কলেজ স্কয়ারের উল্টোদিকে কর্পোরেশনের গায়ে লাগানো যে সরু গলি, তার শেষ মাথায় রয়েছে বসুমল্লিকদের আদি বাড়ি ৷ সারা বছর আজ মুখ লুকিয়ে থাকা সেই বাড়িটার শরীরে এখন আভিজাত্যের রক্ত একটু চনমনে, কার্নিশের মিঠে রোদ গড়িয়ে নামছে সদ্য চুনকাম করা ঠাকুরদালানের থামে ৷ মায়ের গায়ে রং পড়ছে...এক পোঁচ..দু’পোঁচ ৷ আরও একবার তৈরি হচ্ছে বাড়িটা... তৈরি হচ্ছে অতীতের ধূলোগুলো... মন খারাপে একা পড়ে থাকা পলেস্তরারা ৷
advertisement
মধ্য কলকাতার অন্যতম প্রাচীন বনেদি পরিবার এঁরা। যা ইতিহাস পাওয়া যায়, তাতে সমাজ-সংস্কারক গোপীনাথ বসুর (পুরন্দর খাঁ) উত্তরপুরুষ। গোপীনাথ এবং তাঁর ভাই বল্লভ পাঠান সুলতানি দরবার থেকে ‘মালিক’ উপাধি লাভ করেন। কালক্রমে ওই ‘মালিক’ ‘মল্লিক’-এ রূপান্তরিত হয়। এই বসুমল্লিকদের একটা শাখা হুগলি জেলার পাণ্ডুয়ার কাছাকাছি কাঁটাগড় গ্রামে চলে যায়। এই পরিবারের রামকুমার বসুমল্লিক ১৭৯৪-এ কলকাতার পটলডাঙার জনৈক কৃষ্ণরাম আইচের কন্যা শঙ্করীকে বিবাহ করে কলকাতায় এসে বসবাস আরম্ভ করেন। রামকুমার-শঙ্করীর পুত্র রাধানাথ (১৭৯৮-১৮৪২) এই পটলডাঙা (অধুনা কলেজ স্কয়ার) বসুমল্লিক পরিবারের প্রাণপুরুষ।
বসুমল্লিকদের রমরমা রাধানাথের আমল থেকেই ৷ সালকিয়ার ‘হুগলি ডক ইয়ার্ড’-এর প্রতিষ্ঠাতা রাধানাথ জাহাজ ও অন্যান্য ব্যবসা করে প্রভূত অর্থ উপার্জন করেন। তিনি ১৮৩১-এ সাবেক পঞ্চাননতলা লেনে ঠাকুরদালান-সহ ভদ্রাসন নির্মাণ করেন (বর্তমান ঠিকানা ১৮এ, রাধানাথ মল্লিক লেন।) দুর্গাপুজো আরম্ভ করেন। সেই থেকে আজও ওই ঠাকপরদালানেই মায়ের আরাধনা করে আসছেন বর্তমানে রামকুমার থেকে সপ্তম প্রজন্মের বংশধররা ৷ একসময় স্বদেশী আন্দোলনের পুরভাগে এগিয়ে এসেছিলেন এ বাড়ির সদস্যরা ৷ রাজনৈতিক আঙিনাতেও ছিল তাঁদের সাবলীল আনাগোনা ৷ স্বদেশি-যুগের কংগ্রেসের চরমপন্থী দলের অন্যতম নেতা রাজা সুবোধচন্দ্র মল্লিক এই পরিবারের সন্তান। স্বদেশি-আন্দোলনের সময়ে, ১৯০৫-এর ২৭ অক্টোবর, রবীন্দ্রনাথ এই এই ঠাকুরদালানেই এক ছাত্রসভায় বক্তৃতা দিয়ে গিয়েছেন। কথক নৃত্য-বিশেষজ্ঞ নরেন্দ্রচন্দ্র বসুমল্লিকও এই পরিবারের সন্তান। তিনি ছিলেন এলাহাবাদ সঙ্গীত সম্মেলনের কথক নৃত্যের প্রথম বাঙালি বিচারক।
রাধানাথ প্রতিষ্ঠিত আদি বাড়ির পুজোটি ছাড়াও ২২, রাধানাথ মল্লিক লেন এবং ৪৬ শ্রীগোপাল মল্লিক লেনে এই পরিবারের আরও দুটি শরিক-বাড়িতে এখনও দুর্গাপুজো হয়। ওই দুই বাড়ির ঠাকুরদালান দুটি ঢালাই লোহার কারুকার্য খচিত। প্রতিটা বাড়িতেই একইরকম ঠাকুর হয় ৷ একচালার প্রতিমার গায়ে উজ্জ্বল বাসন্তী রং, ঘোটকাকৃতির সিংহ এখানকার বৈশিষ্ট্য ৷ আগে হত ডাকের সাজ ৷ পরে এই বাড়িরই এক গিন্নি মানত করে মা’কে বেনারসী পরানোর চল শুরু করে ৷ এখন দুই মেয়ে-সহ মা’কে পরানো হয় বেনারসী শাড়ি ৷ বিসর্জনের পর সযত্নে রেখে দেওয়া হয় সেই বেনারসী ৷ এই বেনারসী পরেই বিয়ে হয় বাড়ির মেয়েদের ৷ আবার পুত্রবধূরাও ফুলশয্যায় সেই শাড়িই পরেন ৷ পুজো শুরু মহালয়ার পরের দিন থেকে ৷ সেই সময় বেল-কাণ্ডকে দেবী রূপে কল্পনা করে বোধন আরম্ভ হয়। মহাষষ্ঠীর বরণের পর আরম্ভ হয় মূল প্রতিমায় পুজো। বসুমল্লিক বাড়ির পুজোর অন্যতম বৈশিষ্ট্য হল কলাবউ স্নান। এখানে কিন্তু গঙ্গাস্নানে যান না নবপত্রিকা ৷ আগে থেকে সংগ্রহ করে রাখা সাততীর্থের জল আপ পদ্মরেণু দিয়ে সহস্রধারায় স্নান করানো হয় কলাবৌকে ৷ তারপর মায়ের পাশে কলাবৌকে প্রতিষ্ঠা করা হয় ৷
পুজোর ক’টা দিন যৌথ পরিবারের সদস্যদের হাসি কলোরবে মেতে থাকে বাড়ি ৷ মহাষ্ঠীর দেবী বরণ, সন্ধিপুজোয় ও মহানবমীর চালকুমড়ো বলির সময়ে বন্দুক ফাটানো এ বাড়ির রেওয়াজ ৷ বলির পর কাদামাটি খেলার অদ্ভুত এক প্রথা রয়েছে এখানে ৷ অব্রাহ্মণ পরিবার বলে পুজোয় অন্নভোগের আয়োজন করা হয় না! তার পরিবর্তে গোটা ফল, গোটা আনাজ, শুকনো চাল, নানা ধরনের মিষ্টি ইত্যাদি ভোগ দেওয়া হয়। অতীতে পশুবলির চল থাকলেও বর্তমানে তা বন্ধ। এখানে প্রতিপদ থেকে দশমী পর্যন্ত প্রতিদিনই হয় সিঁদুর খেলা ৷ দু’টি খুঁড়িতে রাখা হয় সিঁদুর ৷ একটা মা দুর্গার লাল সিঁদুর, অন্যটায় মা চণ্ডীর মেটে সিঁদুর ৷ এই দুই সিঁদুর দিয়ে প্রতিদিনই সিঁদুর খেলেন বাড়ির এয়োস্ত্রীরা ৷
নবমীর দিন দেবীর শেষ আরতি ৷ বাড়ির সদস্যরা বলেন, ওই দিন চোখ ছলছল করে ওঠে মায়ের ৷ বাপের বাড়িকে বিদায় জানানোর কষ্টে চিনচিন করে ওঠে তাঁর বুক ৷ আবার একটা বছরের অপেক্ষায় দিন গুণতে থাকে বসুমল্লিক পরিবার ৷
ছবি: বসুমল্লিক পরিবারের সৌজন্যে
