জামাতের রাজনীতিতে প্রবেশ:
জামাত-ই-ইসলামির শুরুটা কিন্তু অবিভক্ত ভারতে। ভারতবর্ষ স্বাধীনতা পাওয়ার আগেই, একটি সামাজিক সংগঠন হিসাবে এই ইসলামিক রাজনৈতিক দলের আবির্ভাব। ১৯৪১ সালে আবদুল আ’লা মওদুদীর নেতৃত্বে হায়দরাবাদে এই দলটি গড়ে ওঠে। ভারত ভাগের বিরোধী ছিল ইসলামপন্থী এই সংগঠন। জামাত ধীরে ধীরে রাজনৈতিক দল হিসাবে উঠে আসতে থাকে। ১৯৪৭ সালে ভারত বিভক্ত হওয়ার পর, জামাত-ই-ইসলামি পাকিস্তানে (পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তান) তাদের কার্যক্রম বর্ধিত করে। ১৯৭১ সালে যখন পাকিস্তানের থেকে আলাদা হওয়ার জন্য বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধে নামে, সেইসময় জামাত-ই-ইসলামি বাংলা জাতীয়তাবাদী ভাবনার বিরুদ্ধে গিয়ে, পাকিস্তানের হাত ধরে। জামাতের লক্ষ্য ছিল ঐক্যবদ্ধ এক মুসলিম রাষ্ট্র তৈরির। বাংলাদেশ অর্থাৎ তদানীন্তন পূর্ব পাকিস্তানের বিভক্ত হওয়া আটকাতে, জামাতের সদস্যরা পাকিস্তানের হয়ে কাজ করা শুরু করে। হয়ে ওঠে সেনাবাহিনীর সক্রিয় সদস্য।
advertisement
পাকিস্তান সেনাবাহিনী সেইসময় পূর্ব পাকিস্তান কেন্দ্রীয় শান্তি কমিটি গঠন করে, যাকে শান্তি বাহিনী বলা হয়। জামাত-ই-ইসলামির তদানীন্তন আমির গোলাম আজম ছিলেন এই শান্তি বাহিনীর প্রতিষ্ঠাতা সদস্যদের মধ্যে অন্যতম। শান্তি বাহিনীর নাম শান্তি শব্দটি থাকলেও, তারা শান্তিকামী তো ছিলই না, বরং হিংসাত্মক কর্মকাণ্ডের সঙ্গে তাদের যোগ ছিল। এই শান্তি বাহিনী পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর গুপ্তচর হিসাবে কুখ্যাত ছিল এবং মুক্তিযোদ্ধাদের উপর আক্রমণ চালানোয় এরা ছিল সিদ্ধহস্ত। পাকিস্তানের সেনাবাহিনীর তৎপরতায় জামাতের সদস্যদের মিলিত প্রয়াসে গড়ে ওঠে দুর্ধর্ষ অপরাধপ্রবণ ‘রাজাকার বাহিনী’। প্রায় ১০,৭৮৯ জন সদস্য নিয়ে গড়ে ওঠে এই রাজাকার টিম। জামাতের ‘ইসলামি ছাত্রসংঘ’-কে পাশে নিয়ে রাজাকারেরা, আল-শামস ও আল-বদর নামে দুটি দল গঠন করে। স্বয়ংসম্পূর্ণ হয়ে ওঠে রাজাকারেরা। অভিযোগ, বাংলাদেশ জুড়ে গণহত্যা, ধর্ষণ চালাতে থাকে তারা। হিন্দুদের উৎখাত করার জন্য ন্যক্কারজনক উপায়ে আক্রমণ করতে থাকে রাজাকার বাহিনী। বাঙালি বুদ্ধিজীবীদের হত্যা থেকে নারীদের সম্ভ্রম নিয়েও তারা খেলতে থাকে। লাখেরও বেশি মানুষের প্রাণ কাড়ে এই রাজাকারের দল। ১৯৭১-এর মুক্তিযুদ্ধে বাংলাদেশে হয়ে যাওয়া এই গণহত্যা পৃথিবীর ইতিহাসেও এক কালো অধ্যায় বটে।
স্বাধীনতা পরবর্তী জামাতের কার্যক্রম:
বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ শেষ হলে, বাংলাদেশ এক নতুন রাষ্ট্র হিসাবে আত্মপ্রকাশ করে। শেখ মুজিবর রহমান স্বাধীন দেশের প্রথম রাষ্ট্রপতি হিসাবে দায়ভার গ্রহণ করেন। আওয়ামি লিগ সরকার বাংলাদেশে ক্ষমতায় আসে। ১৯৭২ সালে জামাত-ই-ইসলামি রাজনৈতিক দল হিসাবে সরকারের তরফে নিষিদ্ধ বলে ঘোষিত হয়। ‘রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে ধর্মের অপব্যবহার’- এই কারণ দর্শিয়ে জামাতকে বাংলাদেশ জুড়ে কোণঠাসা করা হয়। বাংলাদেশের সংবিধানকে অস্বীকার করার জন্য, যা পুরোপুরি ধর্মনিরপেক্ষ ছিল, জামাতকে নিষিদ্ধ করার অন্যতম কারণ হিসাবে মনে করা হয়। সেইসময় জামাতের বহু নেতা দেশ ছেড়ে পালাতে বাধ্য হন, বেশ কিছু নেতা গা-ঢাকা দেন। ১৯৭৫ সালে বাংলাদেশে সামরিক অভ্যুত্থানে মুজিবর রহমান হত্যার পর, জিয়াউর রহমানের সামরিক শাসনে ১৯৭৭ সালে জামাত-ই-ইসলামির উপর থেকে সকলপ্রকার নিষেধাজ্ঞা তুলে নেওয়া হয়। বাংলাদেশের রাজনীতিতে জামাতের আবার উত্থান ঘটে। জামাতের ভোট ময়দানে প্রবেশ ১৯৮৬ সালে। বিএনপির সাথে জোট করে ২০০১ সালে জামাত-ই-ইসলামি রাজনৈতিক দল হিসাবে বাংলাদেশে তৃতীয় বৃহত্তম জায়গা পায়। বিএনপি-র সঙ্গে একজোটে লড়ে জামাতের সদস্য সেই সময় মন্ত্রিত্বও পায়। ১৯৭৭ সালে বাংলাদেশে ইসলামি ছাত্র শিবির গড়ে তোলে জামাত। মাদ্রাসা এবং বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় এরা রাজনৈতিক ভাবে কব্জা করতে শুরু করে এবং বিভিন্ন চরমপন্থী সহিংস কাজকর্ম শুরু করে, যা ছিল প্রবলভাবে অ-ইসলামিক। আওয়ামি লিগের বিরুদ্ধে এরা ছক কষে বিভিন্ন হিংসামূলক কার্যকলাপ শুরু করে। ইসলামি ছাত্র শিবিরের সঙ্গে পাকিস্তানের গোয়েন্দা সংস্থা আইএসআই-এরও ভাল সম্পর্ক ছিল বলে পরবর্তীতে জানা গেছে। রাজনৈতিক ভাবে জামাতের গুরুত্ব বাড়লেও, ১৯৯২ সালে ‘একাত্তরের ঘাতক-দালাল নির্মূল কমিটি’ গঠিত হওয়ার পর বাংলাদেশের নাগরিক সমাজ জামাত-ই-ইসলামিকে প্রত্যাখ্যান করে। একদা জামাত ক্ষমতায় থাকাকালীন এই কমিটির সদস্যরাও জামাত-ই-ইসলামির সদস্যদের দ্বারা আক্রান্তও হয়েছিলেন।
আরও পড়ুন : বাংলাদেশ নিয়ে চিন্তা বাড়ছে, তার মধ্যেই ভারতীয়দের অবিলম্বে কোন দেশ ছাড়তে বলল নয়াদিল্লি?
২০০৮ সালে আওয়ামি লিগ ক্ষমতায় আসার পর, জামাত-ই-ইসলামি ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধে তাদের হিংস্রতা এবং জাতিবিরোধী কাজকর্মের জন্য সরকারের তরফ থেকে তীব্র প্রতিক্রিয়া পাওয়া শুরু করে। ১৯৭৩ আইসিটি অ্যাক্ট ২০০৯ সালে সংশোধিত হয়। তারপরে থেকেই বাংলাদেশে জামাত-ই-ইসলামির স্থান সঙ্কটে পড়ে যায়। জামাতের শীর্ষ নেতৃত্বরা যুদ্ধাপরাধের অভিযোগে বিচারের মুখোমুখি হন। জামাতের রাজনৈতিক গতি বাংলাদেশে প্রবলভাবে বাধার মুখে পড়ে। ২০১৩ সালে বাংলাদেশ নির্বাচন কমিশন জামাত-ই-ইসলামিকে রাজনৈতিক দল হিসাবে তাদের রেজিস্ট্রেশন বাতিল করে অবৈধ ঘোষণা করে। ঢাকাতে সেই বছরেই শাহবাগ আন্দোলন হয়, যেখানে জামাতের নেতা আব্দুল কাদের মোল্লার মৃত্যুদণ্ড এবং জামাতকে নিষিদ্ধ করার দাবি ওঠে। ২০২০ সালে ‘আমার বাংলাদেশ পার্টি’ নামে নতুন এক রাজনৈতিক দলের উদ্ভব হয়, যা জামাতের বিক্ষুব্ধ প্রাক্তনীরা গড়ে তুলেছিলেন। প্রসঙ্গত, ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধে জামাত নিজের অবস্থান নিয়ে ক্ষমা না চাওয়ায় এই বিক্ষুব্ধরা দল ছেড়েছিলেন।
বাংলাদেশে পালাবদলের পর, জামাত-ই-ইসলামির রাজনীতির আঙিনায় আবার স্বমহিমায় প্রত্যাবর্তন রাজনৈতিক বিশেষজ্ঞদের ভাবাচ্ছে। ইতিমধ্যেই জামাতের বেশ কিছু সদস্য মহম্মদ ইউনূসের অন্তর্বর্তী সরকারের উপদেষ্টামণ্ডলীতে স্থান পেয়েছে। সবথেকে বড় বিষয়, জুলাই মাসে বাংলাদেশে হিংসা ছড়ানোর জন্য জামাত ভীষণভাবে দায়ী হলেও এই রাজনৈতিক দলের উপর থেকে সমস্ত নিষেধাজ্ঞা তুলে নেওয়া হয়েছে। জামাত ও অন্যান্য ইসলামিক দলগুলি বর্তমানে গণতান্ত্রিক রূপে নিজেদের তুলে ধরার জোরদার চেষ্টা চালাচ্ছে। জামাতের ছাত্র সংগঠনও নিজেদের প্রগতিশীল হিসেবে তুলে ধরার চেষ্টা করছে। তবে জামাত-ই-ইসলামির বাংলাদেশে আবার এই পুনর্জন্ম নিয়ে সাধারণ জনগণকে সাবধান থাকতে হবে। আন্তর্জাতিক দিক থেকে দেখলে জামাত-ই-ইসলামির সঙ্গে বিশ্বের চরমপন্থী ইসলামি সংগঠনগুলির যোগাযোগ রয়েছে। যা একদমই ঠিকভাবে দেখছে না রাজনৈতিক বিশেষজ্ঞরা। বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে জামাতের হিংসাত্মক কাজের অনেক প্রমাণই রয়েছে। এখন যদি জামাত পাকিস্তানের সঙ্গে সেইসময় হাত মেলায়নি বলে দাবি করে, তাহলে তা লক্ষ লক্ষ মুক্তিযোদ্ধাদের ত্যাগ-তিতিক্ষাকে ধুলোয় মিশিয়ে দেবে, এই নিয়ে কোনও সংশয় নেই।
(লেখক পরিচিতি: বিশিষ্ট লেখক ও কলামনিস্ট অরুণ আনন্দ, সামাজিক ও রাজনৈতিক বিভিন্ন বিষয়ে নিয়মিত লেখালেখি করেন। তার লেখা প্রবন্ধ ও বই পাঠকমহলে ব্যাপকভাবে সমাদৃত হয়েছে। আপনি তাকে তার X (সাবেক টুইটার) হ্যান্ডেল @ArunAnandLive -এ অনুসরণ করতে পারেন।)