ভারতে শক্তির উৎস হিসেবে কয়লার ব্যবহার কী রকম?
ভারতের মোট বিদ্যুত উৎপাদন ক্ষমতার ৫০ শতাংশেরও বেশি কয়লা থেকে আসে। ভারতে বিশ্বের চতুর্থ বৃহত্তম দেশ, যেখানে সবচেয়ে বেশি কয়লা মজুত রয়েছে। এটি সস্তা ও অবিরত বিদ্যুত পরিষেবা যে কোনও দেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির একটি মূল চালক। তাই বিদ্যুৎ কভারেজ বাড়ানো সরকারের একটি কেন্দ্রীয় লক্ষ্য। যদিও ভারত পুনর্নবীকরণযোগ্য (Renewables) শক্তির উপর পদক্ষেপ নেওয়ার ক্ষেত্রে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। আর এই পরিচ্ছন্ন শক্তির উৎপাদন সর্বাধিক করার জন্য পরিকাঠামো স্থাপনের জন্য বিশাল বিনিয়োগের প্রয়োজন। যার জন্য উন্নত দেশগুলি উন্নয়নশীল দেশগুলিকে সাহায্য করবে বলে আশা করা হচ্ছে, যদিও তারা এই বিষয়ে ততটা কাজে করে দেখাতে পারেনি যতটা হাইলাইট করা হয়েছে। ২০১৫ সালে প্যারিস জলবায়ু চুক্তির সময়ে কার্বন নির্গমনের পরিমাণ কমাতে উদ্যোগী হওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল ভারত-সহ বহু দেশই। ঠিক হয়েছিল, কার্বন নির্গমণ কমিয়ে এই শতাব্দীর মধ্যে বিশ্ব উষ্ণায়নের মাত্রা অন্তত ১.৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস কমিয়ে আনা হবে। কিন্তু, জার্মানি ছাড়া আর কেউ সে ভাবে সচেষ্ট হয়নি। জার্মানি ইতিমধ্যে সমস্ত কয়লা খনি বন্ধ করে দিয়েছে।
advertisement
এই পরিস্থিতিতে, ভারত, চিন সহ উন্নয়নশীল বিশ্বের দেশগুলি যুক্তি দিয়েছে যে তাদের কয়লা ব্যবহার (Coal energy Use) বন্ধের জন্য চাপ দেওয়া অন্যায্য। কারণ তাদের এখনও লাখ লাখ মানুষকে দারিদ্র্য থেকে বের করে আনার সমস্যাটির সমাধান করতে হবে। বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, শক্তি নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে তার মজুত থাকা প্রচুর কয়লার ব্যবহার করতে চাইছে ভারত। বিদ্যুতের চাহিদা মেটানোর জন্য ভারত এমনিতেই প্রচুর পরিমাণে কয়লা আমদানি করে।
২০৪০ সাল নাগাদ দেশে বিদ্যুতের চাহিদা (Electricity Demand) দ্বিগুণ হবে বলে পূর্বাভাস দেওয়া হয়েছে। বর্তমানে ভারতের বিদ্যুৎ উৎপাদনের ক্ষমতা ৪০০ গিগাওয়াটের সামান্য কম। যার মধ্যে কয়লা বা তাপবিদ্যুৎ থেকে আসে ২০০ গিগাওয়াট। প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি (Narendra Modi) গ্লাসগোতে বলেছিলেন যে ২০৩০ সালের মধ্যে ৫০০ গিগাওয়াট পুনর্নবীকরণযোগ্য শক্তির আধার হবে ভারত। পাশাপাশি ওই একই সময়ের মধ্যে দেশের মোট প্রয়োজনীয় বিদ্যুতের ৫০ শতাংশ পুনর্নবীকরণযোগ্য শক্তি থেকে ব্যবহার করা হবে। এখন থেকে শুরু করে ২০৩০ সালের মধ্যে ১০০ কোটি টন কার্বন নির্গমন কমিয়ে আনবে ভারত। কার্বনের উপর দেশীয় অর্থনীতির নির্ভরশীলতা ৪৫ শতাংশ কমিয়ে আনা হবে ২০৩০ সালের মধ্যে। বর্তমানে, জলবিদ্যুৎ সহ পুনর্নবীকরণযোগ্য উৎসগুলি থেকে ভারতে প্রায় ১৫০ গিগাওয়াট অভ্যন্তরীণ শক্তি তৈরি হয়।
আরও পড়ুন - Kolkata Earthquake: ঘুম ভাঙার আগেই প্রবল কম্পনে কেঁপে উঠল কলকাতা, ভূমিকম্প বাংলাদেশের চট্টগ্রামেও
খসড়া জাতীয় বিদ্যুৎ নীতি-২০২১ (Draft National Electricity Policy, 2021) অনুযায়ী, ভারত ‘নন ফসিল’ উৎসের (Non-Fossil Fuel Sources) মাধ্যমে আরও শক্তি যোগ করতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। দেশে কয়লা-ভিত্তিক উৎপাদন ক্ষমতা এখনও যোগ করার প্রয়োজন হতে পারে, যেহেতু এটি বিদ্যুত উৎপাদনের সবচেয়ে সস্তা উৎস হয়ে চলেছে। এছাড়াও, সারাদেশে প্রায় ৪০ লাখ লোক কয়লা শিল্প থেকে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে যুক্ত। তাই কয়লার উপর নির্ভরতা শেষ করার জন্য যে কোনও অপ্রত্যাশিত পদক্ষেপ তাদের জীবিকাকেও হুমকির মুখে ফেলবে।
ভারতে কোম্পানিগুলি কি কয়লার ব্যবহার থেকে দূরে সরে যাচ্ছে না?
কেন্দ্র তার কয়লা খনির নিলামের জন্য ক্রেতাদের খুঁজে পেতে কাঠকড় পোড়াচ্ছে। এটি একটি স্পষ্ট ইঙ্গিত যে সংস্থাগুলি এই সময়ে কয়লা উৎপাদনে বিনিয়োগের বিষয়ে সতর্ক রয়েছে যখন জীবাশ্ম জ্বালানি-ভিত্তিক শক্তির উৎসগুলি (Fossil Fuel-Based Energy Sources) বন্ধ করার জন্য আন্তর্জাতিক মঞ্চ থেকে চাপ রয়েছে। ২০২১ সালের অক্টোবরে তৃতীয় কিস্তিতে নিলামের জন্য ৮৮টি বাণিজ্যিক কয়লা খনি তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। এর মধ্যে ৪৮টি খনির আগের দুই রাউন্ডে নিলামে কোনও সংস্থা দরপত্র জমা দেয়নি। দ্বিতীয় কিস্তিতে ৬৭টি খনির মধ্যে ৪৮টির জন্য কোনও দরপত্র পাওয়া যায়নি।
এই বছরের শুরুর দিকে আর্থিক থিঙ্ক ট্যাঙ্ক কার্বন ট্র্যাকারের (Carbon Tracker) একটি প্রতিবেদনে বলা হয়েছে যে বেশিরভাগ নতুন কয়লা-চালিত প্ল্যান্ট অর্থনৈতিকভাবে অকেজো হয়ে উঠতে পারে, যার ফলে বিলিয়ন ডলারের ক্ষতি হতে পারে। কার্বন ট্র্যাকারের পাওয়ার অ্যান্ড ইউটিলিটির প্রধান ক্যাথারিনা হিলেনব্র্যান্ড ভন ডের নেওয়ান বলেন, "কয়লা বিদ্যুতের এই শেষ জাহাজগুলি জোয়ারের বিরুদ্ধে সাঁতার কাটছে, যখন পুনর্নবীকরণযোগ্যগুলি একটি সস্তা সমাধান। এটা বিশ্বব্যাপী জলবায়ু পরিবর্তনের লক্ষ্যগুলিকেও সমর্থন করে। বিনিয়োগকারীদের নতুন কয়লা প্রকল্পগুলি থেকে দূরে সরে যাওয়া উচিত, যার মধ্যে অনেকগুলিই শুরু থেকেই লোকসান দিতে পারে।"
আরও পড়ুন - Panchang 26 November: পঞ্জিকা ২৬ নভেম্বর: দেখে নিন নক্ষত্রযোগ, শুভ মুহূর্ত, রাহুকাল এবং দিনের অন্য লগ্ন!
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে যে পুনর্নবীকরণযোগ্য থেকে ক্রমবর্ধমান চাপের মধ্যে এবং পরিবেশগত বিধিনিষেধ কঠোর করার ফলে কয়লা প্ল্যান্টগুলি ব্যবহার কমতে পারে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন যে শক্তির উৎপাদনে কয়লার ব্যবহার সামগ্রিকভাবে হ্রাস পেলেও, খনিজটির ব্যবহার এখনও বৃদ্ধি পাবে। ২০২১ সালের তৃতীয় ত্রৈমাসিকে কয়লার উপর ভারতের প্রবল নির্ভরতার একটি ইঙ্গিত এসেছিল। কারণ কোভিড সংক্রমণ অনেকটাই নিয়ন্ত্রণে আসায় অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড শুরু হয়েছিল। বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলি জানিয়েছে যে দেশজুড়ে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড শুরু হওয়ার পরে আচমকা বিদ্যুতের চাহিদা বেড়ে গিয়েছিল, সরবরাহে ঘাটতি হচ্ছিল। কারণ, সেই তুলনায় আমদানি কম হচ্ছিল।
পর্যাপ্ত কয়লা মজুত বজায় রাখার প্রয়োজনীয়তা উল্লেখ করে খসড়া বিদ্যুৎ নীতিতে বলা হয়েছে যে বিশ্বের চতুর্থ বৃহত্তম কয়লার মজুত রয়েছে ভারতে। তবুও আমরা কয়লা আমদানি করছি এবং এইভাবে বিপুল পরিমাণ মুদ্রা হারাচ্ছি। তাই বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলিতে আমদানি করা কয়লার ব্যবহার কমাতে হবে।
কয়লার চাহিদা মেটাতে ভারত কী করছে?
যদিও কয়লা একটি শক্তির প্রধান উৎস হিসাবে অব্যাহত থাকবে বলে আশা করা হচ্ছে। আন্তর্জাতিক শক্তি সংস্থা (IEA)-র একটি প্রতিবেদনে বলা হয়েছে যে ভারতের পাওয়ার সেক্টরের উপর কয়লার দখল শিথিল হচ্ছে। তবে ২০৪০ সাল পর্যন্ত ভারতে শিল্পের ক্ষেত্রে কয়লার চাহিদা বৃদ্ধি পাবে। এক দিকে, ভারতে শক্তির মিশ্রণে পুনর্নবীকরণযোগ্য শক্তির অংশ বাড়ছে, অপর দিকে দেশটি নতুন কয়লা-চালিত প্ল্যান্টেও বিনিয়োগ করছে। বিশ্ব জুড়ে মোট পরিকল্পিত নতুন কয়লা চালিত প্ল্যান্টের ৮০ শতাংশ এশিয়া মহাদেশের ৫টি দেশ করেছে। ভারত সেই ৫টি দেশের মধ্যে রয়েছে।
আন্তর্জাতিক শক্তি সংস্থা বলেছে যে বর্তমানে নির্মাণাধীন কয়লা-ভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলি কয়েক বছরে সম্পূর্ণ হলে ভারতের কয়লা বহরে মোটেও কোনও বৃদ্ধি হবে না। কারণ, সামগ্রিক শক্তি মিশ্রণে কয়লার অংশ ক্রমাগত কমছে। ২০১৯ সালে ছিল ৪৪ শতাংশ, এটাই ২০৪০ সালে হবে ৩৪ শতাংশ। খসড়া বিদ্যুৎ নীতিতে বলা হয়েছে, যে কোনও সময়ে কয়লা-ভিত্তিক পাওয়ার স্টেশনগুলির জন্য সবচেয়ে দক্ষ প্রযুক্তি গ্রহণ করার প্রচেষ্টা করা উচিত এবং প্ল্য়ান্টগুলি শুধুমাত্র সুপার ক্রিটিক্যাল/আল্ট্রা ক্রিটিক্যাল টেকনোলজি বা অন্যান্য আরও দক্ষ প্রযুক্তির হওয়া উচিত। ২০৭০ সালে নিট জিরো লক্ষ্য অর্জনের জন্য ১০ ট্রিলিয়ন মার্কিন ডলারের বেশি বিনিয়োগের প্রয়োজন হবে ভারতের। যা দেশের বর্তমান জিডিপি-র তিনগুণেরও বেশি। বিদ্যুৎ খাতকে কয়লার উপর নির্ভরতা থেকে দূরে রাখতে উন্নত দেশগুলি থেকে ১.৪ ট্রিলিয়ন মার্কিন ডলারের বিনিয়োগ সমর্থন প্রয়োজন হবে ভারতের।
বিশ্বব্যাপী কয়লা ব্যবহারের অবস্থা কী?
carbonbrief.org-র একটি প্রতিবেদনে বলা হয়েছে যে ২০০০ সাল থেকে কয়লা চালিত বিদ্যুতের ক্ষমতা দ্বিগুণ হয়ে প্রায় ২,০৪৫ গিগাওয়াট হয়েছে বিশ্বে। যদিও ২০১৪ সাল থেকে কয়লার ব্যবহার কমেছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন যে বিশ্বব্যাপী অবিরত কয়লার ব্যবহার প্রায় ৮০ শতাংশ হ্রাস পাবে এই দশকে। যদি উষ্ণায়ন প্রাক-শিল্প সময়ের তাপমাত্রার উপরে ১.৫ ডিগ্রি সেলসিয়াসের কমে সীমাবদ্ধ রাখা হয়। বিশ্বব্যাপী বিদ্যুৎ সরবরাহের প্রায় ৪০ শতাংশ উৎপাদন হয় কয়লা থেকে। চিন কয়লাচালিত প্ল্যান্টের সংখ্যায় বিশ্বে নেতৃত্ব দেয় এবং সেই দেশে ১ হাজারের বেশি কার্যকরী প্ল্যান্ট রয়েছে, যা ভারতের থেকে প্রায় চারগুণ বেশি। চিনে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ সংখ্যক কয়লা কেন্দ্র রয়েছে। তালিকায় তৃতীয় স্থানে রয়েছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। এর পর রয়েছে রাশিয়া ও জাপান। তাই শুধুমাত্র উন্নয়নশীল দেশগুলিই নয়, উন্নত দেশগুলিও তাদের শক্তির চাহিদা মেটাতে কয়লার উপর নির্ভরশীল।
প্রকৃতপক্ষে, মার্কিন প্রশাসন বলেছে যে প্রাকৃতিক গ্যাসের দাম বাড়ার কারণে এই বছর কয়লা-চালিত বিদ্যুৎ উৎপাদন বৃদ্ধি পাবে। একটি প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে যে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে কয়লা এবং প্রাকৃতিক গ্যাস হল বৃহত্তম দু'টি বিদ্যুৎ উৎপাদনের উৎস।