TRENDING:

সে কালের রাজনীতিতে ভূমিকা ছিল বিরাট, ভোটের আগে অন্য চিত্র কৃষ্ণনগর রাজবাড়িতে

Last Updated:

কৃষ্ণনগর পরিক্রমা ১: কৃষ্ণনগরের রাজনৈতিক ইতিহাস খুবই বৈচিত্র্যময়। আর সেই ইতিহাসে এই রাজবাড়ির ভূমিকা অনস্বীকার্য। খুব কাকতালীয় আর খুব গুরুত্বপূর্ণভাবে এই রাজবাড়ি একাধারে বাংলার পরাধীনতা আবার স্বাধীনতা দুই ক্ষেত্রেই উল্লেখযোগ্য ভূমিকা নিয়েছে।

impactshort
ইমপ্যাক্ট শর্টসলেটেস্ট খবরের জন্য
advertisement
#কৃষ্ণনগর: কৃষ্ণনগর...ঐতিহ্য আর বনেদিয়ানার মেলবন্ধন । বর্ধিষ্ণু এই শহরের গলিঘুঁজিতে ঘুরে বেড়ালে সরভাজার কড়া পাকের গন্ধ, মাটির পুতুলের গভীর চোখের তারায় আশ্চর্য সূক্ষ্মতা আর সুদূর বিস্তৃত ফাঁকা মাঠের শেষপ্রান্তের ওই নাটমন্দির-নহবতখানা- বিষ্ণুমহল জানান দিয়ে যায় অতীতের কিছু অন্ধকার আর কিছু গৌরবময় ইতিহাসের পাঁচালি । সোনাপট্টির সরু গলির শেষে শতাব্দী প্রাচীন গোয়াড়ি বাজারের মুখে রাস্তা জুড়ে দাঁড়িয়ে থাকা বিশালাকার ষাঁড়, সদ্য জলঙ্গী (যার ডাক নাম খরে) থেকে ধরে আনা তাজা খয়রা মাছ নিয়ে দর হাঁকাহাঁকি কিছুটা হলেও এই মফঃস্বলের অন্যরকম গল্পটাকে চিনিয়ে দিয়ে যায়।
advertisement

এই শহরটায় এখন বৈশাখী ব্যস্ততা । ব্যস্ততা রাজবাড়ি, আর তার সংলগ্ন মেলাটি ঘিরে। বারোদোলের মেলা। এই শহরের আরও এক পুরনো যুগের রেশ টেনে ধরে রেখেছে এই মেলা। শহরের মূল রাস্তা, যেটা কৃষ্ণনগর থেকে বগুলার দিকে চলে যাচ্ছে...সেই রাস্তার উপরেই রয়েছে রাজবাড়ির চক।

advertisement

ডাকদিকে এগোলেই বিশাল মাঠ। মাঠ শুরু হচ্ছে চকবাড়ি থেকে। এক সময় এখানে একটা মেয়েদের স্কুল ছিল। মহারানি জ্যোতির্ময়ীর নামে সেই স্কুলের নাম ছিল মহারানি জ্যোতির্ময়ী বালিকা বিদ্যালয়। এখন অবশ্য পোড়ো বাড়ি হয়েই পড়ে রয়েছে । চকবাড়ি থেকে কিছুটা এগোলেই নহবতখানা। শ্যাওলামাখা গা বেয়ে নোনা জলের ধারা, আর ঘুঘুর বসবাস সেখানে। নহবতখানার পাশেই রাজবাড়ির পুকুর। সেই পুকুরও প্রায় মৃত্যুশয্যায় বলাই ভাল। তবু এখনও এই পুকুরের তাৎপর্যটি আছে ষোলো আনা। এখনও রাজবাড়ির ঠাকুর ভাসান হয় নিজস্ব এই পুকুরের ঘাটেই। দুর্গাপুজো আর জগদ্ধাত্রী পুজোর সময় দলে দলে মানুষ আসেন সেই শোভাযাত্রা দেখতে। নহবতখানাকে বাঁয়ে রেখে এগোলে ডান হাতে পড়বে নাটমন্দির।

advertisement

রাজবাড়ির মাঠে এখন বসেছে বারোদোলের মেলা।

পঙ্খের কাজ করা এই নাটমন্দির দেখলে এখনও চোখ ফরানো যায় না। আর নাটমন্দিরের বাঁহাতে রাজবাড়ির মূল ফটক। নাটমন্দিরের ভিতর দিয়েও সাজানো সরু পথ রয়েছে মূল রাজবাড়ির দিকে। তবে সেই পথ একেবারেই পরিবারের লোকেদের ব্যবহারের জন্য। বছরের কয়েকটি বিশেষ তিথিতে সাধারণের জন্য খোলা থাকে এই নাটমন্দির। যেমন একটা হল বারোদোলের মেলা। এছাড়া দুর্গা পুজো, জগদ্ধাত্রী পুজো তো আছেই। বারোদোল বসে চৈত্র মাসের শুক্লা একাদশী তিথিতে। চলে টানা এক মাস। মোটামুটি ভাবে রংদোলের পর এক মাসের মাথায় এই মেলা শুরু হয়। কৃষ্ণনগরের রাজনৈতিক ইতিহাস খুবই বৈচিত্র্যময়। আর সেই ইতিহাসে এই রাজবাড়ির ভূমিকা অনস্বীকার্য। খুব কাকতালীয় আর খুব গুরুত্বপূর্ণভাবে এই রাজবাড়ি একাধারে বাংলার পরাধীনতা আবার স্বাধীনতা দুই ক্ষেত্রেই উল্লেখযোগ্য ভূমিকা নিয়েছে। ইতিহাসের পাতা একটু উল্টে দেখা যাক, নদিয়ার রাজবাড়ির প্রাণপুরুষ ছিলেন ভবানন্দ মজুমদার। বাংলা বিজয়ে মানসিংহকে সাহায্য করার জন্য পুরস্কার হিসাবে সম্রাট জাহাঙ্গীরের কাছ থেকে তিনি সম্মান লাভ করেন। সঙ্গে পান নদিয়া, সুলতানপুর, মারুপদহ,মহৎপুর,লেপা,কাশিমপুরের মতো ১৪টি পরগনা। ভবানন্দ নদিয়ার কৃষ্ণগঞ্জ থানার মাটিয়ারিতে রাজধানী স্থাপন করেছিলেন | পরবর্তীতে নদিয়ারাজ রুদ্র রায় নবদ্বীপ ও শান্তিপুরের কাছে রেউই গ্রামে রাজধানী স্থানান্তরিত করেন। পরে এই রেউই-এর নাম হয় 'কৃষ্ণনগর'। নদিয়ার রাজবংশের শ্রেষ্ঠ রাজা বলা হয় কৃষ্ণচন্দ্র রায়কে। মাত্র ১৮ বছর বয়সে ১৭২৮-এ তিনি রাজা হন। তাঁর রাজত্বকালে ফুলে ফেঁপে ওঠে রাজ্য।

advertisement

ঠাকুরদালানে মা দুর্গা এবং রাজবাড়ির কূলদেবতা ৷ ছবি: ফেসবুক ৷

সে সময় রাজ্যের পরগনার সংখ্যা বেড়ে দাঁড়ায় ৮৪ টি আর রাজ্যের পরিধি ছিল ৮৫০ ক্রোশ। ভারতের স্বাধীনতার সূর্য অস্ত যায় ১৭৫৭ সালের ২৩ শে জুন পলাশীর মাঠে, ইংরেজদের কাছে সিরাজের হারের সঙ্গে সঙ্গে । আর দেশের সেই পরাধীনতার লজ্জাজনক ইতিহাসের সঙ্গে জড়িয়ে রয়েছে কৃষ্ণনগর রাজবাড়ির নাম। ১৭৫৬ সালে আলিবর্দি খাঁ-র মৃত্যুর পর বাংলার সিংহাসনে বসলেন তাঁরই দৌহিত্র সিরাজ-উদ-দোল্লা। অল্প বয়সে রাজকর্ম হাতে পেয়ে আর বয়সের দোষে রাজকর্মচারীদের চক্ষুশূল হলেন সিরাজ। জগৎ শেঠের নেতৃত্বে সিরাজকে সরানোর চক্রান্ত শুরু হল। সেই দলে সামিল হয়েছিলেন কৃষ্ণচন্দ্রও। শোনা যায়, ব্রিটিশ সরকারকে পত্রযোগে পরামর্শদান করেছিলেন তিনি। শুধু তাই নয়, ব্রিটিশকে সৈন্য দিয়েও সাহায্য করা হয়েছিল কৃষ্ণনগর রাজবাড়ি থেকেই। যার পরিণাম হল পলাশীর যুদ্ধ। পলাশীর প্রান্তরে সিরাজবাহিনী পরাস্ত হল আর তারপর মীরজাফর পুত্র মীরণের তত্ত্বাবধানে হল সিরাজহত্যা। এখান থেকেই শুরু হল ২০০ বছর অন্ধকার শৃঙ্খলের ইতিহাস।

advertisement

২০০ বছর পর আবার এই কৃষ্ণনগর রাজবাড়িই একদিন স্বাধীন করল জন্মভূমিকে। সেই ইতিহাস লোকবিষ্ম‌ৃত হলেও কম গৌরবময় নয়। ১৯৪৭ সালের ১৫ অগস্ট স্বাধীন হল দেশ। কিন্তু সে সময় কোনও আনন্দ অনুষ্ঠান পালিত হল না কৃষ্ণনগরের বুকে। বিনিদ্র রজনী তখন উৎকণ্ঠার প্রহর গুণছে। নদিয়া, মুর্শিদাবাদ, মালদহ ও পশ্চিম দিনাজপুর এই চারটি জেলার এবং বনগাঁ থানা এলাকার মানুষ স্বাধীনতার আনন্দ উৎসবে অংশ নিতে পারেননি সেদিন। ভারত না পাকিস্তান – কোন দেশের মধ্যে তাঁরা থাকবেন এই অনিশ্চয়তা নিয়েই তখন দিন কাটছে তখন। সে সময় ১৯০৫ সালে বঙ্গভঙ্গের সময় আঁকা মানচিত্রকে ভিত্তি করে একটি মানচিত্র তৈরি হল। এই মানচিত্র অনুযায়ী দিনাজপুর, মালদহ, মুর্শিদাবাদ, নদিয়া, যশোহর এবং বনগাঁ থানাকে ‘পূর্ববঙ্গ’এর মধ্যে ধরা হয় । যদিও বলা হয় Bengal Boundary Commission এর পেশ করা রিপোর্টের উপরই চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে।

৩০ জুন ১৯৪৭ গভর্নর জেনারেলের ঘোষণা(Ref. No.D50/7/47R) অনুযায়ী Sir Cyril Radcliffe কে চেয়ারম্যান করে পাঁচ জনের Bengal Boundary Commission গঠিত হয় । ৩০ জুন থেকে ১৪ অগস্ট ১৯৪৭ মাত্র ৪৫ দিন হলেও প্রকৃত পক্ষে ১৮ জুলাই ১৯৪৭ থেকে ১২ অগস্ট ১৯৪৭ মোট ২৫ দিন কমিশন হাতে পায় । আর সাক্ষ্য গ্রহণের জন্য ১৬ থেকে ১৯ এবং ২১ থেকে ২৪ জুলাই ১৯৪৭ মাত্র ৮ দিন পাওয়া যায়। ১২ অগস্ট ১৯৪৭ Radcliffe রিপোর্ট পেশ করেন। ১৪/১৫ অগস্ট ১৯৪৭ মাঝরাতে যথারীতি দ্বি-খন্ডিত স্বাধীনতা ঘোষিত হল ।১৯০৫ সালের আঁকা মানচিত্রকে রিপোর্টে পেশ করা হয়েছে বলে সুকৌশলে প্রচার করে মুসলিম লিগ ময়দানে নেমে পড়ে । ১২ অগস্ট ১৯৪৭ থেকে ১৪/১৫ অগস্ট ১৯৪৭ স্বাধীনতা ঘোষনা মাঝের মাত্র দুদিনে মানুষ Radcliffe রিপোর্টের সঙ্গে পেশ করা নতুন মানচিত্র সম্পর্কে ওয়াকিবহাল ছিলেন না । ১৫ অগস্ট সকালে মুসলিম লিগ মিছিল মিটিং করে পাকিস্থানের পতাকা উত্তোলন করে। এতেই বিভ্রান্ত হন সাধারণ মানুষ। বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে Radcliffe রিপোর্ট ধীরে ধীরে পরিষ্কার হতে থাকে । শুরু হয় তৎপরতা।

রাজবাড়ির দরবারহল ৷ নিজস্ব চিত্র ৷

বিভিন্ন রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ, মহারানি জ্যোতির্ময়ী দেবী, মুর্শিদাবাদের ওয়াসেদ আলী মীর্জা সহ নানা স্তরের ব্যক্তিত্বের তরফ থেকে রাজ্য ও সর্ব ভারতীয় স্তরে যোগাযোগ করা শুরু হয়। ১৬ অগস্ট তৎপরতা তুঙ্গে উঠে । কিন্তু ১৪ অগস্টের বেতার বার্তা শুনে তো সবার মাথায় হাত। কৃষ্ণনগর ও রাণাঘাট পাকিস্তানের অন্তর্ভুক্ত হচ্ছে। রেডিওর ঘোষণা শেষ হলে, এলাকায় উড়ল পাকিস্তানের পতাকা। এদিকে কৃষ্ণনগরের রানি জ্যোতির্ময়ী দেবী ইংরেজদের এই কাজ মেনে নিলেন না। পুত্র সৌরীশ ও গণ্যমান্য কয়েকজনকে নিয়ে সোজা গিয়ে দেখা করলেন লর্ড মাউন্টব্যাটেনের সঙ্গে। কাগজপত্র দেখে মাউন্টব্যাটেন মেনে নিলেন রানির দাবি। ১৭ অগাস্ট রাতে রেডিওতে ঘোষণা হল যে, কৃষ্ণনগর ও রানাঘাট ভারতেই থাকছে। উল্লাসে ফেটে পড়লেন এলাকার মানুষ। ১৮ অগস্ট ‘দ্বিতীয়বার’ স্বাধীন হল কৃষ্ণনগর।

আর এবার সেই স্বাধীনতা এনে দিল নদিয়ার রাজবাড়ি।

কৃষ্ণনগর রাজবাড়ি ও বারোদোল মেলা ৷

আজকের রাজবাড়ি সক্রিয় রাজনীতি থেকে বহু দূরে। রাজবাড়ির অন্দরে সদ্য শেষ হওয়া বারোদোলের ভাঙা আসরের গন্ধ। কিন্তু ভোটের তাপ উত্তাপ এখানে খুঁজতে যাওয়া বোকামি হবে। রাজবাড়ির চৌহদ্দিতে ঢুকলে সেখানে নির্ভেজাল নীরবতা বাইরের উত্তেজনাকে ম্লান করে দেয়। এখন প্যান্ডেল খোলা হচ্ছে সেখানে। ধোয়া মোছার কাজও চলছে জোরকদমে। এ বছর থেকে এখানে চালু হয়েছে অন্নপূর্ণা পুজো। তিনশো বছর আগে দেবী অন্নপূর্ণাই ছিলেন রাজবাড়ির মূল আরাধ্যা। সেই পুজোকে আবার নতুন করে চালু করলেন বর্তমান রাজা-রানি। রাজবাড়ির মাঠে জমাটি বারোদোলের মেলা হলেও ভিতরটায় সেই আদি অকৃত্রিম শান্তি। সেখানে বাগানের পরিচর্যা করছেন কর্মীরা। তাঁরাও জানালেন, রাজবাড়ির কোনও রং নেই। এই স্থানকে পবিত্র হিসাবেই মান্য করেন কৃষ্ণনগরবাসী। তাই রাজনীতির আঁচ লাগে না এই বাড়িতে। বিকেল হলেই এখানকার মাঠে তাসের আড্ডা জমান একদল বৃদ্ধ। তাঁরাও জানালেন, মতপার্থক্য থাকলেও এখানে কোনও দ্বন্দ্ব নেই, কোনও হিংসা নেই, গোষ্ঠী সংঘর্ষ নেই।

সেরা ভিডিও

আরও দেখুন
লালগোলাতে রাজরাজেশ্বরী রূপে পূজিতা হন মা কালী! দেওয়া হয় ইলিশের ভোগ
আরও দেখুন

আর নগরের উপকণ্ঠের এই রাজবাড়ি বছরের অন্যান্য দিনের মতো আজও নীরব থেকেও একাই যেন অতন্দ্র প্রহরীর মতো পাহারা দিচ্ছে গোটা নদিয়া জেলাকে। রাজনীতির রং ছাড়াই।

বাংলা খবর/ খবর/ফিচার/
সে কালের রাজনীতিতে ভূমিকা ছিল বিরাট, ভোটের আগে অন্য চিত্র কৃষ্ণনগর রাজবাড়িতে