আরও পড়ুন: রুশ যুদ্ধবিমানকে গুলি করে নামালো ইউক্রেন, বন্দি চালক, দেখুন ভিডিও
কিভের অর্থোডক্স চার্চের (Orthodox Church of Ukraine) প্রধান মেট্রোপলিটান এপিফানি (Metropolitan Epifany) বলেছেন, "আমারা ইউক্রেনের জন্য প্রার্থনা করছি, ঈশ্বরের প্রতি ভালবাসা রয়েছে। আমরা মন্দের বিরুদ্ধে লড়াই করি এবং আমরা বিজয় দেখতে পাব।" ইউক্রেনীয় অর্থোডক্স চার্চের প্রধান মেট্রোপলিটান ওনফ্রি বলেছেন, "পারস্পরিক ঝগড়া এবং ভুল বোঝাবুঝি ভুলে যান এবং ঈশ্বর এবং আমাদের মাতৃভূমির প্রতি ভালবাসার সঙ্গে একত্রিত হোন।"
advertisement
আপাতদৃষ্টিতে এটা ঐক্যের বার্তা মনে হলেও এর ভিতরে ফাঁক রয়েছে প্রচুর। বৃহস্পতিবার ওনফ্রি তাঁর বার্তা দেওয়ার একদিন পর তাঁর চার্চের ওয়েবসাইট প্রতিবেদন প্রকাশ করতে শুরু করে যে চার্চ (Church) এবং লোকজনকে আক্রমণ করা হচ্ছে। প্রতিদ্বন্দ্বী চার্চের প্রতিনিধিদের আক্রমণের জন্য দায়ী করা হয়। ইউক্রেনের অর্থোডক্স সংস্থাগুলির মধ্যে বিভাজন সাম্প্রতিক বছরগুলিতে বিশ্বব্যাপী প্রতিফলিত হয়েছে কারণ অর্থোডক্স চার্চগুলি কী ভাবে এবং কার পক্ষ নেবে তা নিয়ে লড়াই করেছে। কয়েকটি মার্কিন অর্থোডক্স আশা করে যে তারা এই ধরনের দ্বন্দ্বগুলিকে একপাশে রেখে যুদ্ধ শেষ করার জন্য একত্রিত হতে পারে। আবার অনেকে মনে করে যুদ্ধ বিভাজন আরও বাড়িয়ে তুলতে পারে।
আরও পড়ুন: মানব করিডোর দিয়ে নাগরিকদের নিরাপদে সরিয়ে নিতে যুদ্ধ বিরতি ঘোষণা করল রাশিয়া!
ইউক্রেনের ধর্মীয় চিত্রটা ঠিক কী?
ইউক্রেনীয় জনসংখ্যার একটি বড় গরিষ্ঠ অংশ অর্থোডক্স (Orthodox), ইউক্রেনীয় ক্যাথলিকরা উল্লেখযোগ্য ভাবে সংখ্যালঘু। যারা অর্থোডক্সের মতো বাইজেন্টাইন আচারে (Byzantine Liturgy) উপাসনা করে কিন্তু পোপের (Pope) প্রতি অনুগত। মোট জনসংখ্যার কিছু অংশ প্রোটেস্ট্যান্ট (Protestants), ইহুদি (Jews) এবং মুসলমান (Muslim)। ইউক্রেন এবং রাশিয়া ধর্মীয় এবং রাজনৈতিক উভয় ক্ষেত্রেই একটি সাধারণ ইতিহাস বহন করছে। রুশরা পূর্ব স্লাভীয় উপজাতি থেকে গঠিত হয়েছিল এবং তাদের সাংস্কৃতিক পূর্বপুরুষদের ভিত্তি কিভান রুশে (Kievan Rus) অবস্থিত। দশম শতকের প্রিন্স ভ্লাদিমির (Prince Vladimir) পৌত্তলিকতা প্রত্যাখ্যান করেছিলেন, ক্রিমিয়াতে (Crimea) গিয়ে খ্রিস্টধর্মে দীক্ষা নিয়েছিলেন এবং অর্থোডক্সি-কে সরকারি ধর্ম হিসাবে গ্রহণ করেছিলেন।
২০১৪ সালে পুতিন ক্রিমিয়া দখলের ন্যায্যতা প্রমাণ করার জন্য সেই ইতিহাস উদ্ধৃত করেছিলেন। ক্রিমিয়াকে রাশিয়ার কাছে 'পবিত্র' ভূমি হিসেবে তিনি দাবি করেন। যদিও পুতিন বলেছেন যে রাশিয়াই রুশ সাম্রাজ্যের প্রকৃত উত্তরাধিকারী।
ইউক্রেনীয়রা বলে যে, তাদের আধুনিক রাষ্ট্রের একটি স্বতন্ত্র বংশধারা রয়েছে। মস্কো শতাব্দীর পর শতাব্দী এমন ক্ষমতাধর ছিল না। অর্থোডক্স সম্পর্কের মধ্যে সেই উত্তেজনা বজায় রয়েছে। অর্থোডক্স চার্চগুলির ঐতিহাসিক ভাবে তাদের অঞ্চলে স্বায়ত্তশাসন বজায় রেখেছে। কনস্টান্টিনোপলের একুমেনিকাল প্যাট্রিয়ার্ককে (Ecumenical Patriarch of Constantinople) সর্বোচ্চ হিসেবে বিবেচনা করা হয়। কিন্তু ক্যাথলিক পোপের বিপরীতে তাঁর সর্বজনীন গ্রহণযোগ্যতা নেই।
ইউক্রেনের অর্থোডক্স চার্চগুলিকে আজ কে শাসন করে?
এর পিছনে রয়েছে তিনশো বছরেরও বেশি আগের ইতিহাস। রাশিয়ার শক্তি বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে এবং অটোমান শাসনের (Ottoman Rule) অধীনে কনস্টান্টিনোপল চার্চ দুর্বল হয়ে পড়ার পর, ১৬৮৬ সালে ইকুমেনিকাল প্যাট্রিয়ার্ক মস্কোর প্যাট্রিয়ার্ককে কিভের মেট্রোপলিটান (শীর্ষ বিশপ) নিয়োগ করার ক্ষমতা অর্পণ করেন। রাশিয়ান অর্থোডক্স চার্চ বলে যে এটি একটি স্থায়ী স্থানান্তর ছিল। যদিও, দ্য ইকুমেনিকাল প্যাট্রিয়ার্ক বলেছেন যে এটি ছিল অস্থায়ী।
গত এক শতাব্দী ধরে স্বতন্ত্র-মনোভাবাপন্ন ইউক্রেনীয় অর্থোডক্সরা পৃথক গির্জা গঠন করেছে। অথচ, ২০১৯ সাল পর্যন্ত সেগুলির আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতির অভাব ছিল। বর্তমান ইকুমেনিকাল প্যাট্রিয়ার্ক বার্থোলোমিউ ইউক্রেনের অর্থোডক্স চার্চকে মস্কোর প্যাট্রিয়ার্কের অধীনতা থেকে মুক্ত বলে স্বীকৃতি দিয়েছিলেন ওই বছর। কিন্তু সকলে এই পদক্ষেপ মেনে নিতে পারেননি। ইউক্রেনের পরিস্থিতি তখন আরও ঘোলাটে ছিল। অনেক মঠ এবং প্যারিশগুলি মস্কোর প্যাট্রিয়ার্কের অধীনে রয়ে গিয়েছে, যদিও এর সঠিক পরিসংখ্যান খুঁজে পাওয়া কঠিন।
এই বিভেদ কি দুই দেশের মধ্যে রাজনৈতিক বিভাজনকে প্রতিফলিত করে?
হ্যাঁ, তেমনটাই হচ্ছে। তবে এর মধ্যে বিস্তর জটিলতা রয়েছে। ইউক্রেনের প্রাক্তন প্রেসিডেন্ট পেট্রো পোরোশেঙ্কো (Petro Poroshenko) ২০১৮ সালে বলেছিলেন, "আমাদের চার্চের স্বাধীনতা ইউরোপ-পন্থী এবং ইউক্রেনীয়পন্থী নীতির অংশ।" কিন্তু বর্তমান প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কি (Vladimir Zelinskyy) হলেন ইহুদি, তিনি ধর্মীয় জাতীয়তাবাদের উপর জোর দেননি। শনিবার তিনি বলেছিলেন যে তিনি উভয় অর্থোডক্স নেতাদের পাশাপাশি শীর্ষ ক্যাথলিক, মুসলিম এবং ইহুদি প্রতিনিধিদের সঙ্গে কথা বলেছেন। তিনি বলেন, “সকল নেতারা সেই সকল আত্মার জন্য প্রার্থনা করেন যারা ইউক্রেনের জন্য এবং আমাদের ঐক্য ও বিজয়ের জন্য জীবন দিয়েছেন। এটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ।"
পুতিন আসলে ধর্মীয় বিভাজনকেই পুঁজি করার চেষ্টা করেছেন। ২১ ফেব্রুয়ারির ভাষণে তিনি একটি বিকৃত ঐতিহাসিক বর্ণনা দিয়ে ইউক্রেনের আসন্ন আক্রমণকে ন্যায্যতা দেওয়ার জন্য দাবি করেছিলেন যে, মস্কো পিতৃতান্ত্রিক ইউক্রেনীয় অর্থোডক্স চার্চ ধ্বংস করার জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছে। কিন্তু মেট্রোপলিটান ওনুফ্রির যুদ্ধকে কেনের 'পাপের' সঙ্গে তুলনা করেছিলেন। কেন বাইবেলের একটি চরিত্র, যিনি তাঁর ভাইকে হত্যা করেছিলেন। মেট্রোপলিটান ওনুফ্রির বক্তব্য এটাই ইঙ্গিত দেয় যে মস্কো-ভিত্তিক গির্জারও ইউক্রেনের জাতীয় পরিচয়ের একটি দৃঢ় ধারণা রয়েছে। অন্যদিকে, মস্কোর প্যাট্রিয়ার্ক কিরিল শান্তির আহ্বান জানিয়েছেন। কিন্তু ইউক্রেনে আক্রমণের জন্য রাশিয়াকে দায়ী করেননি। মস্কো প্যাট্রিয়ার্কের অধীনে ইউক্রেনীয় অর্থোডক্স চার্চের দীর্ঘকাল ধরে ব্যাপক স্বায়ত্তশাসন রয়েছে। ইউএস সেন্সাস অফ অর্থোডক্স খ্রিস্টান চার্চের কোঅর্ডিনেটর আলেক্সি ক্রিন্ড্যাচ বলেছেন, "চার্চের অধিভুক্তি নির্বিশেষে অনেক নতুন পাদ্রী আছেন যারা স্বাধীন ইউক্রেনে বেড়ে উঠেছেন।" প্রাক্তন সোভিয়েত ইউনিয়নে বেড়ে ওঠা ক্রিন্ড্যাচ বলেছেন, "তাঁদের রাজনৈতিক পছন্দগুলি তাঁদের প্যারিশের আনুষ্ঠানিক বিচারব্যবস্থার সঙ্গে সম্পর্কিত নয়।"
ক্যাথলিকদের অবস্থায় কোথায়?
ইউক্রেনীয় ক্যাথলিকরা মূলত পশ্চিম ইউক্রেনে অবস্থিত। ইউক্রেনীয় ক্যাথলিকদের জার এবং কমিউনিস্টদের অধীনে নিপীড়নের বিরুদ্ধে প্রতিরোধের বিশেষভাবে ইতিহাস রয়েছে। ফিলাডেলফিয়ার ইউক্রেনীয় ক্যাথলিক আর্কিপার্কির জনসংযোগ বিভাগের প্রধান মারিয়ানা কারাপিঙ্কা বলেছেন, "যতবারই রাশিয়া ইউক্রেন দখল করে, ততবারই ইউক্রেনীয় ক্যাথলিক চার্চগুলি ধ্বংস হয়ে যায়।" ইউক্রেনীয় ক্যাথলিকদের সোভিয়েতদের দ্বারা কঠোরভাবে দমন করা হয়েছিল, বেশ কয়েকজন নেতাকে হত্যাও করা হয়েছিল। পরিস্থিতি এমন জায়গায় পৌঁছায় যে অনেক ইউক্রেনীয় ক্যাথলিক আন্ডারগ্রাউন্ডে উপাসনা করতে শুরু করেন। কমিউনিজমের অবসানের পর থেকে গির্জা আবারও ফিরে আসে। ইউক্রেনীয় ক্যাথলিকদের মস্কোর বিরোধিতা করার এটি একটি শক্তিশালী কারণ। কারাপিঙ্কা বলেছেন, "ইউক্রেনীয় ক্যাথলিকরাই একমাত্র গোষ্ঠী, যারা সোভিয়েতদের দ্বারা নির্যাতিত হয়েছিল।"
সম্প্রতি পোপ ফ্রান্সিস (Pope Francis) রাশিয়ান অর্থোডক্স চার্চের সঙ্গে সম্পর্ক গলানোর চেষ্টা করেছিলেন, এমনকি ইউক্রেনীয় এবং অন্যান্য পূর্বাঞ্চলীয় ক্যাথলিকদের অধিকার রক্ষা করার কথাও তিনি বলেছিলেন। যদিও রুশ আক্রমণের পর পোপ ফ্রান্সিস শুক্রবার রাশিয়ান দূতাবাস (Russian Embassy) পরিদর্শন করে যুদ্ধ নিয়ে তাঁর উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন। রীতি অনুযায়ী, ভ্যাটিকানের (Vatican) বিদেশমন্ত্রী রাষ্ট্রদূতদের ডেকে পাঠাতে পারেন। তবে এই রীতি ভেঙে নিজেই রাশিয়ার দূতাবাসে চলে যান পোপ ফ্রান্সিস। যুদ্ধ বন্ধের বার্তা দিলেও সরাসরি রাশিয়ার (Russia) বিরুদ্ধে কোনও কথা বলেননি পোপ। বিশেষজ্ঞদের অনেকেরই মত, রাশিয়ান অর্থোডক্স চার্চের বিরোধিতার আশঙ্কায় পুরোপুরি মুখ খোলেননি পোপ ফ্রান্সিস।
অর্থোডক্স চার্চের ব্যাপ্তি: ইউক্রেনের চার্চগুলিকে স্বাধীন হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেওয়ার জন্য রাশিয়ান অর্থোডক্স চার্চ ২০১৮ সালে কনস্টান্টিনোপলের একুমেনিকাল প্যাট্রিয়ার্কের সঙ্গে সম্পর্ক ভাঙার সিদ্ধান্ত নিয়েছিল। এর অর্থ হল মস্কো এবং কনস্টান্টিনোপল-অধিভুক্ত চার্চের সদস্যরা অন্যের সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারবে না। বিবাদ আফ্রিকার পূর্ব অর্থোডক্স গীর্জাগুলিতেও ছড়িয়ে পড়েছে, যেখানে আফ্রিকা চার্চগুলি ইউক্রেনের চার্চগুলিকে স্বাধীনতাকে স্বীকৃতি দেওয়ার পরে রাশিয়ান অর্থোডক্সও বেশ কিছু চার্চকে স্বীকৃতি দিয়েছে। কিন্তু অন্যান্য অনেক গির্জা দ্বন্দ্ব এড়াতে চেয়েছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে একাধিক অর্থোডক্সের অধীনে থাকা বেশিরভাগ গোষ্ঠী এখনও একে অপরের সঙ্গে সহযোগিতা করে এবং উপাসনা করে। আমেরিকার অর্থোডক্স চার্চের (Orthodox Church in America) চ্যান্সেলর ভেরি রেভ. আলেকজান্ডার রেন্টেল বলেছেন, এই যুদ্ধ মার্কিন চার্চগুলির মধ্যে ঐক্য আরও বাড়াতে পারে। তবে সম্পর্ককে আরও পরীক্ষা করতে পারে৷ এখন এই যুদ্ধের কারণে এটি আরও কঠিন হতে চলেছে।"
