ব্রহ্মস মিসাইল কী?
ব্রহ্মস হল একটি স্বল্প-পাল্লার, সুপারসনিক অ্যান্টি-শিপ/ল্যান্ড অ্যাটাক ক্রুজ মিসাইল (Supersonic Anti-Ship/Land Attack Cruise Missile)। ১৯৯৮ সালে রাশিয়ার এনপিও মাশিনোস্ট্রোয়েনিয়া (NPO Mashinostroyeniya) এবং ভারতের প্রতিরক্ষা গবেষণা ও উন্নয়ন সংস্থা বা ডিআরডিও (Defence Research and Development Organisation)-র মধ্যে একটি যৌথ উদ্যোগে নির্মিত হয় এই মিসাইল। ব্রহ্মস হল বিশ্বের সেরা সুপারসনিক ক্রুজ মিসাইল, যার নামকরণ করা হয়েছে ভারতের ব্রহ্মপুত্র এবং রাশিয়ার মস্কভা নদীর নামে। শব্দের তুলনায় প্রায় ৩ গুণ দ্রুত গতিতে ছুটে যাওয়া এই মিসাইলটি শুধুমাত্র বিশ্বের দ্রুততম সুপারসনিক ক্রুজ মিসাইলই নয়, এর উচ্চ গতির কারণে এটিকে রাডারও ধরতে অক্ষম।
advertisement
ব্রহ্মস পরিচিত তার সুপারসনিক গতির (Supersonic Speed) জন্য। এই মিসাইল শব্দের চেয়ে প্রায় ৩ গুণ গতিতে ছোটে। যার ফলে এটিকে আটকানো কঠিন হয়ে দাঁড়ায়। এ ছাড়াও এই মিসাইল বৃহত্তর স্ট্রাইক পাওয়ারও দেয়। নির্মাতারা বলছে যে, এক সেকেন্ডে প্রায় এক কিলোমিটার গতিতে ছুটতে পারে ব্রহ্মস। সুপারসনিক গতি এবং ওয়ারহেড ভর– এই দুইয়ের মিশেলে ব্রহ্মসকে উচ্চ গতিশক্তি প্রদান করে, যা প্রাণঘাতী প্রভাব নিশ্চিত করে। ব্রহ্মস হল বিশ্বের একমাত্র পরিচিত বহুমুখী সুপারসনিক ক্রুজ মিসাইল, যা পরিষেবাতে রয়েছে। ব্রহ্মসকে স্টিলথ প্রযুক্তিতেও (Stealth Technology) সজ্জিত বলে বলা হয়। যা এটিকে রাডার এবং অন্যান্য ডিটেনশন সিস্টেমে কম দৃশ্যমান করে। ব্রহ্মসের একটি হাইপারসনিক সংস্করণ ব্রাহ্মস ২ তৈরি করা হচ্ছে, যা শব্দের চেয়ে ৫ গুণ গতিতে আঘাত হানতে সক্ষম হবে।
আরও পড়ুন: দিন কয়েক ধরে অসুস্থ ছিলেন, টেস্ট রিপোর্ট এল ডিআইজি সিবিআই-এর! আর জানা গেল...
ব্রহ্মসের কয়টি সংস্করণ আছে?
ব্রহ্মস একটি সর্বজনীন দূরপাল্লার সুপারসনিক ক্রুজ মিসাইল সিস্টেম, যা স্থল, সমুদ্র এবং আকাশ থেকে উৎক্ষেপণ করা যায়। এর জাহাজ-বিরোধী, স্থল-আক্রমণ এবং বিমান সংস্করণগুলি ইতিমধ্যেই ভারতীয় নৌবাহিনী, সেনা এবং বিমান বাহিনীতে অন্তর্ভুক্ত রয়েছে। ২০১৩ সালে সাবমেরিন সংস্করণ পরীক্ষা করা হয়েছিল। অর্থাৎ এই মিসাইলটি ভূমি, জাহাজ, সাবমেরিন এবং বিমান থেকে উৎক্ষেপণ করা যেতে পারে। ভ্যারিয়েন্ট এবং লঞ্চ প্ল্যাটফর্মের উপর নির্ভর করে ব্রহ্মসের পাল্লা ৩০০-৫০০ কিমি। ২০০-৩০০ কেজি ওজন বহনে সক্ষম এটি। তবে সংস্করণের ভিত্তিতে মিসাইলের ওজন নেওয়ার ক্ষমতা ২,২০০ থেকে ৩,০০০ কেজির মধ্যে হতে পারে। ব্রহ্মসের রফতানি সংস্করণের পাল্লা হবে ২৯০ কিলোমিটার। যা মিসাইল টেকনোলজি কন্ট্রোল রেজিম-এর (Missile Technology Control Regime) দ্বারা আরোপিত ৩০০ কিলোমিটার পাল্লার অধীনেই।
ফিলিপিন্স ব্রহ্মস ক্রুজ মিসাইল সিস্টেমের প্রথম বিদেশি ক্রেতা হতে চলেছে। উপকূল-ভিত্তিক জাহাজ-বিরোধী অত্যাধুনিক অস্ত্র ব্যবস্থা (Shore-Based Anti-Ship Missile System) অধিগ্রহণের জন্য প্রাথমিক ভাবে ২.৮ বিলিয়ন পেসো (৫৫.৫ মিলিয়ন মার্কিন ডলার) বরাদ্দও করেছে দেশটি। রিপোর্টে প্রকাশিত তথ্য অনুযায়ী, ফিলিপিন্স ব্রহ্মস সুপারসনিক ক্রুজ মিসাইল কেনার জন্য ছাড়পত্র দিয়ে দিয়েছে। আগামী সপ্তাহেই দুই দেশের মধ্যে চুক্তি স্বাক্ষরিত হতে পারে। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে যে, থাইল্যান্ড, ইন্দোনেশিয়া, ভিয়েতনাম-সহ দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার আরও বেশ কয়েকটি দেশ ব্রহ্মস মিসাইল কিনতে আগ্রহ দেখিয়েছে। এ ছাড়াও, সংযুক্ত আরব আমিরশাহি, সৌদি আরব, আর্জেন্টিনা, ব্রাজিল এবং দক্ষিণ আফ্রিকাও সম্ভাব্য ক্রেতাদের তালিকায় রয়েছে বলে সূত্রের খবর।
ব্রহ্মসের একটি হাইপারসনিক সংস্করণ ব্রহ্মস ২ তৈরি করা হচ্ছে, যা শব্দের চেয়ে ৫ গুণ গতিতে আঘাত করতে সক্ষম হবে। ভারতের প্রতিরক্ষা মন্ত্রক সম্প্রতি বলেছে যে, ব্রহ্মস অ্যারোস্পেস (BrahMos Aerospace) 'পরবর্তী প্রজন্মের' জন্য ব্রহ্মস-এনজি (BrahMos-NG)-র কাজ শুরু করেছে, যা আরও উন্নত রূপ। আগেরগুলির তুলনায় এটি হবে ছোট, হালকা, যাতে এটি বিভিন্ন আধুনিক সামরিক প্ল্যাটফর্মে ইনস্টল করা যায়। হায়দ্রাবাদের ব্রহ্মস ইন্টিগ্রেশন কমপ্লেক্সে (BrahMos Integration Complex) এই মিসাইলের সাব-সিস্টেমগুলির পরীক্ষা করে যুক্ত করা হয় এবং এখানেই মিসাইলের যান্ত্রিক ও ইলেকট্রনিক সিস্টেমগুলি একত্রিত করা হয়। ভারত ও রাশিয়ার অন্যান্য কেন্দ্রে এই মিসাইলের বিভিন্ন অংশ তৈরি হয়।
২০২১ সালের ডিসেম্বরে উত্তরপ্রদেশের লখনউয়ে ব্রহ্মস মিসাইল উৎপাদন ইউনিটের (BrahMos Manufacturing Centre) ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন প্রতিরক্ষা মন্ত্রী রাজনাথ সিং (Defence Minister Rajnath Singh)। এই ইউনিটে ব্রহ্মস-এনজি (BRAHMOS-NG) (পরবর্তী প্রজন্ম) মিসাইল তৈরি হবে। নতুন ইউনিটটি আগামী দুই থেকে তিন বছরের মধ্যে তৈরি হয়ে যাবে। প্রতি বছর গড়ে ৮০-১০০টি ব্রহ্মস-এনজি মিসাইলের উৎপাদন শুরু করবে।
আরও পড়ুন - রাজনীতিতে এনেছিলেন পার্থ, ওঁর সম্পর্কে কটু মন্তব্য নয়, স্পষ্ট করলেন মদন
সর্বশেষ পরীক্ষা কেন গুরুত্বপূর্ণ?
ব্রহ্মস মিসাইলের একটি জাহাজ-বিরোধী সংস্করণ ২০২০ সালের ডিসেম্বরে পরীক্ষা করা হয়। ভারতীয় নৌবাহিনীর একটি বাতিল জাহাজের বিরুদ্ধে এই পরীক্ষা করা হয়েছিল। প্রতিরক্ষা মন্ত্রী রাজনাথ সিং সর্বশেষ পরীক্ষার পরে টুইটে বলেছিলেন, "আইএনএস বিশাখাপত্তনম থেকে ব্রহ্মস মিসাইলের উন্নত সংস্করণের সফল উৎক্ষেপণের পরে নৌবাহিনীর মিশন প্রস্তুতি আজ নিশ্চিত করা হয়েছে।" ডিআরডিও জানিয়েছিল, "আইএনএস বিশাখাপত্তনম থেকে সমুদ্র থেকে সমুদ্রে আঘাত হানতে সক্ষম ব্রহ্মস সুপারসনিক ক্রুজ মিসাইলের পরীক্ষামূলক উৎক্ষেপণ করা হয়েছে। এই মিসাইল সফল ভাবে লক্ষ্যে আঘাত করেছে।" সমুদ্র থেকে সমুদ্রে আঘাত হানতে সক্ষম ব্রহ্মস সুপারসনিক ক্রুজ মিসাইল সর্বোচ্চ যে দূরত্ব পর্যন্ত যেতে পারে, সেটাই পরীক্ষা করা হয়েছে।
গত বছরের জুলাই মাসে ও ডিসেম্বর মাসে সুখোই ৩০ এমকেআই (Sukhoi 30 MK-I) ফাইটার জেট থেকে ব্রহ্মস মিসাইলের বায়ু সংস্করণের পরীক্ষা করা হয়। মিশনের সমস্ত উদ্দেশ্য পূরণ করে লক্ষ্যে আঘাত হেনেছিল মিসাইল। প্রতিরক্ষা মন্ত্রক (Defence Ministry) জানিয়েছিল, ব্রহ্মস মিসাইলের এই লঞ্চ দেশের প্রতিরক্ষা গবেষণার ইতিহাসে একটি প্রধান মাইলফলক। এই পরীক্ষা ব্রহ্মস মিসাইলের ধারাবাহিক উৎপাদনের রাস্তা খুলে দেবে।