ভারত ও ফিলিপাইনসের মধ্যে ঠিক কী চুক্তি হতে পারে?
ফিলিপাইনস ব্রহ্মস ক্রুজ মিসাইল সিস্টেমের প্রথম বিদেশি ক্রেতা হতে চলেছে। উপকূল-ভিত্তিক জাহাজ-বিরোধী অত্যাধুনিক অস্ত্র ব্যবস্থা (Shore-Based Anti-Ship Missile System) অধিগ্রহণের জন্য প্রাথমিকভাবে ২.৮ বিলিয়ন পেসো (৫৫.৫ মিলিয়ন মার্কিন ডলার) বরাদ্দও করেছে দেশটি। রিপোর্টে প্রকাশিত তথ্য অনুযায়ী, ভারত এবং ফিলিপাইনসের (Philippines) মধ্যে ব্রহ্মস সুপারসনিক ক্রুজ মিসাইল (BrahMos Missile) বিক্রির বিষয়ে আলোচনার চূড়ান্ত পর্যায়ে এই সিদ্ধান্ত হয়েছে। খুব দ্রুত এই চুক্তি স্বাক্ষর হতে পারে।
advertisement
আরও পড়ুন - IPL 2022: ধোনিকে খোঁচা দিয়ে ট্যুইট কেকেআরের, পাল্টা উত্তর দিতে আসরে রবীন্দ্র জাদেজা
ভারত এবং ফিলিপাইনস প্রতিরক্ষা সরঞ্জাম কেনা-বেচার জন্য একটি কাঠামোগত চুক্তি (Framework Agreement) স্বাক্ষর করেছে বলে জানা গিয়েছে। ফিলিপাইনস ব্রহ্মস কিনলে তা চিনের (China) জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ সঙ্কেত হবে। বিশেষ করে দক্ষিণ চিন সাগরে (South China Sea) চিনের আক্রমণাত্মক অবস্থানের প্রেক্ষিতে। কারণ, দক্ষিণ চিন সাগরে চিনের দাবি নিয়ে অন্য দেশের মতো ফিলিপাইনসের সঙ্গেও বেজিংয়ের বিবাদ রয়েছে। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে যে থাইল্যান্ড, ইন্দোনেশিয়া, ভিয়েতনাম-সহ দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার আরও বেশ কয়েকটি দেশ ব্রহ্মস মিসাইল কিনতে আগ্রহ দেখিয়েছে। এছাড়াও, সংযুক্ত আরব আমিরশাহি, সৌদি আরব, আর্জেন্টিনা, ব্রাজিল এবং দক্ষিণ আফ্রিকাও সম্ভাব্য ক্রেতাদের তালিকায় রয়েছে বলে সূত্রের খবর।
ব্রহ্মস মিসাইল কী?
ব্রহ্মস হল একটি স্বল্প-পাল্লার, সুপারসনিক অ্যান্টি-শিপ/ল্যান্ড অ্যাটাক ক্রুজ মিসাইল (Supersonic Anti-Ship/Land Attack Cruise Missile)। ১৯৯৮ সালে রাশিয়ার এনপিও মাশিনোস্ট্রোয়েনিয়া (NPO Mashinostroyeniya) এবং ভারতের প্রতিরক্ষা গবেষণা ও উন্নয়ন সংস্থা বা ডিআরডিও (Defence Research and Development Organisation)-র মধ্যে একটি যৌথ উদ্যোগে নির্মিত হয় এই মিসাইল। ব্রহ্মস (BrahMos Missile) হল বিশ্বের সেরা সুপারসনিক ক্রুজ মিসাইল। যা ভারতের ব্রহ্মপুত্র এবং রাশিয়ার মস্কভা নদীর নামে নামকরণ করা হয়েছে। শব্দের চেয়ে প্রায় ৩ গুণ দ্রুত গতিতে ছুটে যাওয়া এই মিসাইলটি শুধু বিশ্বের দ্রুততম সুপারসনিক ক্রুজ মিসাইলই নয়, এর উচ্চ গতির কারণে এটিকে রাডারও ধরতে অক্ষম।
এই মিসাইলটি ভূমি, জাহাজ, সাবমেরিন এবং বিমান থেকে উৎক্ষেপণ করা যেতে পারে। ভ্যারিয়ান্ট এবং লঞ্চ প্ল্যাটফর্মের উপর নির্ভর করে ব্রহ্মসের পাল্লা ৩০০-৫০০ কিমি। ২০০-৩০০ কেজি ওজন বহনে সক্ষম এটি। তবে, সংস্করণের ভিত্তিতে মিসাইলের ওজন নেওয়ার ক্ষমতা ২,২০০ থেকে ৩,০০০ কেজির মধ্যে হতে পারে। ব্রহ্মসের রফতানি সংস্করণের পাল্লা হবে ২৯০ কিলোমিটার। যা মিসাইল টেকনোলজি কন্ট্রোল রেজিম-র (Missile Technology Control Regime) দ্বারা আরোপিত ৩০০ কিলোমিটার পাল্লার অধীনেই।
আরও পড়ুন - IPL 2022: আইপিএল Venue নিয়ে জোর চিন্তায় BCCI, করোনার বাড়বাড়ন্তে ফের কি বিদেশেই টুর্নামেন্ট
ব্রহ্মস পরিচিত তার সুপারসনিক গতির (Supersonic Speed) জন্য। এই মিসাইল শব্দের চেয়ে প্রায় ৩ গুণ গতিতে ছোটে। যার ফলে এটিকে আটকানো কঠিন হয়ে যায়। এছাড়াও এই মিসাইল বৃহত্তর স্ট্রাইক পাওয়ারও দেয়। নির্মাতারা বলছে যে এক সেকেন্ডে প্রায় এক কিলোমিটার গতিতে ছুটতে পারে ব্রহ্মস। সুপারসনিক গতি এবং ওয়ারহেড ভর, এই দুইয়ের মিশেলে ব্রহ্মসকে উচ্চ গতিশক্তি প্রদান করে, যা প্রাণঘাতী প্রভাব নিশ্চিত করে। ব্রহ্মস হল বিশ্বের একমাত্র পরিচিত বহুমুখী সুপারসনিক ক্রুজ মিসাইল, যা পরিষেবাতে রয়েছে।
ব্রহ্মসকে স্টিলথ প্রযুক্তিতেও (Stealth Technology) সজ্জিত বলে বলা হয়। যা এটিকে রাডার এবং অন্যান্য ডিটেনশন সিস্টেমে কম দৃশ্যমান করে। ব্রহ্মসের একটি হাইপারসনিক সংস্করণ ব্রহ্মস ২ তৈরি করা হচ্ছে, যা শব্দের চেয়ে ৫ গুণ গতিতে আঘাত করতে সক্ষম হবে। ভারতের প্রতিরক্ষা মন্ত্রক সম্প্রতি বলেছে যে ব্রহ্মস অ্যারোস্পেস (BrahMos Aerospace) 'পরবর্তী প্রজন্মের' জন্য ব্রহ্মস-এনজি (BrahMos-NG)-র কাজ শুরু করেছে, যা আরও উন্নত রূপ। আগেরগুলির তুলনায় এটি হবে ছোট, হালকা, যাতে এটি বিভিন্ন আধুনিক সামরিক প্ল্যাটফর্মে ইনস্টল করা যায়। হায়দরাবাদের ব্রহ্মস ইন্টিগ্রেশন কমপ্লেক্সে (BrahMos Integration Complex) এই মিসাইলের সাব সিস্টেমগুলির পরীক্ষা করে যুক্ত করা হয় এবং এখানেই মিসাইলের যান্ত্রিক ও ইলেকট্রনিক সিস্টেমগুলি একত্রিত করা হয়। ভারত ও রাশিয়ার অন্যান্য কেন্দ্রে এই মিসাইলের বিভিন্ন অংশ তৈরি হয়।
২০২১ সালের ডিসেম্বরে উত্তরপ্রদেশের লখনউতে ব্রহ্মস মিসাইল উৎপাদন ইউনিটের (BrahMos Manufacturing Centre) ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন প্রতিরক্ষা মন্ত্রী রাজনাথ সিং (Defence Minister Rajnath Singh)। এই ইউনিটে ব্রহ্মস-এনজি (BRAHMOS-NG) (পরবর্তী প্রজন্ম) মিসাইল তৈরি হবে। নতুন ইউনিটটি আগামী দুই থেকে তিন বছরের মধ্যে তৈরি হয়ে যাবে। প্রতি বছর গড়ে ৮০-১০০টি ব্রহ্মস-এনজি মিসাইলের উৎপাদন শুরু করবে।
প্রতিরক্ষা রফতানিকে ভারত কোথায় অবস্থান করছে?
স্টকহোম ইন্টারন্যাশনাল পিস রিসার্চ ইনস্টিটিউট (Stockholm International Peace Researcch Institute)-র গত মার্চের একটি প্রতিবেদনে বলা হয়েছে যে ২০১৬-২০২০ সালের মধ্যে ভারত শীর্ষ পাঁচটি অস্ত্র আমদানিকারক দেশের মধ্যে একটি ছিল। কিন্তু, কেন্দ্রীয় সরকার দেশীয় উৎপাদন বাড়িয়ে অস্ত্র আমদানি কমানোর কৌশল নিয়েছে। ইতিমধ্যেই বিদেশ থেকে নানা অস্ত্র ও সরঞ্জাম আনার উপরে নিষধাজ্ঞা জারি হয়েছে। একটি তালিকাও তৈরি করা হয়েছে, ওই তালিকায় উল্লিখিত প্রতিরক্ষা সাব-সিস্টেম, উপাদান এবং হার্ডওয়্যারগুলি আমদানি না করে দেশীয় সংস্থাগুলির থেকে কেনা হবে। অবজারভার রিসার্চ ফাউন্ডেশন (ORF)-র রিপোর্ট বলছে যে নয়াদিল্লির লক্ষ্য হল দেশীয় উৎপাদন বাড়াতে পদক্ষেপ নেওয়া, যাতে ২০২৫ সালের মধ্যে দেশ প্রতিরক্ষা রফতানি থেকে ৫ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের স্বল্পমেয়াদী লক্ষ্য অর্জন করতে সক্ষম হয়। ২০১৬-২০২০ সালের মধ্যে বিশ্বব্যাপী অস্ত্র আমদানির মোট মূল্যের মধ্যে ভারতের অংশ ছিল ৯.৫ শতাংশ। সৌদি আরবের পরেই ভারতের স্থান। ORF-র রিপোর্টে বলা হয়েছে, নয়াদিল্লির লক্ষ্য এখন প্রতিরক্ষা ব্যবস্থার জন্য অন্যান্য দেশের উপর নির্ভরতা কমানো।
তথ্য অনুযায়ী, ইতিমধ্যেই বিশ্বব্যাপী অস্ত্র রফতানিতে ভারত তার অংশ বাড়িয়েছে। ভারত এই মুহূর্তে অস্ত্র রফতানিতে বিশ্বের ২৪তম স্থানে। মোট যা বিশ্বে অস্ত্র রফতানি হয় তার ০.২ শতাংশ করে ভারত। ২০১১-১৫ তে এই হার ছিল ০.১ শতাংশ। ২০১১-১৫ সালের তুলনায় ২০১৬-২০২০ সালে ভারতের রফতানি শেয়ার ২২৮ শতাংশ বেড়েছে। মূলত শ্রীলঙ্কা, মরিশাস ও মায়ানমার ভারত থেকে অস্ত্র কেনে। কিন্তু, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, রাশিয়া, ফ্রান্স, জার্মানি বা চিনের মত একটি প্রধান অস্ত্র রফতানিকারক হিসাবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করার আগে ভারতকে দীর্ঘ পথ পাড়ি দিতে হবে। উল্লিখিত দেশগুলির দখলে রয়েছে বিশ্বব্য়াপী অস্ত্র রফতানির ৭৬ শতাংশ বাজার। ORF উল্লেখ করেছে যে নয়াদিল্লিকে অস্ত্র রফতানিতে ভারসাম্য রাখতে হবে সেই দেশগুলির সঙ্গে, যাদের সঙ্গে ভারতের কৌশলগত সম্পর্ক রয়েছে।
একটি অনলাইন সংস্থার রিপোর্ট বলছে যে ২০২০ সালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ৯.৩ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের বেশি অস্ত্র বিক্রি করে রফতানিকারক দেশগুলির মধ্যে শীর্ষে রয়েছে। তার পরে রয়েছে রাশিয়া, যারা অস্ত্র রফতানি থেকে ৩.২ বিলিয়ন মার্কিন ডলার আয় করেছে। ২ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের কিছু কম বিক্রি করে ফ্রান্স তৃতীয় স্থানে রয়েছে। একই বছরে ভারত ১৫০ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের অস্ত্র রফতানি করেছিল।