন রং পরলে সৌভাগ্য আসবে জানুন
এই উপন্যাসেও রাধামাধবের কল্পনা প্রয়োজন মতো উড়াল নিয়েছে। হয়তো এক কবির জীবনালেখ্য বলেই উপন্যাসটির কিছু কিছু অংশ প্রায় কবিতার মতো। গভীর এক দর্শনবোধও উপন্যাসটিকে পল্লবিত হওয়ার জন্য প্রয়োজনীয় জল, আলো, বাতাস যুগিয়েছে। রাজা লক্ষ্ণণ সেন, কবিবন্ধু পরাশর, ভোজদেব আর পদ্মাবতীর জীবনও এসে মিশেছে কবি জয়দেবের জীবনকে ঘিরে। বর্গিদের রাজত্বের পাশাপাশি বাংলাদেশ, কাশী আর জগন্নাথ দেবও এসেছেন গীতগোবিন্দমের স্রোতে। সময়, কাল আর এক মহাজীবনের গল্প ভক্তকবির এই জীবনকে ঘিরেই আবর্তিত হয়েছে।
আর মাত্র কয়েকদিন। তারপরই অজয়তীরে মকরের কেন্দুলী মেলা। কীর্তন আর বাউলের সুরে মাতবে ভুবন। দেশ বিদেশের বহু মানুষ আসেন এই বাঙালি কবির টানেই। এবিষয়ে লেখক রাধামাধব মণ্ডলকে জিজ্ঞেসা করা হলে তিনি বলেন, ”খুব অভাব ছিল বাড়িতে। বাবা ইটভাঁটায় শ্রমিকের কাজ করতেন। সে সময় আমাদের কাছের শান্তিনিকেতন মেলায় গিয়ে থাকার সুযোগ ছিল না। ধনীব্যক্তিদের মেলা। সেখানে নামীদামী মানুষজনদের ভিড়। আর পয়সা না থাকলেও জয়দেবের স্মৃতিধন্য কেন্দুলীর মেলাতে বিনিপয়সায় গিয়ে থেকেছি। খেয়েছি। সেখানে আজও অন্নছত্র দেওয়া হয়। আশ্রমে আশ্রমে বিনিপয়সায় মানুষ গিয়ে থাকতে পারে। আমি এসব দেখে আশ্চর্য হয়েছি। একজন বাঙালি কবির প্রেমের টানে গোটা বিশ্বের মানুষ আশ্চর্য রকম ভাবে আসেন কেন্দুলীতে। আর মানুষের খাবারের অভাব নেই এই গান মেলায়।”
সেই শুরু জয়দেব চর্চার। খুঁজতে শুরু করা কবিজীবন। লক্ষ্ণণ রাজত্বের ইতিহাস। কীভাবে গড়ে উঠল এই মস্ত গানমেলা, কবির স্মৃতিতে। এবছরের কলকাতার বিভা পাবলিশিং থেকে প্রকাশিত হয়েছে উপন্যাসটি। ভক্ত কবি জয়দেব, সত্যিই এক মহাজীবনের গল্প।