কিলি পল ও নিমা পল: বছর ২৬-এর কিলি এবং বছর ২৩-এর নিমা তানজানিয়ার (Tanzania) পূর্ব পাওয়ানি অঞ্চলের (Eastern Pwani Region) বাসিন্দা। তাঁরা গবাদি পশুপালক। বিবিসি আফ্রিকাকে দেওয়া একটি সাক্ষাৎকারে তাঁরা জানিয়েছেন যে তাঁদের গ্রামে বিদ্যুৎ ছিল না এবং কিলি তাঁর মোবাইল ফোন চার্জ করার জন্য প্রতিদিন নিকটতম শহর লুগোবাতে যান। জীবনের কষ্ট কমাতে একটু অতিরিক্ত উপার্জনের আশায় তাঁরা দেশের ঐতিহ্যবাহী মাসাই পোশাক (Masai Attire) পরে টিকটকে গানের সঙ্গে লিপ-সিঙ্ক করা শুরু করেছিলেন। তানজানিয়ার রাজধানী দোডোমাতে স্কুলে পড়ার সময় হিন্দি সিনেমার অনুরাগী হয়ে ওঠা কিলির জন্য বলিউডের গান বেছে নেওয়া ছিল খুবই স্বাভাবিক ব্যাপার। কিলি এবং নিমা বলেছেন যে তাঁরা বলিউডের বড় ভক্ত এবং স্থানীয় সিনেমায় বেশ কয়েকটি ছবি দেখেছেন। কিলির প্রিয় অভিনেতা হৃতিক রোশন (Hrithik Roshan), সলমন খান (Salman Khan) এবং টাইগার শ্রফ (Tiger Shroff), অন্য দিকে নিমা মাধুরী দীক্ষিত নেনের (Madhuri Dixit Nene) ভক্ত।
advertisement
আরও পড়ুন - Job Vacancy: গ্যাস অথরিটি অফ ইন্ডিয়ার অধীনে প্রচুর পদে নিয়োগের বিজ্ঞপ্তি জারি
কিলি বলেন, "আমি কখনই ভারতে যাইনি, কিন্তু আমার কল্পনায় আমি সেখানে দীর্ঘকাল ছিলাম। মুম্বই (Mumbai) যখন বম্বে (Bombay) ছিল, তখন আমি সেখানে ছিলাম। আমি সেখানে ছিলাম যখন সঞ্জয় দত্ত (Sanjay Dutt) এবং অক্ষয় কুমার (Akshay Kumar) অনেক মন ছুঁয়ে যাওয়া ছবি করছেন। তাঁরা সবসময় পুরনো স্মৃতি ফিরিয়ে আনেন। আমি হিন্দি সিনেমা এবং গানের প্রেমে পড়েছি। আপনি যখন কিছু ভালবাসেন, তখন তা তুলে ধরা বা অনুকরণ করা কঠিন কিছু নয়।" কিলি জানিয়েছেন, বোন নিমাকেও তিনি গানের সঙ্গে লিপ সিঙ্ক করা শিখিয়েছিলেন। রিহার্সালের সময় গানের কথা ইংরেজিতে অনুবাদ করে নিতেন, যাতে ক্যামেরার সামনে নির্ভুলভাবে আবেগ প্রকাশ করতে পারেন। গত বছর এই ভাই-বোন রাতারাতি জনপ্রিয় হয়ে ওঠে যখন রাতাঁ লম্বিয়া (Raataan Lambiyan) গানে তাঁদের লিপ-সিঙ্ক ভিডিও সোশাল মিডিয়ায় ভাইরাল হয়। এর পরই তাঁরা হিন্দি, হরিয়ানভি এবং পঞ্জাবি হিট গানে পারফর্ম করতে উৎসাহিত বোধ করেন। লতা মঙ্গেশকরের গাওয়া 'জানে কেয়া বাত হ্যায়' (Jaane Kya Baat Hai) গানে লিপ-সিঙ্ক করে তাঁরা ভিডিও বানান। এর মাধ্যমেই তাঁরা লতাকে শ্রদ্ধাঞ্জলি দেন, তাঁদের এই প্রচেষ্টা সবার হৃদয় ছুঁয়ে যায়। এরপর প্রজাতন্ত্র দিবসে ভারতের জাতীয় সঙ্গীতে তাঁরা লিপ সিঙ্ক করেন।
আরও পড়ুন - Maha Shivratri: সামনেই শিবরাত্রি তাতে কখনই এই কাজ করবেন না, রুষ্ট হবেন মহাদেব
বেশিরভাগ নেটিজেন তাঁদের আন্তরিকতা, সততায় মুগ্ধ হন। তাঁরা নিজের দেশের ঐতিহ্যকে না ভুলেই অন্য দেশের সংস্কৃতিকে আপন করে নিয়েছেন, এটাই তাঁদের আরও জনপ্রিয় করে তোলে। কিলি তাঁদের সম্পর্কে বিশ্ব জুড়ে ছড়িয়ে থাকা ভারতীয়দের মতামত এবং প্রতিক্রিয়া দেখে সম্পূর্ণভাবে অভিভূত। কিলির ইনস্টাগ্রাম পেজে ২.৫ মিলিয়নেরও বেশি ফলোয়ার রয়েছে। তালিকায় রয়েছেন রিচা চড্ডা (Richa Chadha), গুল পনাগ (Gul Panag) এবং আয়ুষ্মান খুরানার (Ayushmann Khurrana) মতো সেলিব্রিটিরাও।
সাংস্কৃতিক দূত: বলিউড ভারতের কূটনীতির সম্পদগুলির মধ্যে একটি এবং এই ভাই-বোন জুটি কয়েকটি অফার সেখান থেকে ইতিমধ্যেই পেতে শুরু করেছেন। তানজানিয়ায় ভারতীয় হাইকমিশনারের অফিসে (High Commission of India, Dar Es Salaam, Tanzania) তাঁদের অভিনন্দন জানানো হয়েছে। তার ছবি কিলি তাঁর ইনস্টাগ্রাম হ্যান্ডেলে শেয়ার করেছেন। এর পরই আসে প্রধানমন্ত্রীর প্রশংসা। মন কি বাতে প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, "কিলি এবং নিমার ভাই-বোন জুটির মতো আমি প্রত্যেককে, বিশেষ করে বিভিন্ন রাজ্যের বাচ্চাদের জনপ্রিয় গানের লিপ-সিঙ্ক ভিডিও তৈরি করার জন্য (তাদের চেয়ে আলাদা রাজ্য থেকে) অনুরোধ করছি। আমরা 'এক ভারত শ্রেষ্ঠ ভারত'কে পুনরায় সংজ্ঞায়িত করব এবং ভারতীয় ভাষাগুলিকে জনপ্রিয় করব।" ভারতীয় গানে পারফর্ম করার সময় কিলি এবং নিমা তাঁদের পরিচয় নিয়ে গর্ব করেছিলেন, এই বিষয়টিরও প্রশংসা করেছেন নরেন্দ্র মোদি।
প্রধানমন্ত্রীর এই প্রশংসার খবর পৌঁছে গিয়েছে সুদূর তানজানিয়াতেও। সোশাল মিডিয়া হ্যান্ডেলে প্রধানমন্ত্রীকে ধন্যবাদ জানিয়ে উচ্ছ্বসিত কিলি পল লেখেন, ‘আমি ভীষণ খুশি। এমন দারুণ একটা খবর দিয়ে দিন শুরু করায় আমি উচ্ছ্বসিত। নরেন্দ্র মোদির উৎসাহ আমাকে আরও অনুপ্রেরণা দিয়েছে।"
এক ভারত শ্রেষ্ঠ ভারত: বৈচিত্র্যের মধ্যে ঐক্য – এই আবেগ ও মানসিকতা গড়ে তোলার লক্ষ্যে ২০১৫ সালে ৩১ অক্টোবর ভারতের প্রথম উপপ্রধানমন্ত্রী ও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সর্দার বল্লভভাই পটেলের (Vallabhbhai Patel) জন্মদিনে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি ‘এক ভারত, শ্রেষ্ঠ ভারত’ (Ek Bharat Shreshtha Bharat) কর্মসূচির কথা বলেন। ভারতের বিভিন্ন রাজ্যের সাধারণ মানুষ যাতে একে অপরের সম্পর্কে জানতে পারেন, সেই উদ্দেশ্যেই সূচনা এই বিশেষ কর্মসূচিটির। ‘এক ভারত, শ্রেষ্ঠ ভারত’ কর্মসূচির মাধ্যমে বৈচিত্রের মধ্যে ঐক্যের ধারণা প্রচার করা এবং বিভিন্ন জনগোষ্ঠীর মধ্যে মানসিক ও ভাবগত বন্ধন সুদৃঢ় করার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। এমন একটি কাঠামো তৈরি করা হয়েছে যাতে রাজ্যগুলি ও কেন্দ্রশাসিত অঞ্চলের জনগণের মধ্যে জাতীয় সংহতির ধারণার ব্যাপক প্রচার চলে। রাজ্যগুলির সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য সম্বন্ধে যাতে একে অপরের কাছে ব্যাপকভাবে পরিচিত হতে পারে, তার জন্য উপযুক্ত ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। মূল কথা হল রাজ্যগুলির মধ্যে ভাষা, শিক্ষা, সংস্কৃতি, ঐতিহ্য ও সঙ্গীত, পর্যটন এবং রন্ধনপ্রণালী, খেলাধুলা ইত্যাদি ক্ষেত্রে একটি টেকসই এবং কাঠামোগত সাংস্কৃতিক সংযোগ ও আদান-প্রদানের কার্যক্রম পরিচালনা করা হবে। যাতে বিভিন্ন রাজ্যের মধ্যে ভাতৃত্ববোধ ও বন্ধনের আবহ গড়ে তোলা যায়।
উদাহরণ স্বরূপ, এই কর্মসূচিতে রাজ্য ও কেন্দ্রশাসিত অঞ্চলগুলিকে ১৬টি ভাগে ভাগ করা হয়েছে। যেমন- কেন্দ্রশাসিত অঞ্চল জম্মু-কাশ্মীর তামিলনাডুর সঙ্গে, পঞ্জাব অন্ধ্রপ্রদেশের সঙ্গে, উত্তরাখন্ড কর্ণাটকের সঙ্গে জোড়া হয়েছে। পঞ্জাবিরা তেলেগুতে মূল শব্দগুলি শেখার চেষ্টা করবে, কয়েকটি তেলেগু বই পঞ্জাবিতে অনুবাদ করা হবে এবং বিপরীতে অন্ধ্রপ্রদেশ পঞ্জাবি খাবারের অফার করে খাদ্য উৎসবের আয়োজন করবে, পঞ্জাবিরা পারফর্ম করবে অন্ধ্রের লোকনৃত্য, যখন অন্ধ্ররা অনুষ্ঠানে ভাংড়া পরিবেশন করবে ইত্যাদি। অন্যের সাংস্কৃতিক গ্রহণের এই ধরণটি সমস্ত রাজ্য এবং কেন্দ্রশাসিত অঞ্চলগুলি অনুসরণ করবে। কিলি-নিমার প্রশংসা করে এই লক্ষ্যকে বিশ্বব্যাপী প্রসারিত করার চেষ্টা করেছেন প্রধানমন্ত্রী।
প্রয়োজনীয়তা: ভারত একটি অনন্য জাতি, যার বুনন বিভিন্ন ভাষাগত, সাংস্কৃতিক এবং ধর্মীয় সুতো দ্বারা বোনা হয়েছে, সাংস্কৃতিক বিবর্তনের একটি সমৃদ্ধ ইতিহাস দ্বারা একটি যৌগিক জাতীয় পরিচয়ে একত্রিত হয়েছে দেশ। ভারতে ইতিহাস দেখলে বোঝা যাবে পারস্পরিক বোঝাপড়ার চেতনা বৈচিত্র্যের মধ্যে একটি বিশেষ ঐক্য রয়েছে, যা জাতিসত্তার একটি দীর্ঘ শিখা হিসাবে দাঁড়িয়ে আছে, যা ভবিষ্যতের জন্য পুষ্ট ও লালন করা দরকার। পারস্পরিক বোঝাপড়া এবং বিশ্বাস ভারতের শক্তির ভিত্তি এবং সমস্ত নাগরিকদের ভারতের সমস্ত কোণে সাংস্কৃতিকভাবে সংহত বোধ করা উচিত। উদাহরণ স্বরূপ, উত্তর-পূর্বের ছাত্রদের দিল্লিতে পৌঁছানোর সময় 'অচেনা দেশে অপরিচিত' মনে করা উচিত নয়, বা উত্তরাখণ্ডের কোনও ব্যক্তির কেরলে বহিরাগতের মতো অনুভব করা উচিত নয়। সেই দিকটিই এবার কিলি-নিমার লিপ সিঙ্কের মধ্যে দিয়ে বিদেশের গণ্ডিতেও ধরা দিয়েছে।