আরও পড়ুন: করোনা সংক্রমণে এগিয়ে পুরুষরা, মহিলাদের রিপোর্ট নিয়ে চাঞ্চল্যকর তথ্য দিচ্ছে সমীক্ষা!
একটি মনোক্লোনাল অ্যান্টিবডি চিকিৎসা কী?
আমাদের শরীরের প্রাকৃতিক প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা রোগজীবাণুগুলির বিরুদ্ধে লড়াই করার জন্য অ্যান্টিবডি তৈরি করে। এই অ্যান্টিবডিগুলি প্রাকৃতিকভাবে একটি প্যাথোজেনের আক্রমণের প্রতিক্রিয়া হিসাবে শরীরের মধ্যে তৈরি হয় এবং কখনও কখনও মৃত প্যাথোজেন বা প্যাথোজেনের সক্রিয় অংশগুলি ইমিউন প্রতিক্রিয়াকে (Immune Response) প্ররোচিত করার জন্য টিকার মাধ্যমে শরীরে ছেড়ে দেওয়া হয়। মনোক্লোনাল অ্যান্টিবডিগুলি হল পরীক্ষাগারে তৈরি প্রোটিন যা করোনাভাইরাসের মতো ক্ষতিকারক রোগজীবাণুগুলির বিরুদ্ধে লড়াই করার জন্য ইমিউন সিস্টেমের (Immune System) ক্ষমতাকে অনুকরণ করে।
advertisement
বেবটেলোভিমাব ভাইরাসের স্পাইক প্রোটিনের সঙ্গে আবদ্ধ হয়ে কাজ করে। এটি ‘আরইজিইএন-কোভটু’ (REGEN-COV2) বা অন্যান্য মনোক্লোনাল অ্যান্টিবডির মতো, যেগুলি মৃদু থেকে মাঝারি সংক্রমিত উচ্চ-ঝুঁকির রোগীদের চিকিৎসার জন্য ব্যবহৃত হয়। এটি হাসপাতালে ভর্তি বা মৃত্যুর ঝুঁকি কমাতে সাহায্য করে।
আরও পড়ুন: পৃথিবীতে জল এল কোথা থেকে? এবার চাঞ্চল্যকর দাবি বিজ্ঞানীদের
এটি কীভাবে কোভিডের ক্ষেত্রে কাজ করবে?
গবেষক এবং স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা করোনাভাইরাস (Coronavirus) দ্বারা সৃষ্ট কোভিড সংক্রমণের চিকিৎসার কার্যকর উপায় খুঁজে বের করার জন্য নিরলসভাবে কাজ করে চলেছেন। এই ধরনের একটি গবেষণার ফল হল মনোক্লোনাল অ্যান্টিবডির ব্যবহার করা। এটি অন্যান্য রোগের মতো একই ভাবে কাজ করে। পরীক্ষাগারে তৈরি অ্যান্টিবডি ভাইরাসের স্পাইক প্রোটিনের সঙ্গে আবদ্ধ হয়। ল্যাবরেটরির পরীক্ষায় দেখা গিয়েছে যে বেবটেলোভিমাব ওমিক্রন প্রজাতি (Omicron Variant) এবং ওমিক্রন সাবভ্যারিয়েন্ট (BA.2 Omicron Subvariant), উভয়ের বিরুদ্ধেই কার্যকর।
মনোক্লোনাল অ্যান্টিবডি কতটা কার্যকর?
হায়দরাবাদের এআইজি হাসপাতাল (AIG Hospitals) এবং এশিয়ান হেল্থকেয়ার ফাউন্ডেশনের (Asian Healthcare Foundation) দ্বারা পরিচালিত একটি গবেষণার ফলাফলে বলা হয়েছে, "মনোক্লোনাল থেরাপি ডেল্টা প্রজাতিতে আক্রান্ত উচ্চ-ঝুঁকিপূর্ণ ব্যক্তিদের গুরুতর রোগ এবং মৃত্যু ১০০ শতাংশ কমিয়ে দেয়।" ইউএস ফুড অ্যান্ড ড্রাগ অ্যাডমিনিস্ট্রেশন-র রিপোর্ট অনুযায়ী, ৩৮০ জন কম-ঝুঁকির কোভিড রোগীর ক্লিনিকাল ট্রায়ালের (Clinical Trial) ডেটা অনুসারে, বেবটেলোভিমাবের চিকিৎসার ৫ দিনে পরে ভাইরাল লোড (Viral Lode) কমে যায়। এছাড়াও দেখা গিয়েছিল যে ট্রায়ালের ২৯ তম দিনে হাসপাতালে ভর্তি এবং মৃত্যুর হার কম ছিল।
সীমাবদ্ধতা কী?
বেবটেলোভিমাবের সম্ভাব্য পার্শ্বপ্রতিক্রিয়াগুলির মধ্যে রয়েছে চুলকানি, ফুসকুড়ি, বমি বমি ভাব এবং বমি। এফডিএ বলেছে যে অন্যান্য মনোক্লোনাল অ্যান্টিবডিগুলির অতিসংবেদনশীলতা, অ্যানাফিল্যাক্সিস সহ গুরুতর এবং অপ্রত্যাশিত পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া দেখা গিয়েছে এবং বেবটেলোভিমাবের ক্ষেত্রেও এটি দেখা দিতে পারে।
ভারতে COVID 19 এর মনোক্লোনাল অ্যান্টিবডি চিকিৎসা
‘আরইজিইএন-কোভটু’ (REGEN-COV2) মনোক্লোনাল অ্যান্টিবডি চিকিৎসা ভারতে হয়। সুইস ড্রাগ জায়ান্ট রোচে-র সহযোগিতায় এটি ভারতে এনেছে সিপলা। ২০২১ সালের অক্টোবরে মার্কিন ফুড অ্যান্ড ড্রাগ অ্যাডমিনিস্ট্রেশন পোস্ট-এক্সপোজার প্রফিল্যাক্সিস বা প্রতিরোধের জন্য ‘আরইজিইএন-কোভটু’ মনোক্লোনাল অ্যান্টিবডির জরুরি ব্যবহারের অনুমোদন দিয়েছিল। যদিও, ওমিক্রনের সংক্রমিত ব্যক্তিদের চিকিৎসার ক্ষেত্রে এই অ্যান্টিবডি থেরাপির কার্যকারিতা প্রশ্নের মুখে পড়েছে।
ভাইরোলজিস্ট গগনদীপ কাং (Gagandeep Kang) মনোক্লোনাল অ্যান্টিবডি চিকিৎসা নেওয়ার পরামর্শ দেওয়াকে অনৈতিক এবং অবৈজ্ঞানিক বলে অভিহিত করেছেন। তিনি বলেন, "দয়া করে মনে রাখবেন যে বেশিরভাগ কোভিড সংক্রমিত উপসর্গহীন বা হালকা উপসর্গযুক্ত এবং তারা এমনিই সেরে উঠবে। খুব অল্প সংখ্যক গুরুতর অসুস্থ হবে। তারাও এমনিই ভাল হয়ে যাবে। কিন্তু অ্যান্টিবডি দেওয়ার পরে চিকিৎসকরা এটিকেই দায়ী করবেন। ভারতে লাইসেন্সপ্রাপ্ত মনোক্লোনাল অ্যান্টিবডিগুলি ওমিক্রনকে কাবু করতে পারে না। তবুও বেসরকারি হাসপাতালের ডাক্তাররা মনোক্লোনাল অ্যান্টিবডি থেরাপির পরামর্শ দিচ্ছেন।"
গগনদীপ ভারতে মনোক্লোনাল চিকিৎসার প্রাপ্যতা এবং প্রয়োজনীয়তা নিয়েও কথা বলেছেন। তিনি বলেন, "আমি ডাক্তারদের (সংক্রামক রোগ বিশেষজ্ঞদের নয়) থেকে যে যুক্তিটি শুনি তা হল যে এটির দাম মাত্র এক লাখ এবং আমার রোগীর এটি কেনার সামর্থ্য রয়েছে, তাহলে কেন নয়? কেন নয়? এটি অনৈতিক এবং অবৈজ্ঞানিক। অবশ্যই, ডাক্তার হিসাবে আমরা এর চেয়ে ভাল ওষুধ ব্যবহার করতে পারি। রোগী হিসাবে, অনুগ্রহ করে জিজ্ঞাসা করুন প্রতিটি ওষুধের জন্য কী কার্যকারিতা আশা করা হচ্ছে এবং ওই কার্যকারিতার প্রমাণ কোথায় রয়েছে।"
ইন্ডিয়ান কাউন্সিল অফ মেডিক্যাল রিসার্চের (ICMR) জারি করা সাম্প্রতিক নির্দেশিকাতেও কোভিডের চিকিৎসায় মনোক্লোনাল অ্যান্টিবডি ব্যবহারের সুপারিশ করা হয়নি।
মনোক্লোনাল অ্যান্টিবডি চিকিৎসা কি টিকা দেওয়ার বিকল্প হতে পারে?
না। এফডিএ জানিয়েছে, "বেবটেলোভিমাব এমন ব্যক্তিদের জন্য টিকা দেওয়ার বিকল্প নয়, যাদের জন্য টিকা এবং বুস্টার ডোজ সুপারিশ করা হয়।"
কোভিড ছাড়া এর থেরাপিউটিক ব্যবহারগুলি কী কী?
মনোক্লোনাল অ্যান্টিবডিগুলির বেশ কয়েকটি থেরাপিউটিক ব্যবহার রয়েছে। যেমন- ক্যানসারের চিকিৎসা, অটোইমিউন রোগ, রিউমাটয়েড আর্থ্রাইটিস, ক্রোনস ডিজিজ, আলসারেটিভ কোলাইটিস, বি সেল লিউকেমিয়া, হেপাটাইটিস সি এবং অন্যান্য।
কয়েকমাস আগেই কোভিডের চিকিৎসায় ব্যারিসিটিনিব (Baricitinib) ও সোট্রোভিমাব (Sotrovimab) নামের দুটি ওষুধের নাম সুপারিশ করেছিল বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (WHO)। বয়স্ক এবং কোমর্বিডিটিযুক্ত (Comorbidity) ব্যক্তিদের ক্ষেত্রে এই দু’টি পদ্ধতি ব্যবহারে প্রাণের ঝুঁকি কমাবে বলে জানিয়েছেন হু-র বিশেষজ্ঞেরা।
ব্যারিসিটিনিব কী?
শুক্রবার এক বিবৃতিতে সংস্থাটি জানিয়েছে, কোভিডে আক্রান্ত গুরুতর রোগীদের ক্ষেত্রে ব্যারিসিটিনিব ওষুধটি ব্যবহার করা যাবে। ডব্লিউএইচওর বিশেষজ্ঞরা বলছেন যে এটি জানুস কিনেস (Janus kinase) ইনহিবিটর শ্রেণির ওষুধ। যা মুখ দিয়ে খেতে হয়। তারা বলছেন, ব্যারিসিটিনিব মূলত রিউমাটয়েড আর্থ্রাইটিসের চিকিৎসায় ব্যবহৃত হয়ে থাকে। এ ওষুধ সেবনে গুরুতর কোভিড রোগীদের হাসপাতালে ভর্তি (Hospitalization), ভেন্টিলেশনের ঝুঁকি ও মৃত্যুর ঝুঁকি অনেকটাই কমে যায়।
এর আগে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা কোভিডের চিকিৎসার জন্য আইএল ৬ (IL-6) বা ইন্টারলিউকিন ৬ (Interleukin 6) ইনহিবিটর বলে একটি ওষুধ অনুমোদন করে। এটিও আর্থ্রাইটিসের চিকিৎসায় ব্যবহৃত হয়ে থাকে। এই ইনহিবিটর সাইটোকাইন স্টর্ম (Cytokine Storm) নামে পরিচিত ইমিউন সিস্টেমের (Immune System) অত্যধিক প্রতিক্রিয়া মোকাবিলায় সহায়তা করে। যা গুরুতরভাবে অসুস্থ কোভিড রোগীদের মারাত্মক পরিণতি ঘটাতে পারে।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার গাইডলাইন ডেভেলপমেন্ট গ্রুপ (GDG) বলেছে যে কর্টিকোস্টেরয়েডের সংমিশ্রণে ইন্টারলিউকিন-৬ (IL-6) রিসেপ্টর ব্লকারের বিকল্প হিসাবে ব্যারিসিটিনিব ব্যবহারের জন্য তারা জোরালো সুপারিশ করছে গুরুতর কোভিড রোগীদের চিকিৎসার ক্ষেত্রে। কর্টিকোস্টেরয়েড সস্তা এবং ব্যাপকভাবে উপলব্ধ ওষুধ। এটি সাধারণত কোভিডের গুরুতর ক্ষেত্রে ইমিউন সিস্টেমের অতিরিক্ত প্রতিক্রিয়ার কারণে সৃষ্ট প্রদাহের বিরুদ্ধে লড়াই করতে কার্যকর। এর আগে দু'টি আইএল-৬ (IL-6) ইনহিবিটর আর্থ্রাইটিসের ওষুধ টোসিলিজুমাব এবং সারিলুম্যাব কোভিডের চিকিৎসার জন্য বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা সুপারিশ করেছিল।
বারিসিটিনিব কি ভারতে পাওয়া যায়?
এই ওষুধের জেনেরিক সংস্করণগুলি ভারত ও বাংলাদেশে ইতিমধ্যেই পাওয়া যাচ্ছে। ওষুধটি মার্কিন ফার্মা জয়ান্ট এলি লিলির (Eli Lilly) তৈরি হলেও বাংলাদেশ ও ভারতে কম দামেই পাওয়া যায়। তবে, বিশ্বের অনেক দেশেই জেনেরিক ব্যারিসিটিনিব পাওয়া যাবে না। যেহেতু ওষুধটির পেটেন্ট একটি মাত্র সংস্থার কাছে রয়েছে, তাও আবার ২০২৯ সাল পর্যন্ত। পরবর্তীকালে এই মেয়াদ আরও বাড়তে পারে।
সোট্রোভিমাব কী?
সোট্রোভিমাব (Sotrovimab) হল ক্যাসিরিভিমাব-ইমদেভিমাব (Casirivimab-Imdevimab)-র একটি বিকল্প, গত বছরের সেপ্টেম্বরে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার সুপারিশকৃত একটি মনোক্লোনাল অ্যান্টিবডি ককটেল (Monoclonal Antibody Cocktail)। ওষুধটি বীর বায়োটেকনোলজির (Vir Biotechnology) সহযোগিতায় ব্রিটিশ ফার্মা জায়ান্ট জিএসকে (GSK) তৈরি করেছে। ইউরোপের দেশগুলিতে ব্যবহারের জন্য এটি জরুরি ছাড়পত্রও পেয়েছে। তবে কোভিডের নতুন প্রজাতি ওমিক্রনের বিরুদ্ধে মনোক্লোনাল অ্যান্টিবডিগুলির কার্যকারিতা নিয়ে গবেষণা চলছে। প্রাথমিক গবেষণায় দেখা গিয়েছে যে সোট্রোভিমাব তার কার্যকারিতা ধরে রেখেছে। যেসব করোনা রোগীর অবস্থা গুরুতর নয়, কিন্তু হাসপাতালে ভর্তির উচ্চ ঝুঁকি রয়েছে, তাদের ক্ষেত্রে ওষুধটি ব্যবহারের পরামর্শ দেওয়া হয়েছে। ডায়াবেটিস বা ইমিউনোডেফিসিয়েন্সির মতো রোগী দীর্ঘ দিন ভোগা করোনা রোগীদের ক্ষেত্রে এই পদ্ধতি কার্যকর হতে পারে বলে মনে করছে হু। এর প্রস্তুতকারক গ্লাক্সো স্মিথ ক্লাইন।
ডব্লিউএইচও বলেছে যে গুরুতর নয় এমন কোভিড রোগীদের ক্ষেত্রে এই ওষুধ ব্যবহারের সুপারিশ করা হয়েছে, যাদের হাসপাতালে ভর্তির সর্বোচ্চ ঝুঁকি রয়েছে। আর যাদের হাসপাতালে ভর্তির আশঙ্কা নেই তাদের সোট্রোভিমাব ব্যবহারের প্রয়োজন নেই। কারণ, গবেষণায় কম ঝুঁকির মধ্যে থাকা রোগীদের ক্ষেত্রে এই ওষুধ কম কার্যকারিতা দেখিয়েছে। এছাড়াও ব্রিটেনে মৃদু থেকে মাঝারি-সহ ১২ বছরের বেশি বয়সি গুরুতর রোগীদের জন্য অনুমোদিত সোট্রোভিমাব।
সোট্রোভিমাব কি ভারতে পাওয়া যায়?
২০২১ সালের ডিসেম্বরের শেষে একটি প্রতিবেদনে বলা হয়েছিল যে সোট্রোভিমাব কখন ভারতে পাওয়া যাবে তা স্পষ্ট নয়। কারণ এর নির্মাতারা এখনও দেশের স্বাস্থ্য নিয়ন্ত্রকদের কাছে জরুরি ব্যবহারের অনুমোদনের জন্য আবেদন করেনি। এর আগে মার্কের তৈরি করোনার ওষুধ মলনুপিরাভির গত বছরের ডিসেম্বরে ভারতে জরুরি পরিস্থিতিতে সীমাবদ্ধ ব্যবহারের জন্য অনুমোদন পেয়েছিল। কিন্তু কোভিড বিষয়ক ন্যাশনাল টাস্ক ফোর্স (National Task Force) এই ওষুধকে ক্লিনিকাল ম্যানেজমেন্ট প্রোটোকলে অন্তর্ভুক্ত করেনি। কারণ হিসেবে জানা গিয়েছে যে এই ওরাল চিকিৎসা কোভিডের ক্ষেত্রে খুব বেশি কার্যকর হচ্ছে না। তবে, নয়া নির্দেশিকায় গুরুতর অসুস্থদের ক্ষেত্রে রেমডেসিভির ব্যবহারে ছাড়পত্র দেওয়া হয়েছে। উপসর্গ দেখা দেওয়ার ১০ দিনের মধ্যে রেমডেসিভির প্রয়োগ করা যেতে পারে জানাচ্ছে ওই নির্দেশিকা।