আমি আর বাবা অপেক্ষা করছিলাম রবীন্দ্রসদনের গ্রিনরুমে। মেঝেয় সাদা ধবধবে ফরাস পাতা, যেমনটা এ ধরনের অনুষ্ঠানের চল আর কী। কয়েকখানা কোলবালিশও যেন ছিল। ঠিক মাঝখানটিতে আলো ক’রে বসে আছেন তিনি। পণ্ডিত রবিশংকর। ‘আলো ক’রে’ বিশেষণটা খুব ভেবেচিন্তেই লিখলাম, কেননা একজন মানুষের উপস্থিতি যে অতখানি ঔজ্জ্বল্য আনতে পারে, তা না-দেখলে বিশ্বাস করা কঠিন। বাজনা তো বাজনাই। সে-কথা প্রশ্নাতীত। কিন্তু তার বাইরেও একজন শিল্পীর অবয়ব, ভঙ্গিমা, ধরণ ও ভাব যে এমন বলয় তৈরি করতে পারে, তা অলীকই একরকম। সব শিল্পীর ক্ষেত্রে তো ঘটে না এমন, কারও কারও ক্ষেত্রে ঘটে যায়। উনি ছিলেন তেমনই একজন, বুঝেছিলাম সেদিন।
advertisement
যেমন দেখেছিলাম, বসে আছেন মাঝখানটিতে, তাঁর সেতার নামিয়ে রেখেছেন সামনে। এপাশ ওপাশ তাকিয়ে দু’একজনের সঙ্গে এক আধটা হাসি বিনিময় বা বাক্যালাপ চলছে, কিন্তু দেখে বোঝা যাচ্ছে, সেতারের সঙ্গে নামিয়ে রেখেছেন মনও। সেও, ওই সেতারের মতোই, তৈরি হচ্ছে বেজে ওঠবার জন্য। ডান হাতের তর্জনীতে পরে থাকা মিজরাফটা কেবল ঘুরিয়ে চলেছেন হাসিকথার ফাঁকে ফাঁকে। সেও, তৈরি হচ্ছে তখন। পরে মামা বা মা’র সঙ্গ করতে গিয়ে বুঝেছি, অনুষ্ঠানের ঠিক আগমুহূর্তে শিল্পী আসলে নিজের মধ্যে থাকেন না। অনেক আগেই তিনি ঢুকে যান গানে বা বাজনায়, যা আমরা অনেক পরে শুনতে পাই মঞ্চে। সেদিন ছিল তেমনই এক সময়।
চারপাশে ঝমঝম করছে অনুরাগীদের ভিড়, তারই মাঝে জায়গা করে আমাকে নিয়ে ঢুকেছেন বাবা। ‘চলো, তোমার সঙ্গে আলাপ করিয়ে দিই’। এ ব্যাপারটা বাবার চিরকেলে অভ্যেস, আমারও ধাতে এসে গেছে ততদিনে। যেসব গুণী মানুষদের সঙ্গে বাবার অনাবিল যোগাযোগ, সুযোগ পেলে তাঁদের সামনে নিয়ে যেতেন আমায়। আমি বরাবরের কুণ্ঠিত প্রাণ, কিন্তু সেসব শুনতেন না বাবা। বলতেন, ‘এসব শিল্পীদের সংস্পর্শে আসতে পারছ, এটা মনে রেখো’। সেই মনে রাখার দায় নিয়ে আমি বাবার হাত ধরে ঘুরেছি সর্বত্র। খবরকাগজের দফতর থেকে প্রেক্ষাগৃহের সাজঘর। লেখক থেকে শিল্পীদের একবার কাছ থেকে দেখে নিতে।
সেদিন অবশ্য দেরি হয়ে গেছে পৌঁছতে। বহুদিন পর কলকাতায় বাজাবেন রবিশংকরজী, রবীন্দ্রসদনে একক অনুষ্ঠান তাঁর। বাবা অফিস থেকে বাড়ি ফিরে আমাকে নিয়ে ছুটেছে। তখন যুগান্তর পত্রিকার যুগ্ম সম্পাদক বাবা, তাছাড়া সংগীত বিভাগের দায়িত্বও তাঁরই কাঁধে। তাই কলকাতায় বড়সড় গানবাজনার অনুষ্ঠানে বাবার হাজিরা ছিল পাকা। আর সেই হাজিরার হাত ধরে আমার খুদে উপস্থিতিও বাদ যেত না। তো, বিকেল নাগাদ বাড়ি থেকে বেরিয়ে ছুট। ট্যাক্সি চড়বার সামর্থ্য তখন কই। গড়িয়া থেকে এস সেভেন নামের বাস ধরে সোজা রবীন্দ্রসদন। কিন্তু গ্রিনরুমের দরজা ঠেলে ঢুকছি যতক্ষণে, যন্ত্র মেলানো শেষ। পাশে বসা তরুণ তবলিয়া পণ্ডিত কুমার বোস তবলা ঢাকা দিয়ে রাখছেন। আর ওই যে, নিশ্চিন্ত সেতার, যেন কিছুই জানে না এমন ভাব ক’রে, শুয়ে আছে রবিশংকরজী’র সামনে।
গ্রিনরুমে ভিড় বাড়ছে বই কমছে না। উনিও হাসিমুখে সকলের দিকে তাকাচ্ছেন। ফোটোগ্রাফার আছেন অনেক, তাঁরাও মাঝেমধ্যে অনুরোধ করছেন লেন্সের দিকে তাকানোর জন্য। এসবের মাঝে আমাদের দিকে একবারও চোখ পড়ল কি ওঁর? ফরাস থেকে বেশ কিছুটা দূরেই, সোফার পাশে আমার হাত ধরে দাঁড়িয়ে আছেন বাবা। বুকপকেটে কলম আটকানো। আমি জানি, কাঁধের ঝোলার মধ্যে নিউজপ্রিন্ট-এর প্যাডও আছে। মঞ্চে সেতার চললে অন্ধকারের মধ্যে খসখস বাবার কলমও চলবে। কিন্তু দেখা? পণ্ডিত রবিশংকরের সঙ্গে দেখা করতে পারব কি আমি? বাবার তো অনেকদিনের চেনা। নানা সূত্রে। পেশাগত পরিচয় একরকম। আরেকরকম অবশ্যই সংগীতাচার্য তারাপদ চক্রবর্তী’র জামাতা হবার সুবাদে। সুতরাং দুশ্চিন্তা কেবল আমার একার।
অন্ধ ভরসায় বাবার হাত ধরে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকবার পর রবিশংকরজী উঠে দাঁড়ালেন ফরাসের উপর। আলো দ্বিগুণ হল গ্রিনরুমে। অনেকে বসেও ছিলেন তাঁকে ঘিরে, সেইসব শ্রোতা অনুরাগীর দলও উঠে পড়লেন এক ঝটকায়, সম্ভ্রমে। তখন, সে আমলে, সম্ভ্রম ব্যাপারটা মজ্জাগত ছিল, এমন ঘাড় ধরে আদায় করবার বিষয় হয়ে ওঠেনি। কুমার বোস এক দফা বেরোলেন, সম্ভবত ধূমপানের তাগিদেই। ভিড় কিছুটা ছত্রভঙ্গ হল। আর আমাকে অবাক করে দিয়ে, গেরুয়া কুর্তার কাঁধে সাদা শাল আলগোছে ফেলে নিয়ে এগিয়ে এলেন স্বয়ং তিনি। হ্যাঁ। আমাদের দিকেই। এবারের হাসিটা, বোঝা যাচ্ছে, ফোটোগ্রাফারদের জন্য নয়।
‘কেমন আছ, তপন? শ্রীলা ভাল আছে?’ বাবা একটু এগিয়ে গিয়ে প্রণাম করামাত্র বাবার কাঁধে একখানা মৃদু চাপড় দিয়ে প্রশ্ন করলেন তিনি। আমি ঠিক দু’ফুটের মধ্যে দাঁড়িয়ে আছি তাঁর। বয়স কত তখন আমার? বড়জোর ক্লাস সিক্স কি সেভেন। কিন্তু হু হু করে কানে বাজছে এত এত দিন ধরে শুনে আসা তাঁর সমস্ত বাজনার লং প্লেয়িং আর ক্যাসেটের প্রতিধ্বনি। ছবিতে হাজারবার দেখার পর একদিন জঙ্গলে বেড়াতে এসে হাতের সামনে বাঘ দেখে ফেললে মানুষ যেমন নিথর হয়ে যায়, আমার অবস্থা তখন তেমন। ‘এটি কে? পুত্র?’ সেই মিষ্টি গলায় আলতো উচ্চারণে ততক্ষণে প্রশ্ন করছেন তিনি। আমাকে বলতে হল না। অভ্যাসবশত এগিয়ে গিয়ে প্রণাম করলাম, কোলাপুরি নাগরা পরেছিলেন একখানা, আজও মনে আছে। মাথায় হাত রাখলেন একবার। চুলের মধ্যে বিলি কেটে গেল নিঃশব্দ মিজরাফ। বহু সুরেলা ইতিহাস যার খোদাই করা হয়ে গেছে ততদিনে।
‘বোসো, বোসো’ – বলে নিজেও বসলেন বাদামী ঢাউস সোফায়। পাশেই বাবা, বাবার পাঞ্জাবির হাতা কুঁচকে মুঠোয় ধরে আমি। সংকোচে, শ্রদ্ধায়, বিস্ময়ে। ‘আর, কলকাতার সব খবর কীরকম?’ বাবা দু’এক কথায় উত্তর দিলেন। আমি তখন বাবাকে ঠেলছি ক্রমাগত, এই অনুষ্ঠানে আসব বলেই সইয়ের খাতা কিনেছি সকালে, পাড়ার বই-দোকান থেকে। কিন্তু সে-কথা আমি নিজেমুখে বলতেই পারব না। রেগে যান যদি? শেষমেশ বাবাই অনুরোধ রাখলেন, আমার নতুন খাতায় সই দিয়ে উদ্বোধন করে দেবার জন্য। হাসিমুখে হাত বাড়ালেন তিনি, আমি পকেট থেকে বার করে তুলে দিতেই প্রথম পাতায় বড় বড় বাংলা হরফে লিখে দিলেন, ‘রবিশংকর’। ব্যাস। গোলাপি পাতায় নীল কালির সেই সই আজও আমার সম্পদ হয়ে আছে। থাকবে চিরকাল।
ততক্ষণে আয়োজকরা এসে গেছেন গ্রিনরুমে, ঘোষণা হয়ে গেছে, এবার স্টেজে যেতে হবে। কলকাতা অপেক্ষা করে আছে, বহুদিন পর আবার তাঁকে শুনবে বলে। আরও একবার ঘরের আলো বাড়িয়ে উঠে দাঁড়ালেন তিনি, সঙ্গে আমরাও। যে-প্রশ্নটা আমার মাথায় ঘুরছিল এতক্ষণ, বাবা সেটা কীভাবে যেন করে ফেললেন। ‘আজ কী বাজাচ্ছেন?’ অল্প একটু হেসে বললেন, ‘আজ একটু মারুবেহাগ শোনাই, কেমন?’ তারপর এগোলেন দু’এক পা, আমরাও পছন পিছন এগোচ্ছি, হঠাৎ ফিরে বাবার কাঁধে হাত রেখে বললেন, ‘ভাল লাগলে লিখো তপন। ভাল না লাগলেও সেটা লিখো। আজকাল তো তেমন সমালোচনা চোখে পড়ে না’... ব’লে এগিয়ে গেলেন মঞ্চের দিকে, শুয়ে থাকা সেতারটিকে হাতে জড়িয়ে নিয়ে।
তখন এই বাক্যকে সাধারণ বলেই মনে হয়েছিল। আজ ভাবি এর দাম কতখানি। তার পরদিন কলকাতার কোনও কাগজ বাদ ছিল না এই অনুষ্ঠানের ছবি ও আলোচনা ছাপতে। এবং বলা বাহুল্য, আলোচনা মানে কেবল মুগ্ধতাই। কেননা পণ্ডিত রবিশংকরের বাজনা তখন সেই উচ্চতাকে ছুঁয়ে ফেলেছে, যা শুনতে পাওয়াটাই সৌভাগ্যের। সেই শিখরে দাঁড়িয়ে, একঘর লোকজনের সামনে, আমার মতো একজন খুদেকে সাক্ষী রেখে এক তরুণ সংগীত সমালোচককে এ কথা তিনি বলছেন যে, ‘ভাল না লাগলেও সেটা লিখো’। ওই উচ্চতা থেকে এ কথা বলবার জন্য যে-সহবত, যে-বিনয়, বা যে-আন্তরিকতা দরকার, আমরা তা হারিয়েছি। এমন শিল্পীর কোটিভাগের এক ভাগ হবার যোগ্যতা না-থাকা সত্ত্বেও আজ আমরা নিজেদের প্রশ্নাতীত মনে করবার স্পর্ধা পেয়ে গেছি। এখানেই শিল্পীর সঙ্গে কারিগরের তফাত তৈরি হয়ে যায়।
সেদিন সন্ধের মতো মারুবেহাগ আমার স্মৃতিতে নেই। কীই বা বুঝতাম তখন গানবাজনার, আজই বা কতটুকু বুঝি। কিন্তু স্মৃতি থেকে যেতে চাইছে না বাজনা, এটুকু তো বুঝি অন্তত। তারপর অসংখ্য বার তাঁকে সামনে থেকে শোনার সুযোগ হয়েছে। কিন্তু এতগুলো বছর পার করে সেই সন্ধের মারুবেহাগ আজও থেকে গেছে আমার মধ্যে, সেই গোলাপি খাতায় নীল কালির সইয়ের মতো। মাঝেমধ্যে আমার সন্দেহ হয়, কোনটা ওঁর সই। যেটা কাগজে লিখে দিয়েছিলেন, নাকি যেটা মঞ্চে শুনিয়েছিলেন?
আজ সবে শতবর্ষে পা রাখলেন পণ্ডিত রবিশংকর। এমন আরও বহু শতক তাঁকে হেলায় পার করতে হবে। আমাদের সহস্রকোটি ব্যর্থ জীবনের উড়ে যাবার ওপর স্তম্ভের মতো ছায়া ফেলে রাখতে হবে তাঁকে, তাঁর অবিনশ্বর সংগীতকে। আজ বুঝি, বাবা কেন টেনে টেনে নিয়ে যেতেন এঁদের কাছে। আমার ভবিষ্যতের জন্য মনে রাখবার মতো অতীত তৈরি করে দেবার তাগিদেই ঘুরতেন আমাকে সঙ্গে করে। আজ এই মাঝবয়সে এসে চোখ বুজলে যে শুনতে পাই সেই মারুবেহাগের দুই মধ্যমের টানাপোড়েন, আর দেখতে পাই মিজরাফ-পরা একখানা তর্জনী, যার নির্দেশে লহমায় পাল্টে যায় রাগরাগিণী, সে-ই আমার জীবনের সঞ্চয়।
আমরা তো থাকব না কেউ। আমাদের কিছুই থাকবে না। কিন্তু যতদিন সন্ধে নামবে, মারুবেহাগ থেকে যাবে। এক সন্ধের আয়ু থেকে তার ছায়া দীর্ঘ হতে থাকবে শতক পেরিয়ে, হয়তো বা সহস্রাব্দের দিকে। তারও যে মৃত্যু নেই কোনও...