কেন মেনথল সিগারেট নিষিদ্ধ?
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে প্রায় ১৮.৬ মিলিয়ন মানুষ মেনথল ধূমপান করে। এফডিএ-র তথ্য অনুসারে এটি দেশের সমস্ত ধূমপায়ীদের প্রায় ৩৬ শতাংশ। শ্বেতাঙ্গ আমেরিকানদের তুলনায় আফ্রিকান আমেরিকান সম্প্রদায়ে মেনথল সিগারেটের ব্যবহার তুলনামূলকভাবে বেশি। নিউ ইয়র্ক টাইমস মার্কিন সরকারের একটি সমীক্ষার উদ্ধৃতি দিয়ে বলেছে যে আফ্রিকান আমেরিকানদের প্রায় ৮৫ শতাংশ মেনথল সিগারেট ব্যবহার করেন। সিডিসি (Centers for Disease Control and Prevention) বলে যে সিগারেটের মেনথল ক্ষতিকারক রাসায়নিকের শোষণকে সহজ করে তোলে, কারণ মেনথলের ধোঁয়া ইনহেল করা সহজ। সিডিসি (CDC) অনুসারে, অর্ধেকেরও বেশি নাবালক যারা ধূমপান করে তারা মেন্থল সিগারেট ব্যবহার করে। একটি সমীক্ষায় দেখা গিয়েছে যে বেশিরভাগ প্রাপ্তবয়স্ক ধূমপায়ী মেনথল সিগারেট দিয়েই ধূমপান শুরু করেছিলেন। অন্যান্য গবেষণায় বলা হয়েছে যাঁরা মেনথল সিগারেট খান, তাঁদের নিয়মিত ধূমপায়ী হওয়ার সম্ভাবনা বেশি।
advertisement
২০১৮ সালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ধূমপানের হার সর্বকালের সর্বনিম্ন পর্যায়ে পৌঁছেছে। কিন্তু ধূমপান এখনও দেশে মৃত্যু, রোগ এবং অক্ষমতার এক নম্বর কারণ। ধূমপানের কারণে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে প্রতি বছর ৪ লাখ ৮০ হাজার মানুষের মৃত্যু হয়। যার মধ্যে পরোক্ষ ধূমপানের কারণে ৪১ হাজারের বেশি মৃত্যু হয়।
মেনথল সিগারেট তরুণদের ধূমপানে প্রলুব্ধ করে: ধূমপান বিরোধী আইনজীবীরা যুক্তি দিয়ে আসছেন যে মেনথল সিগারেট তরুণদের ধূমপানে আকৃষ্ট করতে ভূমিকা পালন করে। এফডিএ বলেছে, মেনথল মূলত পুদিনার স্বাদ এবং সুগন্ধযুক্ত একটি ফ্লেভার অ্যাডিটিভ, যা ধূমপানের জ্বালা এবং তীব্রতা কমায়। এটি সিগারেট ব্যবহার করা সহজ করে তোলে, বিশেষ করে যুবকদের জন্য। নিকোটিনের আসক্তির প্রভাব বাড়াতে মেনথল মস্তিষ্কে নিকোটিনের সঙ্গেও সম্পর্ক গড়ে তোলে। মেনথলের গন্ধ, সংবেদনশীল প্রভাব এবং মস্তিষ্কে নিকোটিনের সঙ্গে মিথস্ক্রিয়া যুবকদের মধ্যে মেনথল সিগারেট ব্যবহারের সম্ভাবনাকে বাড়িয়ে দেয়। তারা নিয়মিত ধূমপান করতে শুরু করে। ধূমপান ত্যাগ করা আরও কঠিন করে তোলে।
নিষেধাজ্ঞার প্রভাব কী হবে?
এফডিএ বলেছে যে মেনথল সিগারেটের উপর নিষেধাজ্ঞা একবার কার্যকর হলে ৪০ বছরের মধ্যে ধূমপানের পরিমাণ ১৫ শতাংশ কমে যাবে। ব্রিটিশ আমেরিকান টোব্যাকো (British American Tobacco) এবং ইম্পেরিয়াল টোব্যাকো (Imperial Tobacco) হল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের দুটি বৃহত্তম তামাক কোম্পানি। সংস্থা দুটি বলেছে যে তারা খুব বেশি এই বিষয়ে উদ্বিগ্ন নয় এবং এই নিষেধাজ্ঞা কার্যকর হতে কয়েক বছর সময় লাগবে বলেই আশা করছে তারা। এই সিগারেট ব্যবহারের প্রস্তাবিত নিষেধাজ্ঞা কার্যকর হলে তা ধূমপায়ী জনসংখ্যার একটি বড় অংশকে প্রভাবিত করবে, বিশেষ করে তরুণ প্রাপ্তবয়স্ক এবং জাতিগতভাবে সুবিধাবঞ্চিত গোষ্ঠীকে, যাদের তামাক ছেড়ে দেওয়ার জন্য কাউন্সেলিং এবং প্রাতিষ্ঠানিক সহায়তা পাওয়ার সম্ভাবনা কম।
আমেরিকান সিভিল লিবার্টিজ ইউনিয়ন (American Civil Liberties Union) এই নিষেধাজ্ঞার বিরোধিতা করে একটি বিবৃতি দিয়েছে। এছাড়াও এই সিদ্ধান্তকে চ্যালেঞ্জ জানিয়ে আদালতে যেতে পারে তামাক কোম্পানিগুলি। তামাক উৎপাদক সংস্থাগুলি বৈজ্ঞানিক প্রমাণ নিয়ে বিতর্ক করেছে। তাদের বক্তব্য, মেনথল সিগারেট যে নিয়মিত সিগারেটের চেয়ে বেশি ক্ষতিকারক, তার প্রমাণ নেই। যদিও, আমেরিকার সেন্টারস ফর ডিজিজ কন্ট্রোল অ্যান্ড প্রিভেনশনের সাম্প্রতিক এক গবেষণায় বলা হয়েছে, সাধারণ সিগারেটের তুলনায় এই জাতীয় সিগারেট অনেক বেশি ক্ষতি করে। চিকিৎসকদের দাবি, মেনথল সিগারেট সাধারণ সিগারেটের তুলনায় শুধুমাত্র রক্তচাপ বা হৃদ্রোগের আশঙ্কাই বাড়িয়ে দেয় না, একই সঙ্গে ক্যানসারের মতো অসুখের আশঙ্কাও বাড়িয়ে দেয়।
অন্যান্য সমালোচকরা দাবি করেছেন যে এই নিষেধাজ্ঞা সরকারের উল্লেখযোগ্য রাজস্ব ক্ষতির কারণ হবে। আবার কেউ কেউ বলেছেন যে এটি আফ্রিকান আমেরিকানদের সাহায্য করার চেয়ে বেশি ক্ষতি করবে। তারা বলেছে যে এটি অপরাধ বৃদ্ধির দিকে নিয়ে যাবে। বিশ্বের অন্যতম বৃহৎ তামাক কোম্পানি আলট্রিয়া (Altria) বলেছে, "ক্ষতি কম করা, নিষেধাজ্ঞা নয়, এগিয়ে যাওয়ার উত্তম পথ। এই পণ্যগুলিকে আইনি বাজারের বাইরে নিয়ে গেলে অনিয়ন্ত্রিত হয়ে যাবে। তাতে চোরাচালান ও লুকিয়ে বিক্রির করার মতো অপরাধমূলক কাজ বেড়ে যাবে। বয়সের তোয়াক্কা না করেই অবাধে বিক্রি করা হবে।" যদিও, প্রস্তাবটি এখনও বাস্তবায়নের পর্যায় থেকে অনেক দূরে। এটি পাস করানোর আগে জনসাধারণের বক্তব্য এবং আপত্তি শোনা হবে।
আরও পড়ুন: রয়ে গেল সাত বছরের কন্যা, মৃত্যুতেও কত প্রাণ বাঁচিয়ে গেলেন চিকিৎসক সংযুক্তা রায়!
থিঙ্ক ট্যাঙ্ক ট্যাক্স ফাউন্ডেশন (Think Tank Tax Foundation) দাবি করেছে যে নিষেধাজ্ঞা কার্যকর হলে ফেডারেল এবং প্রাদেশিকা সরকারগুলি প্রথম বছরেই ৬.৬ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের বেশি লোকসান করবে।
সারা বিশ্বের চিত্রটা কেমন?
বিশ্বের প্রথম দেশ হিসেবে ২০১২ সালে মেনথল সিগারেট নিষিদ্ধ করেছিল ব্রাজিল। এরপর ২০১৭ সালে কানাডা এবং ২০২০ সালে ইউরোপীয় ইউনিয়ন এই সিগারেট নিষিদ্ধ করেছিল। যদিও ব্রিটেন ততক্ষণে ইউরোপীয় ইউনিয়ন ত্যাগ করেছিল, তবে তারাও নিষেধাজ্ঞা চাপিয়েছিল। পরবর্তী সময়ে তুরস্ক, মলদোভা এবং ইথিওপিয়াও মেনথল সিগারেট নিষিদ্ধ করেছে।
ভারত কী করেছে?
ভারত মেনথল সিগারেট বিক্রি নিষিদ্ধ করেনি। ভারতে তামাক নিয়ন্ত্রণ আইনগুলি সিগারেট এবং অন্যান্য তামাকজাত পণ্যের উপরে প্রযোজ্য। ভারতে যে আইন রয়েছে তাতে, তামাকজাত পণ্যের বিজ্ঞাপন, প্রচার এবং পৃষ্ঠপোষকতার উপর বিধিনিষেধ রয়েছে। এছাডা়ও পাবলিক প্লেসে ধূমপান, অপ্রাপ্তবয়স্কদের বিক্রি এবং শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ১০০ গজের মধ্যে তামাক ও তামাকজাত পণ্য বিক্রি নিষিদ্ধ রয়েছে। এছাড়াও, সমস্ত তামাক পণ্যের প্যাকে নির্দিষ্ট সচিত্র স্বাস্থ্য সতর্কতা ছাপা বাধ্যতামূলক।
আরও পড়ুন: সুকান্তকে পাশে বসিয়েই দলের জন্য 'অভিভাবক' চাইলেন দিলীপ! তুমুল শোরগোল বিজেপিতে
আমেরিকায় নিষেধাজ্ঞা কি ভারতে ধূমপান কমাতে সাহায্য করবে?
যদি ভারতে একই ধরনের নিষেধাজ্ঞা কার্যকর করা হয়, তাহলে প্রভাব সীমিত হতে পারে। কারণ চিবিয়ে খেতে হয় এমন তামাক এবং বিড়ির চল এখানে বেশি। দ্য ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেসের একটি প্রতিবেদন অনুসারে, ভারতে ১৫ বছর বা তার বেশি বয়সি ২৬.৭ কোটি তামাক ব্যবহারকারী রয়েছেন। ভারতের মোট জনসংখ্যার ১৮ শতাংশ ধোঁয়াহীন তামাক ব্যবহার করে। ৭ শতাংশ ধোঁয়া এবং ৪ শতাংশ উভয়ই ব্যবহার করে।
দিল্লির তামাক নিয়ন্ত্রণ সেলের প্রাক্তন প্রধান চিকিৎসক এস কে অরোরা বলেছেন, "এই ধরনের পদক্ষেপের প্রভাব কেবলমাত্র অল্পবয়সী প্রাপ্তবয়স্ক এবং মহিলাদের উপর পড়বে, যাঁরা সবেমাত্র ধূমপান শুরু করেছেন। গন্ধ যোগ করা ছাড়াও মেনথল তামাকের তীব্রতা, জ্বালা কমায়। এছাড়াও তামাকের নিজস্ব গন্ধও কিছুটা কমায় মেনথল। অনেকেই বাড়িতে ধরা পড়ে যাওয়ার আশঙ্কা থেকে মেনথল সিগারেট ব্যবহার করে।" তবে তিনি উল্লেখ করেছেন যে একবার একজন ব্যক্তি দুই সপ্তাহ থেকে এক মাস পর্যন্ত ধূমপান চালিয়ে গেলে স্বাদের বিষয়টি আর গ্রহণযোগ্য থাকে না। কারণ তাঁরা নিয়মিত সিগারেট খাওয়া চালিয়েই যাবেন।
আরও পড়ুন: দুবরাজপুরে খুলে গেল 'আনন্দ আশ্রম', অসহায় বাবা-মায়েদের মুখে ফুটবে একটু হাসি!
পাবলিক হেলথ ফাউন্ডেশনের মনিকা অরোরা বলেছেন যে মেনথল সিগারেট সাধারণত কিশোর-কিশোরীদের আকর্ষণ করে, যাঁরা প্রাথমিকভাবে একটি স্বাদযুক্ত পণ্য দিয়ে শুরু করেন, তারপর সাধারণ সিগারেটের দিকে চলে যান। তাই এটি নিষিদ্ধ করলে নতুন ধূমপায়ীদের নিয়মিত ধূমপায়ী হওয়া প্রতিরোধ করা যেতে পারে। উল্লেখ্য যে মেনথল বা অন্যান্য স্বাদযুক্ত সিগারেট ব্যবহার করে এমন লোকের সংখ্যা সম্পর্কে ভারতে কোনও সরকারি হিসেব নেই। তবে বছরের পর বছর ধরে বিভিন্ন স্বাদের সিগারেটের সংখ্যা বৃদ্ধি পেয়েছে।