ছোট্ট রোগা পাতলা চেহারার ১৪ বছরের সম্রাট পুরকাইতকে এভাবে দৌড়তে দেখে তৎপর হয় পুলিশ (Kolkata Police)। ট্রাফিক পুলিশের তরফে খবর যায় চারু মার্কেট থানায়৷ থানার সামনে থেকেই অষ্টম শ্রেণির ছাত্রকেউদ্ধার করেন পুলিশ কর্মীরা। চারু মার্কেট থানার সেই পুলিশ কাকুদের সহযোগিতাতেই শেষ পর্যন্ত স্কুল থেকে নতুন করে আরও এক সেট বই খাতা পায় সম্রাট। সরস্বতী পুজোর আগে নতুন বইয়ের গন্ধে চোখের জল সরে গিয়ে চিকচিক করছে খুশির ঝলক।
advertisement
বাস্তবটা এত সহজ ছিল না। আচমকাই এক কিশোরকে ওভাবে ছুটতে দেখে তৎপর হয় পুলিশ। চারু মার্কেট থানায় বসিয়ে পুলিশ সম্রাটের থেকে জানতে চায় কেন ওভাবে বাসের পিছনে ছুটছিল সে?
আরও পড়ুন: আইসিএসই, আএসসি-র সেমেস্টার ওয়ানের ফল সোমবার, জানা যাবে ওয়েবসাইট- এসএমএসে
পুলিশকে সম্রাট জানায়, টালিগঞ্জের কেওড়াপুকুরে তার বাড়ি। দীর্ঘদিন পর বৃহস্পতিবার নিজের স্কুল হালতু হাই স্কুলে গিয়েছিল সে। স্কুলে অষ্টম শ্রেণিতে নাম নথিভুক্ত করে সম্রাট। সঙ্গে ছিল তার মা। খাতা বই এবং স্কুলের পোশাক নিয়ে ব্যাগে করে বাড়ি ফিরছিল সম্রাট ও তার মা।
স্কুল থেকে কিছুটা হেঁটে এসে তারা বাসে ওঠে। বেসরকারি বাসে চেপে সম্রাট ও তার মা প্রিন্স আনোয়ার শাহ রোডের মোড়ে নামে। বাসের মধ্যে মোবাইলে গেম খেলতে খেলতে আসছিল সম্রাট। মা ডাকতেই মোবাইল নিয়ে বাস থেকে নেমে পড়ে ছোট্ট ছেলেটি। এতদিন অফলাইনে স্কুল ছিল না তাই বই খাতাকে অনেক দিন আগেই বিদায় দিয়ে শুধু মোবাইলকে সঙ্গী করেছিল স্কুলছাত্ররা। হয়তো সেই অভ্যাসেই বই খাতার কথা একদম ভুলে গিয়ে মোবাইল নিয়ে বাস নেমে পড়ে ছোট সম্রাট। নতুন বই সহ স্কুল ব্যাগ পড়ে থাকে বাসে৷
বাস থেকে নামতেই সম্রাটকে ব্যাগের কথা জিজ্ঞেস করেন তাঁর মা৷ তখনই টনক নড়ে ওই ছাত্রের৷ এর পরই বাসের পিছনে ছুটতে শুরু করে সে৷ ব্যস্ত রাস্তায় বাসের পিছনে ছুটতে গিয়ে দুর্ঘটনাও ঘটতে পারত সম্রাটের৷ তখনই পুলিশের চোখে পড়ে সে৷
চারু মার্কেট থানার পুলিশ কর্মীরা সম্রাটকে সঙ্গে করে তার মায়ের খোঁজ করে। দেখা যায় আনোয়ার শাহ রোডের মোড়েই কেঁদে কেঁদে ছেলেকে খুঁজে বেড়াচ্ছেন তার মা। মা ও ছেলেকে সঙ্গে করে পুলিশকর্মীরা থানায় নিয়ে আসেন। চারু মার্কেট থানার অফিসার ইনচার্জ সুভাষ অধিকারী মা ও ছেলের মুখ থেকে সম্পূর্ণ বিষয়টি শোনেন।
আরও পড়ুন: এবার কি হাইব্রিড মোডে চলবে রাজ্যের স্কুলগুলি? সব নজর সোমবার সকাল সাড়ে দশটায়
হালতু হাইস্কুলের প্রধান শিক্ষক বসুদীপ চৌধুরীকে ফোন করেন থানার অফিসার ইনচার্জ। চারু মার্কেট থানার অফিসার ইনচার্জ সুভাষ অধিকারী প্রধান শিক্ষকের সঙ্গে কথা বলার পর নিজেই ডায়েরি হাতে নিয়ে ছুটে যান স্কুলে। সঙ্গে নিজের গাড়িতে তুলে নেন সম্রাট ও তার মাকে। স্কুলের নিয়ম অনুযায়ী, থানায় জেনারেল ডায়েরি না করে নতুন বইয়ের সেট দেওয়া যাবে না। শিক্ষকের থেকে এ কথা জানতে পেরে ওসি শেষ পর্যন্ত নিজেই পৌঁছে যান স্কুলে। এর পরেই স্কুলের তরফে নতুন বইয়ের সেট দেওয়া হয় সম্রাটকে৷
স্কুল থেকে নতুন বই খাতা নিয়ে ফের নিজের গাড়ি করে থানায় নিয়ে আসেন সুভাষ বাবু। এই দীর্ঘ সময়ের টানাপোড়েন ও টেনশনে মা ও ছেলে দু' জনেই ক্ষুধার্ত ছিল। থানায় বসিয়ে তাদের দু'জনকেই খাওয়ানোর ব্যবস্থা করেন সুভাষ বাবু। শেষে বই খাতা নিয়ে যাওয়ার জন্য থানার পক্ষ থেকে ছোট্ট সম্রাটকে স্কুল ব্যাগ ও পেন, জ্যামিতি বক্স সহ নানান উপহার দেওয়া হয় ।
ফের চারু মার্কেট থানার গাড়ি করেই মা ও ছেলেকে কেওড়াপুকুরের বাড়িতে পৌঁছে দেওয়ার ব্যবস্থা করেন সুভাষ বাবু। সম্রাট ও তার মাকে গাড়িতে তোলার সময় সুভাষ বাবু সম্রাটের মায়ের হাতে স্কুল ড্রেসের জন্য কিছু আর্থিক সাহায্যও করেন।
পুলিশের এই ব্যবহারে আপ্লুত সম্রাট ও তার মা। সম্রাটের মা কাঁদতে কাঁদতে বলেন, 'ছেলেকে অক্ষত অবস্থায় ফিরে পেয়েছি শুধুমাত্র এর জন্যই থানার সবাইকে কী বলে যে ধন্যবাদ দেব বুঝতে পারছি না।' আর সম্রাট বলছে, 'বই না পেলে পড়তে পারব না, এই ভেবেই সব ভুলে বাসের পিছনে ছুটেছিলাম৷'
আর হালতু হাইস্কুলের প্রধান শিক্ষক বসুদীপবাবু পুলিশের ফোন পেয়েই বিস্মিত হয়েছিলেন। এই সময়ে এমন মানুষ যেন আছে যারা নিজের কাজ ফেলে স্কুলের ছাত্রের জন্য এগিয়ে আসেন? পুলিশ মানেই এখনও অনেকের কাছে কঠোর হাতে আইন শৃঙ্খলা রক্ষার দায়িত্ব পালন। সেই পেশায় থাকা একজন অফিসারের এমন মানবিক রূপ দেখে প্রশংসায় ভরিয়ে দিয়েছেন প্রধান শিক্ষক।
আর সবকিছুর পরে সুভাষ বাবু একটাই কথা বলছেন, 'ওই সময়ে সম্রাটকে দেখে মনে হচ্ছিল যদি আমার ছেলেমেয়ে এরকম বই হারিয়ে ফেলত তাহলে ওদের মনের অবস্থা কী হত?'