এই জায়গায় এসে দাবি ছিল, কমানো হোক দুই টিকার মধ্যবর্তী ব্যবধান। স্বাস্থ্যমন্ত্রীর কাছে করোনার ভ্যাকসিন কোভিশিল্ড (Covishield) প্রস্তুতকারক সংস্থা সেরাম ইনস্টিটিউট (Serum Institute) এই আর্জি পেশ করেছিল। বিষয়টিকে ব্যবসায়িক দিক থেকে না দেখে স্বাস্থ্যগত খাতে বিচার করাই ভাল, কেন না বিধিনিষেধ শিথিল হতে চললেও ভাইরাস এখনও ঘুরে বেড়াচ্ছে বাতাসে, দেশে সনাক্ত হয়েছে ভাইরাসের রিকম্বিন্যান্ট স্ট্রেইনও। জানা গিয়েছে, কোভিশিল্ডের দ্বিতীয় এবং বুস্টার বা প্রিকশান ডোজের মধ্যেকার ব্যবধান ৯ মাস থেকে কমিয়ে ৩ মাস করার কথা কেন্দ্রকে জানিয়েছে সেরাম। কেন্দ্রীয় স্বাস্থ্যমন্ত্রী মনসুখ মাণ্ডব্যকে (Mansukh Mandaviya) এবিষয়ে ইতিমধ্যেই চিঠি দিয়ে জানিয়েছে পুণের টিকা প্রস্তুতকারক সংস্থা।
advertisement
সূত্রের খবর, সংস্থার ডিরেক্টর (Government and Regulatory Affairs) প্রকাশ কুমার সিং (Prakash Kumar Singh) চিঠিতে ১৮ উর্ধ্বদের জন্য দ্বিতীয় ও তৃতীয় টিকার ডোজের মাঝে গ্যাপ ৯ মাস থেকে কমিয়ে ৩ থেকে ৬ মাস করার পরামর্শ দিয়েছেন। Serum Institute-এর কর্তার মতে, দ্বিতীয় ডোজের ৬ মাসের মধ্যে টিকার পরবর্তী ডোজ নেওয়া হলে ভাইরাস নিয়ন্ত্রণে সুফল মিলেছে। বিভিন্ন দেশে এই নিয়ম অনুসরণ করে খুব ভাল ফল মিলেছে বলে দাবি সেরাম কর্তার।
ভ্যাকসিনের কার্যকারিতা নিশ্চিত করার জন্য শুধুমাত্র COVID-19 ভ্যাকসিনের স্ট্যান্ডার্ড ডোজ নেওয়ার পরামর্শ দেওয়া হয় না। ডোজগুলির মধ্যে প্রয়োজনীয় বিরতির দিকেও সাধারণ মানুষকে মনোযোগ দিতে হবে। এক-একটি প্রতিষেধকের মধ্যে বিশেষ কয়েক দিনের ব্যবধান থাকতে হবে। বেশিরভাগ অনুমোদিত করোনাভাইরাস ভ্যাকসিন দুটি ডোজে সাধারণ মানুষকে দেওয়া হয়। দুটি প্রতিষেধক গ্রহণের মধ্যে নির্দিষ্ট সময়ের ব্যবধান থাকা জরুরি বলে মনে করেন চিকিৎসকরা।
ওমিক্রন (Omicron) আতঙ্কের মধ্যেই ১০ জানুয়ারি থেকে দেশে প্রথম সারির করোনা-যোদ্ধাদের বুস্টার ডোজ দেওয়া শুরু হয়েছে। এছাড়াও ষাটোর্ধ্ব প্রবীণ, যাঁদের কো-মর্বিডিটি রয়েছে তাঁরাও পাচ্ছেন সতর্কতামূলক ডোজ। কিন্তু, করোনা টিকার দু'টি ডোজ নেওয়ার পরেও যদি কেউ করোনায় আক্রান্ত হন, সেক্ষেত্রে তাঁর কোভিড রিপোর্ট নেগেটিভ আসার কতদিন পর সতর্কতামূলক বুস্টার ডোজ নিতে পারবেন এই প্রশ্ন উঠছিল। করোনার দু’টি ডোজ নেওয়ার কতদিনের মধ্যে নেওয়া যাবে বুস্টার ডোজ? এই নিয়ে আগেই নির্দেশিকা জারি করেছিল কেন্দ্র। যেখানে বলা হয়, দু’টি টিকা নেওয়ার ৩৯ সপ্তাহ অর্থাৎ নয় মাস পরে করোনা টিকার তৃতীয় ডোজ নেওয়া সম্ভব হবে। অন্য দিকে, ৩ জানুয়ারি থেকে দেশে ১৫ থেকে ১৮ বছর বয়সীদের জন্য শুরু হয়েছে টিকাকরণ। তাঁদের জন্যও এই তিন মাস নিয়ম বহাল থাকবে বলে জানা গিয়েছে।
দুটি প্রতিষেধকের মাঝে নির্দিষ্ট ব্যবধানের প্রয়োজন কেন, ভ্যাকসিনের ডোজগুলির মধ্যে ব্যবধান বজায় রাখা কেন গুরুত্বপূর্ণ?
চিকিৎসদের মতে, প্রথম ডোজ দেওয়ার পরে অ্যান্টিবডি তৈরি হতে প্রায় দুই থেকে তিন সপ্তাহ সময় লাগে। প্রথম কোভিডের প্রতিষেধক তখন সার্স কোভিড (SARs-COV-2) ভাইরাসের বিরুদ্ধে শক্তিশালী ইমিউন বা প্রতিরোধ প্রক্রিয়া তৈরি করতে সাহায্য করে। সাম্প্রতিক কিছু গবেষণা বলছে, SARS-CoV2 ভাইরাসের অতি-সংক্রমণযোগ্য স্ট্রেন প্রতিরোধ করতে ভ্যাকসিনের বুস্টার ডোজ প্রয়োজন হতে পারে। দ্বিতীয় ডোজটির জন্য সেই কারণে কিছুটা সময় দিতেই হবে। দ্বিতীয় ডোজের পর শরীরের প্রতিরোধ ক্ষমতা বেড়ে যায় এবং তা পেশিগুলিকে শক্তিশালী করে। অতএব যারাঁ কোভিড ভ্যাকসিনের দুটি ডোজ পান তাদের টিকাকরণ সম্পূর্ণ এবং সুরক্ষিত বলে মনে করা হয়।
এদেশে কোভিডের দুটি ভ্যাকসিন প্রদানের মাঝে নির্দিষ্ট সময়ের ব্যবধান কি থাকছে?
বর্তমানে ভারত বায়োটেকের কোভ্যাক্সিন (Covaxin), সিরাম ইনস্টিটিউট অফ কোভিশিল্ড এবং রাশিয়ার তৈরি স্পুটনিক ভি (Sputnik V) ব্যবহার করছে।
কোভ্যাক্সিন চার থেকে ছয় সপ্তাহের ব্যবধানে দুটি মাত্রায় দেওয়া হয়। কোভিশিল্ড ১২-১৬ সপ্তাহের দীর্ঘ ব্যবধানে দেওয়া হয়। সাম্প্রতিক খবরে প্রকাশ ন্যাশনাল টেকনিক্যাল অ্যাডভাইজরি গ্রুপ অন ইমিউনাইজেশন (NTAGI) একটি সূত্র অনুসারে জানিয়েছে কোভিশিল্ডের প্রথম এবং দ্বিতীয় ডোজের মধ্যে ব্যবধান কমিয়ে ৮ থেকে ১৬ সপ্তাহ করার সুপারিশ করেছে। আইএএনএস এই রিপোর্ট করেছে।
যতদূর জানা যায় স্পুটনিক ভি-এর জন্য উদ্বিগ্ন অনেকেই। একক ডোজ ভ্যাকসিন পাওয়া যায় স্পুটনিক ভি-এর। বিশেষজ্ঞরা তিন সপ্তাহ বা ২১ দিনের ব্যবধানে ভ্যাকসিনের দুটি ডোজ নেওয়ার পরামর্শ দেন।
কত তাড়াতাড়ি এই ডোজ পেতে পারি আমরা?
৬০ বছরের বেশি বয়সী সকলেই এখন ভারতে সাবধানতার জন্য বুস্টার ডোজ পাওয়ার যোগ্য৷ সরকারি নির্দেশিকা অনুসারে এই সতর্কতা ডোজ শুধুমাত্র ৯ মাস পরে নেওয়া যেতে পারে। দ্বিতীয় ডোজ গ্রহণের তারিখ থেকে ৩৯ সপ্তাহের ব্যবধান আবশ্যক।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের mRNA ভ্যাকসিনের ডোজগুলির মধ্যে প্রস্তাবিত ব্যবধান কী?
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে এবং ইউরোপের কিছু অংশে ফাইজার (Pfizer BioNTech) এবং মডার্নার (Moderna) mRNA ভ্যাকসিনগুলি পুরোদমে দেওয়া হচ্ছে। সাম্প্রতিক কিছু গবেষণা বলছে, SARS-CoV2 ভাইরাসের অতি-সংক্রমণযোগ্য স্ট্রেন প্রতিরোধ করতে ভ্যাকসিনের বুস্টার ডোজ প্রয়োজন হতে পারে।
সেন্টার ফর ডিজিজ কন্ট্রোল অ্যান্ড প্রিভেনশন অনুসারে, পাঁচ বছর বা তার বেশি বয়সী সকল ব্যক্তিকে ২১ দিনের ব্যবধানে এই ডোজ দেওয়া হবে। এর আগে দ্বিতীয় ডোজ পাওয়ার জন্য ভ্যাকসিন প্রাপকদের সময়সূচী স্থির করবেন সংশ্লিষ্ট টিকা প্রদানকারী সংস্থা। এটি ফাইজার ভ্যাকসিনের সঙ্গে সম্পর্কিত।
মডার্নার জন্য মার্কিন স্বাস্থ্য সংস্থা জানিয়েছে, ১৮ বছর বা তার বেশি বয়সী সমস্ত লোককে ২৮ দিনের ব্যবধানে দ্বিতীয় ডোজ প্রাথমিক সিরিজে পাওয়া উচিত।
কখন কেউ ফাইজার এবং মডার্নার জন্য একটি বুস্টার ডোজ পেতে পারে?
যাঁরা ফাইজার ভ্যাকসিন পেয়েছেন তাঁদের জন্য বুস্টার ভ্যাকসিনগুলি মাঝারিভাবে বা গুরুতরভাবে ইমিউনোকম্প্রোমাইজড হিসেবে কাজ করে এবং যাঁদের বয়স ১২ বছর বা তার বেশি তাঁদের জন্য সুপারিশ করা হয় এই প্রতিষেধকটির। সিডিসি (CDC) অনুসারে দ্বিতীয় ডোজের প্রাথমিক সিরিজের ২৮ দিন পর টিকাকরণ স্বাভাবিক বলে মনে করছেন চিকিৎসকরা।
আরও পড়ুন- ভারতেও ডেল্টা-ওমিক্রনের সংমিশ্রিত স্ট্রেন? সংক্রমণের উপসর্গগুলি জানুন আগেই
যাঁরা মডার্না ভ্যাকসিনের দুটি ডোজ পেয়েছেন তাঁরাও দ্বিতীয় ডোজের প্রাথমিক সিরিজের কমপক্ষে আঠাশ দিন পরে তাদের অতিরিক্ত প্রাথমিক ডোজ পেতে পারেন। এই অভিমত প্রকাশ করেছে মার্কিন স্বাস্থ্য সংস্থা। এই প্রতিষেধকটি মাঝারিভাবে বা গুরুতরভাবে ইমিউনোকম্প্রোমাইজড এবং যাঁদের বয়স ১৮ বছর বা তার বেশি তাঁদের জন্যই প্রযোজ্য।
নোভোভ্যাক্স (Novovax) ভ্যাকসিন ডোজের ব্যবধানও একই রকম থাকা আবশ্যক বলে মনে করছেন চিকিৎসকরা। নোভোভ্যাক্স হল একটি প্রোটিন-ভিত্তিক ভ্যাকসিন। যেটি অস্ট্রেলিয়া ১৮ বছর বা তার বেশি বয়সের মানুষের জন্য ব্যবহারের অনুমতি দিয়েছে।
ওয়ার্ল্ড হেলথ অর্গানাইজেশন (WHO) জানিয়েছে, ইমিউনাইজেশনের বিশেষজ্ঞদের কৌশলগত উপদেষ্টা গ্রুপ (SAG) নোভোভ্যাক্স ভ্যাকসিনটি ইন্ট্রামাসকুলারভাবে দুটো ডোজ (০.৫ মিলি) হিসাবে ব্যবহার করার পরামর্শ দেয়। দুটি ডোজ তিন থেকে চার সপ্তাহের ব্যবধানে দেওয়া উচিত বলে জানিয়েছেন চিকিৎসকরা। চিন বাদ দিলে বিশ্ব জুড়ে দিনে গড়ে সবচেয়ে বেশি ডোজ টিকা দিচ্ছে মোদি সরকার। আপাতত দেশের টিকা পাওয়ার যোগ্য(বয়স ও অন্যান্য শর্তের ভিত্তিতে) জনসংখ্যার ১০০%-র টিকার প্রাপ্যতা নিশ্চিত করাই লক্ষ্য কেন্দ্রের। একবার তা হয়ে গেলে দেশের প্রত্যেকের করোনার বিরুদ্ধে লড়ার মূল ভিত্তি থাকবে। তার পরে প্রয়োজনমাফিক বুস্টার ডোজের আয়োজন করা যাবে।
চিনের সিনোভাক-করোনাভ্যাক (CoronaVac) ভ্যাকসিনের প্রথম, দ্বিতীয় এবং বুস্টার ডোজের মধ্যে প্রস্তাবিত ব্যবধান
করোনাভ্যাক ভ্যাকসিনটি বেইজিং-ভিত্তিক একটি কোম্পানি সিনোভাক দ্বারা তৈরি হয়েছে। এটি বিশ্বের সবচেয়ে বহুল ব্যবহৃত করোনাভাইরাস ভ্যাকসিন জানানো হয়েছে নেচার রিপোর্টে।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা জানিয়েছে SAGE সুপারিশ করে সিনোভাক-করোনাভ্যাক ভ্যাকসিনকে দুটো ডোজ হিসাবেই ব্যবহার করার জন্য। প্রথম এবং দ্বিতীয় ডোজের মধ্যে ২-৩ সপ্তাহের ব্যবধান থাকা আবশ্যক।
একই কোভিড ভ্যাকসিনের, ভ্যাকসিন বুস্টারের জন্য প্রাথমিক টিকা সিরিজ শেষ হওয়ার চার থেকে ছয় মাস অপেক্ষা করতে হবে।