“আমার অনির্দিষ্ট কালের জন্য মৌনব্রত ধারণ। না লেখা না আর বকা। আজ থেকে আমি এক্কেবারে বোবা বধির অন্ধ !অনেকদিন ধরে লেখা তো প্রায় ছেড়েই দিয়েছি , ভাবছি এবার বলাটাও বিল্কুল বন্ধ করে দেবো। আমার লেখা আমার বলায় আজকাল অনেকে অনেক ভুল খুঁজে বের করছে। সেই যে বলে যাঁরে দেখতে নারি তাঁর চলন ব্যাঁকা । সেই আর কী ! আমি এখন অনেকের চোখের বালি।”
advertisement
“এই কয়েকদিন আগে একমাঠে আয়োজিত এক সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে গিয়েছিলাম। আজকাল মেলা হোক আর খেলা যেখানেই যাই লোকে আমাকে দিয়ে কিছু না কিছু বলিয়ে নেয়। কিন্ত বলাটা আজকাল আমার পক্ষে বড় মুস্কিল হয়ে পড়ছে । দিনকাল ভালো নয় তাই বলতে খুবই ভয় করে। আমার মুখের জন্য একবার জয়পুরে আমাকে ঘিরে নিয়েছিল কিছুজন । সেবার অল্পের জন্য প্রাণে বেঁচেছি। আজ বলবো না ভেবেছিলাম- তবু উদ্যোক্তাদের অনুরোধে অতি সাবধানে সংস্কৃতি কী সেই বিষয়ে কিছু বলার চেষ্টা করি-“ খিদে লাগলে খাওয়া এটা প্রকৃতি। খিদে না পেলেও খাওয়া এটা বিকৃতি । অন্যের মুখের গ্রাস কেড়ে খাওয়া এটা দুষ্কৃতী। আর নিজে না খেয়ে অভুক্তকে খাইয়ে দেওয়া এটা সংস্কৃতি”।
“এই মাত্র বলেছিলাম সেদিন। আপনারা বলতে পারেন এর মধ্যে অন্যায় কী বলেছি আমি ? বা কাউকে কী কোনও আঘাত করেছি? কিন্ত অবাক হয়ে দেখলাম আমার বক্তৃতার মাঝেই মুখ কালো করে মঞ্চ থেকে নেমে চলে গেলেন প্রধান অতিথি । যাবার আগে সামান্য সৌজন্য দেখিয়ে আমার দিকে তাকালেনও না। কী মুসকিল ! আমি কী তাঁকে দুষ্কৃতী ফুস্কৃতি এই সব বলেছি নাকি! দেখি মঞ্চের সবারই মুখ মেঘের মতো। কেউ আমার দিকে তাকাচ্ছে না। কথা বলছে না। হাসছে না। সেই দেখে আমিও আর মঞ্চে বেশিক্ষন থাকিনি মাত্র মিনিট পাঁচেকের মধ্যে নীচে নেমে গিয়েছি। আর তারপর দিন সকালে টিভি চালিয়ে দেখি এক টিভি চ্যানেল সেই সকালবেলাতেই চালিয়ে দিয়েছে আমার বিরুদ্ধে প্রচার,”মনোরঞ্জন আছে মনোরঞ্জনেই”। আমার বক্তৃতা বাজিয়ে বলছে ওরা, আমি নাকি আমার বক্তৃতায় বিশেষ এক ব্যক্তিকে আক্রমণ করেই এইসব বলেছি। যা বাবা! সেই যে বলে, ‘পড়ল কথা সবার মাঝে যার কথা তাঁর গায়ে বাজে।’ এ যেন সেই রকম হয়ে গেল।”
মনোরঞ্জন ব্যাপারী আরও বলেন, “কিছুদিন আগে সংসদে একটা বিল পাশ হয়েছে অনেক শব্দের প্রতি নিষেধাজ্ঞা জানিয়ে। বলা হয়েছে এই সব শব্দ কেউ বলতে পারবে না। বললেই নাকি তা মাননীয় প্রধানজি আর তাঁর দলবলের অসম্মান হচ্ছে। এও যে সেই রকম ব্যাপার ! বলেছি দুস্কৃতকারী অথচ দেহমন জ্বলছে সম্মানীয় নেতাদের। এখন – এই সময় আমি যা-ই বলিনা কেন সেতো কেউ না কেউ নিজের গায়ে টেনে নেবেই । তাই ভাবছি ফেসবুকেও আর কিছু লিখবো না, মঞ্চে গিয়েও আর কিছু বলবো না। সে রাজনৈতিক হোক বা অরাজনৈতিক- বলাগড়ের কোন মঞ্চেই কিছু বলব না। অরাজনৈতিক মঞ্চে সংস্কৃতি নিয়ে বলা কথাও যখন আমার বিরুদ্ধে চলে যাচ্ছে তখন চুপ থাকাই শ্রেয়। কী বলেন আপনারা?”
যে মনদুঃখে এক সময় কবি আক্ষেপে জীবন দেবতার কাছে আবেদন করে ছিলেন, ‘নীরব করে দাও হে তোমার মুখর কবিকে’ আজ মনে হচ্ছে আমারও তেমন করা উচিৎ। হয়ে যাওয়া দরকার একেবারে নীরব নিশ্চুপ, বোবা বধির অন্ধ। যাদের শতাব্দীর ঘুম ভাঙ্গাবার জন্য এত চেঁচালাম এত লিখলাম তাঁরা তো জাগলোই না, মাঝে থেকে অকারণে অনেক শত্রু বেড়ে গেল। সেই যে বলে খায়া পিয়া কুছ নেহী গিলাস তোড়া বারা আনা! আমার তাই হয়েছে। গেলাস ফেলাস ভেঙ্গে হাত ফাত কেটে ফর্দা ফাই। তাই থেমে গেলাম। এখন থেকে চুপচাপ কবি জয় গোস্বামীর মতো আমিও ঘরে বসে খাতার পাতায় লিখে রাখি বুকের মধ্যে চিলিক মারা গোপন ব্যথার কথা। তারপর কোনও একদিন তা বই হিসাবে প্রকাশিত করে দেব।”