সংযুক্ত আরব আমিরশাহির প্রতিরক্ষা দফতর জানিয়েছে, ক্ষেপণাস্ত্র হানার পরেই সে দেশের বিমানবাহিনীর এফ-১৬ যুদ্ধবিমান উত্তর ইয়েমেনের আল-জওফে হুথি ঘাঁটিতে হামলা চালায়। সেটি ধ্বংস করা হয়। শুক্রবার ইয়েমেনের সাদা এলাকায় একটি জেলে বিমান হামলা চালায় হুথি বিদ্রোহীরা। আকস্মিক হামলায় ৭০ জনের মৃত্যুর পাশাপাশি কমপক্ষে আহত হয়েছেন শতাধিক। এমনটাই জানা গিয়েছে ইয়েমেন প্রশাসন সূত্রে। ওই হামলার ভিডিও প্রকাশ করে ঘটনার কথা স্বীকার করেছে বিদ্রোহীরা। হুথি বিদ্রোহীদের এই হামলার ঘটনায় তীব্র নিন্দা করেছে রাষ্ট্র সংঘের মহাসচিব আন্তোনিও গুতরেজ।
advertisement
এছাড়াও, সোমবার ভোরে সৌদি আরবেও (Saudi Arabia) দু’টি ক্ষেপণাস্ত্র (Missile) ছোড়ে বিদ্রোহী গোষ্ঠী। তার একটি জাঝন এলাকায় আছড়ে পড়লে দু’জন আহত হন। অন্যটিকে, ধাহরন-আল-জানুবের আকাশে ক্ষেপণাস্ত্র প্রতিরোধী ব্যবস্থার সাহায্যে ধ্বংস করে সৌদি সেনাবাহিনী। দক্ষিণ ইয়েমেনে হুথি গোষ্ঠীর ঘাঁটি থেকে ওই ক্ষেপণাস্ত্র দু’টি ছোড়া হয়েছিল।
হুথি কারা?
সাম্প্রদায়িকতা, জাতীয়তাবাদ, সুবিধার জোট, প্রভাবের ক্ষেত্র এবং ভূ-রাজনৈতিক ওঠা-নামা। এই সমস্ত বিভ্রান্তিকর মিশ্রণের অংশ ইয়েমেনের রাজনীতিকে ফুটন্ত রেখেছে। যা নিয়ে বিশ্বের অন্য দেশগুলির মাথাব্যথার শেষ নেই। হুথিরা জায়দির (Zaydi) অন্তর্গত। জাইদি নামেও এর উচ্চারণ করা হয়। নামটি হুসেন আল হুথির (Hussein al Houthi) নাম থেকে এসেছে। ২০০৪ সালে মৃত্যুর আগে পর্যন্ত হুসেন আল হুথি ইয়েমেনে ক্ষমতার দখলের জন্য নেতৃত্ব দিয়েছিলেন। জায়দিয়ারা তাদের নাম জায়েদ বিন আলির (Zayd bin Ali) কাছ থেকে পেয়েছে। জায়েদ বিল আলি ছিলেন আলির প্রপৌত্র। হুথিরা বহু শতাব্দী ধরে ইয়েমেনে ক্ষমতা দখলের জন্য লড়াই করেছে এবং উত্তর ইয়েমেনের পার্বত্য অঞ্চলে তাদের শক্ত ঘাঁটি তৈরি করেছে।
সম্প্রদায়টিকে জায়দিয়া বলা হয়, তবে এই সম্প্রদায় দর্শনে শিয়াদের (Shiites) থেকে উল্লেখযোগ্যভাবে আলাদা। যারা ইরান, ইরাক এবং আরব বিশ্বের অন্যত্র প্রভাব বিস্তার করেছে। যদিও এই সম্প্রদায় সুন্নিদের (Sunni) তুলনায় সংখ্যালঘু।
কেন হুথিরা সৌদি নেতৃত্বাধীন জোটের সঙ্গে সংঘাতে জড়িত?
ইয়েমেনের অস্থির রাজনৈতিক পরিস্থিতি প্রথম দেখা গিয়েছিল যখন হুথিরা আলি আবদুল্লাহ সালেহের (Ali Abdullah Saleh) শাসনের বিরুদ্ধে অস্ত্র হাতে তুলে নিয়েছিল। আবদুল্লাহ সালেহ নিজেও একজন জায়েদি। যিনি সত্তরের দশকের শেষের দিকে ধারাবাহিক অভ্যুত্থানের পর ইয়েমেনে ক্ষমতা দখল করেছিলেন। সালেহ উত্তর ও দক্ষিণ ইয়েমেনকে একত্রিত করেন এবং তিন দশকেরও বেশি সময় ধরে ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত থাকেন। যাই হোক, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং সৌদি মিত্রদের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা, দুর্নীতির অভিযোগে সালেহে হুথিদের বিরোধিতার মুখোমুখি হন। হুসেন আল হুথির (Hussein al Houthi) নেতৃত্বে হুথিরা সালেহর বিরুদ্ধে এক বছর ধরে প্রতিরোধ চালিয়েছিল। কিন্তু সালেহ সৌদি আরবের সমর্থনে ২০১১ সাল পর্যন্ত হুথিদের উত্তরের দুর্গে সীমাবদ্ধ রাখতে সফল হন। ২০১১ সালে আরব বসন্তের বাতাস ইয়েমেনে পৌঁছানোর পর সালেহকে গদি ছাড়তে হয়। এরপরই দেশে ক্ষমতার দখলের জন্য প্রতিযোগিতা শুরু হয়ে যায়।
সালেহকে ক্ষমতাচ্যুত করার পর আঞ্চলিক সংগঠন এবং আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের নেতৃত্বে ইয়েমেনে সরকার গঠনের জন্য মধ্যস্থতা করার প্রচেষ্টা চালানো হয়েছিল। কিন্তু দেশটির দক্ষিণ থেকে আবরাব্বুহ মনসুর হাদি নামে একজন সুন্নিকে নিয়োগ করার পরই অবিশ্বাসের বাতাবরণ তৈরি হয় ও হুথিরা বেঁকে বসে। তারা জানিয়ে দেয় অতীতে আবদুল্লাহ সালেহ-র সহযাগী হিসেবে কাজ করা আবরাব্বুহ মনসুর হাদিকে তারা মানবে না। সৌদি আরবের প্রতি নরমপন্থী লোকজনের বিরুদ্ধে লড়াই চালিয়ে যাওয়ার জন্য অবশেষে ২০১৪ সালে ক্ষমতাচ্যুত সালেহ-র সঙ্গে জোট গঠনে সম্মত হয় হুথিরা।
হুথি এবং সালেহের জোট, যারা ইয়েমেনি সামরিক বাহিনীর উল্লেখযোগ্য অংশের আনুগত্য উপভোগ করে চলেছে, তারা দেশটিকে দখল করার হুমকি দিয়েছিল, যার কারণ উদ্বেগ বাড়ে রিয়াধের (Riyadh)। ২০১৫ সালে ইয়েমেনের প্রেসিডেন্ট মনসুর হাদিকে উচ্ছেদ করে রাজধানী সানা দখল করে নেয় দেশটির ইরান-সমর্থিত শিয়াপন্থি হুথি বিদ্রোহীরা। সৌদি আরবের রাজধানী রিয়াধে আশ্রয় নিতে বাধ্য হন ইয়েমেনের ক্ষমতাচ্যুত প্রেসিডেন্ট হাদি। হুথি বিদ্রোহীদের ক্ষমতা দখলের পর থেকেই হাদির অনুগত সেনাবাহিনীর একাংশ তাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করে। ২০১৫ সালের মার্চে হুথি বিদ্রোহীদের বিরুদ্ধে ‘অপারেশন ডিসাইসিভ স্টর্ম’ নামের সামরিক আগ্রাসন চালানো শুরু করে সৌদি-আমিরশাহির সামরিক জোট (Coalition Of Arab States)।
আরও পড়ুন- কখন কোভিড টেস্ট করা প্রয়োজন, কখন নয়? জেনে নিন
২০১৭ সালে সালেহ হুথিদের সঙ্গে তাঁর জোট ভাঙার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন। কিন্তু কয়েক দিনের মধ্যে হুথি যোদ্ধাদের অতর্কিত হামলায় তিনি নিহত হন। ওই ঘটনার প্রায় সাত বছর পরেও ইয়েমেনে অচলাবস্থা অব্যাহত রয়েছে। সম্প্রতি ইয়েমেনের রাজধানী সানার উত্তরে হুথি বিদ্রোহীদের নিয়ন্ত্রিত অঞ্চলে অভিযান শুরু করেছে সে দেশের সরকারি বাহিনী। শাবওয়া এবং মারিব অঞ্চলে লড়াইয়ে ইয়েমেন সেনাকে সৌদি এবং আমিরশাহি সরাসরি মদত দিচ্ছে বলে জানা গিয়েছে। জোটের বিমান হামলার জবাবে হুথিরা সৌদি এবং সংযুক্ত আরব আমিরশাহিতে ড্রোন এবং ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালানোর ক্ষমতা দেখিয়েছে হুথি। যদিও জোটের অভিযোগ, হুথিদের সক্রিয় ভাবে সমর্থন করছে ইরান। যার কারণেই তারা আধুনিক অস্ত্র ও হামলা চালানোর সাহস দেখাচ্ছে। যদিও তেহরান বিদ্রোহীদেরকে নৈতিক সমর্থন ছাড়া আর অন্য কিছু দেওয়ার কথা স্পষ্টভাবে অস্বীকার করেছে। সৌদি নেতৃত্বাধীন জোট ও হুথিদের মধ্যে এই লড়াই কয়েক লাখ ইয়েমেনির জীবন ঝুঁকির মধ্যে ফেলেছে। মাঝেমাঝেই যুদ্ধের কারণে প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র এবং মানবিক সহায়তার সরবরাহগুলি বাধাগ্রস্ত হয়েছে।
আরও পড়ুন- শিশুদের জন্য কোন কোন কোভিড টিকা অনুমোদিত? দেখে নিন তালিকা!
এদিকে, পারস্য উপসাগরীয় এলাকায় বিদ্যমান উত্তেজনার পরিস্থিতিতে আসরে নামছে আমেরিকা (USA)। সৌদি আরবকে সঙ্গে নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে আলোচনায় বসেছে সংযুক্ত আরব আমিরশাহি। হোয়াইট হাউসের এক বিবৃতিতে ত্রিপাক্ষিক এই বৈঠকের বিষয়টি নিশ্চিত করা হয়েছে। বিবৃতিতে বলা হয়েছে, মার্কিন জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা জ্যাক সুলিভান সংযুক্ত আরব আমিরশাহি এবং সৌদি আরবের রাষ্ট্রদূতদের সঙ্গে বৈঠক করেছেন। হুথি বিদ্রোহীরা অসামরিক লোকজনকে টার্গেট করে হামলা চালাচ্ছে। এই হামলা নিয়ে আলোচনার জন্য বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়েছে। এসব হামলার ফলে উভয় দেশেই অসামরিক মানুষের হতাহতের ঘটনা ঘটেছে।
