ধূমপান:
আমরা সকলেই প্রায় জানি যে, ধূমপান স্বাস্থ্যের পক্ষে অত্যন্ত ক্ষতিকর। আর হৃদযন্ত্রের জন্য তো বটেই! সেই ১৯৬০ সাল থেকে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকেরা ধূমপানকে হৃদরোগের বড় কারণ হিসেবে ব্যাখ্যা করে আসছেন। আসলে উচ্চ রক্তচাপ বা হাই ব্লাড প্রেশার এবং হাই কোলেস্টেরলের সঙ্গে সঙ্গে ধূমপানও হৃদরোগের আশঙ্কা বাড়িয়ে দেয়। হৃদরোগে মৃত্যুর তিন ভাগের মধ্যে এক ভাগের কারণই হল ধূমপান।
advertisement
প্রতি বার ধূমপানের সময় পাঁচ হাজারেরও বেশি রাসায়নিক ধূমপানকারীর দেহে প্রবেশ করে। তাদের মধ্যে বেশির ভাগই শরীরের জন্য অত্যন্ত ক্ষতিকর। এই রাসায়নিক বা কেমিক্যালের মধ্যে অন্যতম হল- কার্বন মনোক্সাইড। আর মানবদেহের লোহিত রক্তকণিকায় অক্সিজেনের পরিমাণ কমিয়ে দেয় কার্বন মনোক্সাইড। যার ফলে হৃদযন্ত্র ক্ষতিগ্রস্ত হয়। শুধু তা-ই নয়, বিশুদ্ধ রক্তবাহী ধমনীতে ধূমপানের কারণে বেশি পরিমাণে কোলেস্টেরল জমা হতে থাকে। আর এটাও হৃদযন্ত্রের জন্য অত্যন্ত হানিকারক।
যাঁরা ধূমপানে অভ্যস্ত, তাঁরা অনেক সময় ঝুঁকির বিষয়টা বুঝলেও এই বদভ্যাস চট করে ছাড়াতে পারেন না। অনেকেই আবার ধূমপান ছেড়ে ই-সিগারেটের দিকে ঝুঁকেছেন। এটা মূলত যাঁরা ধূমপান ছেড়ে দিতে চান, তাঁরাই ব্যবহার করে থাকেন। আসলে কি ই-সিগারেট নিরাপদ? ই-সিগারেট স্বাস্থ্যকর কি না, সেই বিষয়ে সন্দেহ থেকেই যায়। কারণ এই বিষয়ে সে রকম কোনও তথ্য প্রমাণ এখনও হাতে নেই। তবে ই-সিগারেটকে বিকল্প ভাবলেও এটা থেকে নিকোটিন বা তামাক, টক্সিন, মেটাল এবং অন্য আরও অনেক কন্টামিন্যান্টস ধূমপানকারীর দেহে পৌঁছয়। আর বুঝতেই পারছেন, প্রতিটি উপাদানই স্বাস্থ্যের জন্য একেবারে নিরাপদ নয়।
আরও পড়ুন: করোনার একটা টিকাতেই কাবু হবে সব ভ্যারিয়ান্ট, জেনে নিন মাল্টিভ্যারিয়ান্ট ভ্যাকসিন নিয়ে!
তাই হৃদরোগের আশঙ্কা বা ঝুঁকি কমানোর জন্য পুরোপুরি ভাবে ধূমপানের মতো বদভ্যাস ত্যাগ করতে হবে। ধূমপানকারীদের কাছে এটা যদিও অত্যন্ত চ্যালেঞ্জিং। তবে এর ফলে হৃদযন্ত্র সুস্থ থাকবে এবং হার্ট অ্যাটাকের ঝুঁকি অনেকাংশেই কমে যাবে।
বাইরের খানাপিনা:
হঠাৎ বন্ধুবান্ধবের সঙ্গে প্ল্যান হল, বাইরে খেতে যাওয়া হবে। ব্যস! আর কী! আবার অফিসে কাজ করতে করতে অনেকটা দেরি হয়ে গিয়েছে। ফ্রিজে কোনও সবজি বা রান্নাবান্না কিছুই নেই। আর ফিরেও তো হাত পুড়িয়ে রান্না করতে ইচ্ছে করবে না! তাই বাইরে থেকে পিৎজা অথবা বার্গার অথবা অন্য কোনও ফাস্ট ফুড অর্ডার করে নেওয়া হল। আজকাল আমরা কাজ সহজ করার জন্য হামেশাই এগুলো করে থাকি। কিন্তু আমরা কি জানি যে, আমাদের এই অভ্যেসগুলোই আমাদের হৃদযন্ত্রের জন্য বিপদ ডেকে আনছে?
মনে রাখতে হবে যে, হৃদরোগের ঝুঁকি কমানোর জন্য ভালো ভালো পুষ্টিকর খাবার খেতে হবে। আসলে আমরা যে সব খাবার খাই, তার সরাসরি প্রভাব পড়ে কোলেস্টেরল, রক্তচাপ, ডায়াবেটিস, ওবেসিটির মতো হৃদযন্ত্রের রিস্ক ফ্যাক্টরগুলির উপর। তাই কী খাবার খাব এবং কতটা পরিমাণে খাব, সেটা কিন্তু হৃদযন্ত্রের স্বাস্থ্যের জন্য ঠিক করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। আর পুষ্টিকর অথবা স্বাস্থ্যকর খাবার খাব মানে রেস্তোরাঁয় গিয়ে কিছু খেতে পারব না, এমনটা কিন্তু একদমই নয়। কারণ রেস্তোরাঁয় গিয়েও আমরা পুষ্টিগুণ সম্পন্ন খাবার খেয়ে অনায়াসেই রসনাতৃপ্তি করতে পারি।
রেস্তোরাঁয় খেতে গেলে কোন কোন বিষয়ের উপর নজর রাখতে হবে:
কিছু কিছু রেস্তোরাঁ রয়েছে যেখানে খাবারের মেনুতেই তার পুষ্টিগুণ সম্পর্কে লেখা থাকে। সে ক্ষেত্রে স্বাস্থ্যকর কি না জেনে নিয়ে খাবার অর্ডার করাই যায়।
ডিনারের আগে ব্রেডজাতীয় খাবার অথবা ডিনারের সঙ্গে ককটেল এড়িয়ে চলতে হবে। কারণ এই খাবার ও পানীয়ের মধ্যে প্রচুর ফ্যাট, মিষ্টি অথবা চিনি, সোডিয়াম এবং ক্যালোরি থাকে। যা হৃদযন্ত্রের জন্য অত্যন্ত ক্ষতিকর।
বিকল্প ট্রাই করে দেখা যায়। কী রকম? কোনও ফ্রাইয়ের জায়গায় স্যালাড অথবা মিষ্টি বা ডেজার্ট আইটেমের জায়গায় ফল খাওয়া যেতে পারে।
অল্প পরিমাণে খাবার নিতে হবে। এমন কিছু নিতে হবে, যা বন্ধুর সঙ্গে ভাগ করে নেওয়া যেতে পারে।
আর খাবারে চিজ, সস থাকলে সেটা এড়িয়ে চলা উচিত।
শরীরচর্চা না-করা অথবা কর্মবিমুখতা:
সারা দিনে যতটা সক্রিয় থাকা প্রয়োজন, ততটা পরিমাণ সক্রিয় না-থাকলে কিন্তু হৃদযন্ত্রের বিপদ হতে পারে। তাই অল্প হলেও সময় বার করে নিজের পছন্দমতো এক্সারসাইজ করা যেতে পারে। আসলে প্রতি দিন রুটিন মেনে শরীরচর্চা করলে হৃদযন্ত্রের স্বাস্থ্য ভালো থাকবে। প্রতি দিন অন্তত মিনিট কুড়ি মানে সপ্তাহে মোটামুটি ১৫০ মিনিট শরীরচর্চাই যথেষ্ট। জোরে জোরে হাঁটা অথবা টেনিস খেলার মতো কাজও হৃদযন্ত্রের জন্য অত্যন্ত উপকারী। এই ধরনের শরীরচর্চা কোলেস্টেরলের মাত্রা, রক্তচাপ কমায় এবং দেহের ওজনও নিয়ন্ত্রণে রাখে। সেই সঙ্গে হৃদযন্ত্রের পেশিকেও সুস্থ সবল রাখতে সক্ষম।
আরও পড়ুন: করোনা হলে কি শ্রবণশক্তি নষ্ট হতে পারে? যা জানা জরুরি...
নিজেকে সক্রিয় রাখার উপায়গুলি:
কাছেপিঠে কোথাও গেলে গাড়িতে না-গিয়ে হেঁটেই চলে যাওয়া যায়
লিফট ব্যবহার না-করে সিঁড়ি ব্যবহার করা যেতে পারে
প্রিয়জন অথবা পোষ্যর সঙ্গে হাঁটতে বেরোনো যেতে পারে
ভলিবল, ফুটবলের মতো খেলা খেলতে পারা যায়
অনেকের সঙ্গে কোনও এক্সারসাইজ (যেমন- দৌড়োনো, নাচ প্রভৃতি) করা যেতে পারে
কোনও ফিটনেস ক্লাসেও যোগ দেওয়া যায়
অতিরিক্ত মানসিক চাপ:
অফিসের কাজের চাপ, বাড়ির সব কিছু সামলানো- এমন রুটিনের ক্ষেত্রে তো মানসিক চাপ আসতে বাধ্য। আর এই ধরনের মানসিক চাপের পিছন পিছন আসে হৃদরোগের আশঙ্কাও! আসলে মানসিক চাপের কারণে রক্তচাপ বাড়ে, যার জেরে হৃদযন্ত্র এবং রক্তবাহী ধমনীর উপর চাপ সৃষ্টি হয়। তার ফলে মারাত্মক ক্ষতি হয়ে যেতে পারে। আবার মানসিক চাপ কাটানোর জন্য অনেকেই যেগুলো করেন, সেগুলোও কিন্তু বদভ্যাসের মধ্যেই পড়ে। যেমন প্রচণ্ড মদ্যপান করা, ধূমপান করা প্রভৃতি। এই অভ্যেসগুলোও ঝুঁকি বাড়ায়। তাই মানসিক চাপ কমানোর জন্য কয়েকটি বিষয় মেনে চলতে হবে।
মানসিক চাপ কমানোর উপায়গুলি:
শরীরচর্চা
গান শোনা
মেডিটেশন অথবা যোগাভ্যাস
লেখালিখি করা
একাকিত্ব উপভোগ করা বা নিজের সঙ্গে সময় কাটানো
তবে অনেক সময় কিছু মানসিক চাপ কাটানো যায় না, সে ক্ষেত্রে লক্ষ রাখতে হবে যে, মানসিক চাপ যেন মাত্রা না-ছাড়ায়।
অতিরিক্ত মদ্যপান:
মাঝে মাঝে কোনও অনুষ্ঠানে বন্ধুদের সঙ্গে বসে অল্পস্বল্প পানাহার চলতে পারে। কিন্তু অতিরিক্ত কোনও কিছুই ভালো নয়। তাই অতিরিক্ত সুরাসক্ত হয়ে গেলে মুশকিল! কারণ অতিরিক্ত মদ্যপান করলে রক্তচাপ বৃদ্ধি পায় এবং তার ফলে একটা সময় হৃদযন্ত্র এবং রক্তবাহী ধমনী ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে পড়ে। শুধু তা-ই নয়, অ্যালকোহল এমন একটি জিনিস, যা দেহের ট্রাইগ্লিসারাইডের মাত্রা বাড়িয়ে দেয়। আমাদের দেহের এক ধরনের ফ্যাট এই ট্রাইগ্লিসারাইড। আসলে অ্যালকোহলের মধ্যে থাকা ক্যালোরি দেহের ক্যালোরির সঙ্গে যোগ হয়। আর ক্যালোরি বাড়লে তার প্রভাব পড়ে ট্রাইগ্লিসারাইডের উপর। যা হৃদরোগের আশঙ্কা বাড়িয়ে তোলে। এর পাশাপাশি অ্যালকোহলের মধ্যে থাকা ক্যালোরি দেহের ওজন বৃদ্ধি করে এবং তা থেকে ওবেসিটির মতো রোগও হতে পারে। তাই বিশেষজ্ঞদের মতে, এক জন পুরুষ দিনে দু’টো ড্রিঙ্ক নিতে পারেন, সেখানে মহিলারা নিতে পারেন শুধুমাত্র একটা ড্রিঙ্ক। যদি এই বেঁধে দেওয়া পরিমাণের থেকে বেশি পরিমাণ পানের অভ্যাস থাকে, সে ক্ষেত্রে এখনই সতর্ক হতে হবে।
আরও পড়ুন: আটকানো যাবে ভয়াবহতা, বিশেষজ্ঞরা করোনা মোকাবিলায় জোর দিচ্ছেন এই ৩ নিয়মে