সরকার কেন এয়ার ইন্ডিয়া বিক্রি করছে?
এনিয়ে তৃতীয়বার রাষ্ট্রায়ত্ত ক্যারিয়ার এয়ার ইন্ডিয়া বিক্রির চেষ্টা চালিয়েছিল কেন্দ্রীয় সরকার। আগের সব জটিলতা এবার কেটে গিয়েছে বলে জানা যাচ্ছে। কেন্দ্রের পরিকল্পনা, এয়ার ইন্ডিয়ার ১০০ শতাংশের পাশাপাশি এয়ার ইন্ডিয়া এক্সপ্রেসের সম্পূর্ণ মালিকানা বিক্রি করে দেওয়া। এই বছরের মার্চে অসামরিক বিমান পরিবহন মন্ত্রী হরদীপ সিং পুরি (Hardeep Singh Puri) বলেছিলেন, “আমরা সিদ্ধান্ত নিয়েছি যে এয়ার ইন্ডিয়ার শতভাগ বিকেন্দ্রীকরণ করা হবে। এই এয়ারলাইন সরকারের সম্পদ। কিন্তু ৬০ হাজার কোটি টাকা ঋণের বোঝার কারণে একে ঝেড়ে ফেলার প্রয়োজন আছে।"
advertisement
আরও পড়ুন- ইক্যুইটিতে বিনিয়োগ করতে চাইছেন? যা যা জানা দরকার!
২০০০ সালে প্রথমবার এয়ার ইন্ডিয়া বিক্রির বিষয়ে কথা ওঠে। তার পর থেকে গত কয়েক বছরে গঙ্গা দিয়ে প্রচুর জল বয়ে গিয়েছে। এয়ার ইন্ডিয়া চালিয়ে সরকারের প্রতিদিন ২০ কোটি টাকা লোকসান হচ্ছিল বলে জানিয়েছিলেন হরদীপ সিং পুরী। ২০১৭ সালে নরেন্দ্র মোদি (Narendra Modi) সরকার এয়ার ইন্ডিয়া বিক্রির জন্য তৎপর হয়েছিল। যদিও ২৪ শতাংশ শেয়ার ধরে রাখার সিদ্ধান্তের ফলে কোন ক্রেতা এগিয়ে আসেনি। এর আগে, অটল বিহারী বাজপেয়ীর (Atal Bihari Vajpayee) নেতৃত্বাধীন এনডিএ (NDA) সরকারও ২০০১ সালে এয়ার ইন্ডিয়ার ৪০ শতাংশ শেয়ার বিক্রির সিদ্ধান্ত নিয়েছিল। সেই সময় আবার কয়েকজন ক্রেতা আগ্রহ দেখিয়েছিল, তবে শেয়ার বিক্রি শেষ পর্যন্ত করা হয়নি।
এবার সরকারের কী প্রস্তাব ছিল?
কেন্দ্রের পরিকল্পনা ছিল, এয়ার ইন্ডিয়ার ১০০ শতাংশের পাশাপাশি এয়ার ইন্ডিয়া এক্সপ্রেসের (Air India Express) সম্পূর্ণ মালিকানা বিক্রি করে দেওয়া। এছাড়াও গ্রাউন্ড হ্যান্ডলিং সংস্থা এয়ার ইন্ডিয়া স্যাটস এয়ারপোর্ট সার্ভিসেস প্রাইভেট লিমিটেড (AISATS)-এর ৫০ শতাংশ বিক্রি করা। কম্পানির এন্টারপ্রাইজ ভ্যালুতে দরপত্র আহ্বান করা হয়েছিল। বলা হয়েছিল, এয়ার ইন্ডিয়ার সম্ভাব্য মালিককে ২৩ হাজার কোটি টাকার ঋণের বোঝাও নিতে হবে। বাকি ঋণের ভার নেবে এয়ার ইন্ডিয়া অ্যাসেট হোল্ডিং লিমিটেড (Air India Asset Holdings Ltd)। এদের হাতে রয়েছে মুম্বইয়ে এয়ার ইন্ডিয়া বিল্ডিং (Air India building), দিল্লির এয়ারলাইন্স হাউস (Airlines House)-সহ ইত্যাদি সম্পদ। এখানে কেবল ঋণের ভার নেওয়ার বিষয়টি দেখলে হবে না। এটা এভাবেও দেখতে হবে যে, এয়ার ইন্ডিয়া কোনও সংস্থা কিনলে সে একযোগে সংস্থার মালিকানাধীন বিশাল পরিকাঠামোর মালিক হবে। যা এত বছর ধরে নির্মাণ করা হয়েছে। এছাড়াও বিশ্বের অন্যতম বড় গণতান্ত্রিক দেশের প্রধান আন্তর্জাতিক ক্যারিয়ার হওয়ার তকমা উপভোগ করার বিষয়টিও রয়েছে। ৪ হাজার ৪০০ অভ্যন্তরীণ উড়ান ও ১ হাজার ৮০০ আন্তর্জাতিক বিমান চালায় এয়ার ইন্ডিয়া, এটাও হাতে পাবে সম্ভাব্য মালিক গোষ্ঠী। এছাড়াও দেশ-বিদেশে কয়েকশো পার্কিং স্লটও রয়েছে তালিকায়। এই আন্তর্জাতিক স্লটগুলি কয়েক মিলিয়ন ডলার দাম। ভারতেও এয়ার ইন্ডিয়ার কোটি কোটি টাকার সম্পদ রয়েছে। এই বছরের শুরুর দিকে সংসদে অসামরিক বিমান পরিবহন মন্ত্রক জানিয়েছিল যে ২০২০ সালের মার্চ মাস পর্যন্ত এয়ার ইন্ডিয়ার স্থায়ী সম্পদের মোট মূল্য ৪৫ হাজার কোটি টাকারও বেশি।
এয়ার ইন্ডিয়ার পথচলা:
এয়ার ইন্ডিয়ার ইতিহাস স্বাধীন ভারতের চেয়েও পুরনো। জেআরডি টাটা (JRD Tata) পাইলটের লাইসেন্স পাওয়া প্রথম ভারতীয়। তিনি ১৯৩২ সালে করাচি এবং বোম্বাইয়ের (বর্তমান মুম্বই) মধ্যে এয়ারমেইল পরিষেবা (Airmail Service) চালু করার সিদ্ধান্ত নেন। তিনি শীঘ্রই পরিষেবার ব্যাপ্তি ঘটান ও ১৯৪৬ সালে নাম বদলে হয় এয়ার ইন্ডিয়া। ১৯৫৩ সালে টাটার হাত থেকে এই উড়ানকে অধিগ্রহণ করে কেন্দ্র। যদিও ১৯৭৮ সাল পর্যন্ত সংস্থার চেয়ারম্যান হিসাবে কাজ চালিয়ে যান জেআরডি টাটা। ৭৮ সালে মোরারজি দেশাইয়ের (Morarji Desai) নেতৃত্বাধীন জনতা পার্টি সরকারের সঙ্গে মতবিরোধের কারণে সরে দাঁড়ান টাটা। যদিও ইন্দিরা গান্ধীর (Indira Gandhi) সরকার পরে তাঁকে আবারও ফিরিয়ে এনে এয়ার ইন্ডিয়ার বোর্ডে বসান।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন যে সংস্থার বর্তমান সমস্যার শুরু হয় ২০০৭ সাল থেকে। তৎকালীন ইউপিএ সরকার এয়ার ইন্ডিয়া এবং ইন্ডিয়ান এয়ারলাইন্স মিলিয়ে দিয়ে প্রচুর নতুন বিমানের অর্ডার দিয়েছিল। আর সেই কারণে সংস্থার ঋণ হাজার হাজার কোটি টাকা বেড়ে গিয়েছিল। ততক্ষণে, অভ্যন্তরীণ বিমান চলাচলে নানা পরিবর্তন এসেছে। কিন্তু এয়ার ইন্ডিয়া সেই সুযোগকে কাজে লাগাতে পারেনি। পরিবর্তে জেট, ইন্ডিগো এবং অন্যান্য নতুন বিমান সংস্থাগুলি বাজার দখল করে ফেলে।
একটা সময় বিশ্বের বিভিন্ন দেশের মধ্যে যোগাযোগের মাধ্যম কম ছিল। সেই সময় এয়ার ইন্ডিয়া বিশ্বের সঙ্গে ভারতের যোগাযোগকে বাড়িয়ে তুলেছিল এবং দেশের সংস্কৃতির মূর্তিমান দূত হিসেবে কাজ করেছিল। সংস্থাটি দেশের প্রধান প্রধান শহরে অফিস খুলে বিদেশিদের আকৃষ্ট করার জন্য ভারতীয় শিল্প ও নান্দনিকতার উপর ভিত্তি করে ব্র্যান্ড তৈরি করেছে। ভারতীয় শিল্পের অন্যতম বড় সংগ্রাহক হয়ে উঠেছে এয়ার ইন্ডিয়া। এয়ার ইন্ডিয়ার ইতিহাসের সঙ্গে জড়িয়ে রয়েছে এমএফ হুসেইন (MF Hussain), ভিএস গাইতোন্ডে, অঞ্জলি এলা মেননের মতো অনেক বিখ্যাত শিল্পীর নাম। একটি অনন্য ব্র্যান্ড তৈরির চেষ্টায় এয়ার ইন্ডিয়ার পরিচালকরা সালভাদর দালিকে (Salvador Dali) একটি অ্যাশট্রে ডিজাইন করতেও রাজি করান, যার প্রায় ২৫০টি প্রথম শ্রেণির যাত্রীদের উপহার হিসেবে দেওয়া হয়েছিল। এছাড়াও ওই চিত্রশিল্পীর অনুরোধে একটি বাচ্চা হাতিকে স্পেনে পাঠানো হয়েছিল। হাতিটি স্পেনের একটি চিড়িয়াখানায় ছিল মৃত্যু পর্যন্ত। কিন্তু এয়ার ইন্ডিয়ার ‘মহারাজা’ মাসকটের (Maharajah এয়ারলাইন্সের ঝুলিতে রেকর্ড: এয়ারলাইন্সের ঝুলিতে কয়েকটি রেকর্ডও রয়েছে। ২০১৭ সালে এয়ার ইন্ডিয়া সর্বপ্রথম সমস্ত মহিলা ক্রু নিয়ে বিশ্বব্যাপী উড়ান চালিয়েছিল। এছাড়াও অসামরিক বিমান সংস্থা দ্বারা পরিচালিত সব চেয়ে বড় উদ্ধার অভিযানের জন্য গিনেস ওয়ার্ল্ড রেকর্ডে (Guiness World Records) নাম তোলে এয়ার ইন্ডিয়া। ১৯৯০ সালে ইরাক যুদ্ধের সময় কুয়েত থেকে ১ লাখেরও বেশি ভারতীয়কে এয়ারলিফ্ট করতে ৫৯ দিন ধরে ৪৫০ বারের বেশি বিমান চালিয়েছিল এয়ার ইন্ডিয়া। বেসরকারি হাতে যাওয়ার পর একটা প্রশ্ন অবশ্যই উঠবে, আর সেটা হল কম সময়ের নোটিসে কি এয়ার ইন্ডিয়া আগের মতোই ভারতীয়দের উদ্ধারে নেমে পড়বে? না কি সরকারকে অন্য ব্যবস্থা করতে হবে? তাছাড়া আরেকটি বিষয়ও মাথায় রাখতে হবে। সেটা হল রাষ্ট্রপতি এবং প্রধানমন্ত্রীর মতো বিশিষ্ট ব্যক্তিদের ব্যবহারের জন্য বিমান চালানোর ক্ষেত্রে এয়ার ইন্ডিয়ার ভূমিকা ভবিষ্যতে কী হবে? বলা বাহুল্য, এই সব প্রশ্নের উত্তর একমাত্র সময়ই দেবে!