ডেইলি মেইল রিপোর্টে জানানো হয়েছে, সুপার-মিউট্যান্ট ডেল্টাক্রন এমন একজন রোগীর মধ্যে বিবর্তিত হয়েছিল বলে মনে করা হয়, যিনি একই সময়ে দুটি প্রজাতিতে সংক্রমিত হন। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, একজন ব্যক্তির করোনাভাইরাসের (Coronavirus) দুই প্রজাতিতে আক্রান্ত হওয়া বিরল হলেও অসম্ভব নয়। তবে ডেল্টাক্রন অন্য কোথাও থেকে ব্রিটেনে (UK) এসেছিল না কি উদ্ভূত হয়েছিল তা স্পষ্ট নয়। ব্রিটেনের স্বাস্থ্য নিরাপত্তা সংস্থার (UK Health Security Agency) কর্তারাও জানেন না যে নতুন উদ্ভূত প্রজাতিটি কতটা সংক্রামক বা এটি টিকার কার্যকারিতাকে প্রভাবিত করবে কি না।
advertisement
আরও পড়ুন: রাষ্ট্রপতির দৃষ্টিতে নৌ-মহড়ার ইতিহাসের তাৎপর্য এবং ১২তম সংস্করণের প্রত্যাশা!
ডেল্টাক্রন কী?
আগে ডেল্টাক্রনকে পরীক্ষাগারের ত্রুটি (Lab Contamination) বলে মনে করা হয়েছিল। ডেল্টাক্রনের উত্থান সম্পর্কে প্রতিবেদন ভাইরাল হতেই বেশ কয়েকজন বিজ্ঞানী এবং স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ এই দাবি উড়িয়ে দিয়েছিলেন। তাঁদের দাবি, ডেলমিক্রনের আবিষ্কার সম্ভবত ল্যাব দূষণের ফল। ইম্পেরিয়াল কলেজ লন্ডনের ভাইরোলজিস্ট টম পিকক ট্যুইটারে লিখেছিলেন যে বড় বড় সংবাদমাধ্যমের রিপোর্ট করা ডেল্টাক্রন বেশ স্পষ্টভাবে দূষিত বলে মনে হচ্ছে। কারণ, নতুন প্রজাতির উত্থান সম্পর্কে যে যে যুক্তি দরকার, তা মোটেই এখানে খাটছে না। আরেকজন সংক্রামক রোগ বিশেষজ্ঞ ও বিশ্ব স্বাস্থ সংস্থার টেকনিক্যাল টিমের সদস্য কৃতিকা কুপ্পাল্লি ডেল্টাক্রনের উত্থানের দাবিকে খারিজ করেছিলেন। তিনি জোরের সঙ্গে জানিয়েছিলেন যে ডেলমিক্রন কোনও নতুন প্রজাতি নয়। এটি সম্ভবত ল্যাব দূষণের কারণে সৃষ্টি হয়েছে।
তবে, গত কয়েকদিন আগে ব্রিটেনে ডেল্টাক্রনে সংক্রমিত ব্যক্তির খোঁজ পাওয়া গিয়েছে বলে দাবি করা হয় একটি আন্তর্জাতিক মিডিয়ার প্রতিবেদনে। তাতে বলা হয়, গবেষণাগারে নমুনা পরীক্ষা করতে গিয়ে এই প্রজাতির হদিস মিলেছে। ২০২২ সালের জানুয়ারিতে সাইপ্রাসে ডেল্টাক্রনের প্রথম কেস রিপোর্ট করা হয়েছিল। যদিও বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (WHO) এটিকে ল্যাব দূষণ বলেছিল। অনেক বিশেষজ্ঞ এও বলেছিলেন যে এটি জিনোমের সিকোয়েন্সিং আর্টিফ্যাক্ট দূষণের ফলে সৃষ্টি হতে পারে।
আরও পড়ুন: মনোক্লোনাল অ্যান্টিবডি চিকিৎসা কী? কোভিডের বিরুদ্ধে এটা কতটা কার্যকর? পড়ুন
ডেল্টাক্রন সংক্রমণের উপসর্গগুলি কী কী?
এখনও পর্যন্ত এই প্রজাতির উপসর্গ সম্পর্কে কিছুই জানা যায়নি। ব্রিটেনে রিপোর্ট করার আগে সাইপ্রাসে (Cyprus) ডেল্টাক্রনের ২৫টি সংক্রমণের হদিশ পাওয়া যায়। যার মধ্যে ১১ জনকে হাসপাতালে ভর্তি করাতে হয়েছিল এবং বাকিরা বাড়িতেই আইসোলেশনে ছিলেন।
সাইপ্রাস বিশ্ববিদ্যালয়ের জীবন বিজ্ঞানের অধ্যাপক লিওনডিওস কোস্ট্রিকিস এই প্রসঙ্গে এর আগে বলেছিলেন যে তাঁরা এমন একটি স্ট্রেন খুঁজে পেয়েছেন যার ওমিক্রনের মতো জেনেটিক বৈশিষ্ট রয়েছে। বর্তমানে ওমিক্রন এবং ডেল্টা সংক্রমণ ছড়াচ্ছে। নতুন স্ট্রেনটি এই দুইয়ের সংমিশ্রণ। নতুন এই স্ট্রেনের নাম ডেল্টাক্রন রাখা হয়েছে। একজন ব্যক্তির একই সময়ে দুটি ভিন্ন রোগে আক্রান্ত হওয়ার উদাহরণ রয়েছে। যেমন- মরসুমি ফ্লু এবং কোভিড।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, একজন ব্যক্তির করোনাভাইরাসের দুই প্রজাতিতে আক্রান্ত হওয়া বিরল হলেও অসম্ভব নয়।
কোস্ট্রিকিস বলেছিলেন যে তাঁর দল ২৫ জন কোভিড আক্রান্ত রোগীর নমুনায় ডেলমিক্রন প্রজাতি সনাক্ত করেছে। ২৫ জনের মধ্যে ১১ জন হাসপাতালে ভর্তি রয়েছেন। বাকি ১৪ জন বাড়িতে আইসোলেশনে রয়েছেন। তিনি উল্লেখ করেছেন যে এই প্রজাতিতে আরও সংক্রমণ সনাক্ত হতে পারে কি না বা মহামারীর গতিপথের উপর এটি কী প্রভাব ফেলতে পারে তা নিয়ে অনুমান করা এখনই সম্ভব নয়।
ডেল্টাক্রনের তীব্রতা সম্পর্কে ইস্ট অ্যাঙ্গলিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের (University of East Anglia) সংক্রামক রোগ বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক পল হান্টার (Paul Hunter) বলেছিলেন যে এটি খুব বেশি হুমকির কারণ হওয়া উচিত নয়। তিনি বলেন, "এটা নিয়ে ভয়ের কারণ দেখছি না। কারণ হল, বর্তমানে ডেল্টা এবং ওমিক্রনের দ্রুত পতন ঘটছে এবং এদেশে ডেল্টা প্রায় বিলুপ্ত হয়ে গিয়েছে। ডেল্টাক্রনে ডেল্টা এবং ওমিক্রন উভয়ের অ্যান্টিজেন থাকবে এবং আমাদের ইতিমধ্যে এই দুই প্রজাতির বিরুদ্ধে উচ্চ স্তরের অনাক্রম্যতা রয়েছে। তাই তাত্ত্বিকভাবে এটি খুব বেশি হুমকির কারণ হওয়া উচিত নয়। যদিও কেউ নিশ্চিতভাবে সব কিছু ভবিষ্যদ্বাণী করতে পারে না, তবে এই মুহূর্তে আমি খুব বেশি চিন্তিত নই।"
ডেল্টাক্রনের সংক্রমণের হার কত?
ডেল্টাক্রনের উপসর্গ এবং এর সংক্রমণ হার (Transmission Rate) সম্পর্কে বেশি কিছু জানা যায়নি। এটির প্রকৃতি, ট্রান্সমিশন রেট, রিস্ক ফ্যাক্টর এবং সংক্রমণের তীব্রতা নিশ্চিত করার জন্য কোন সরকারি তথ্য এখনও পাওয়া যায়নি। করোনাভাইরাসের সমস্ত প্রজাতির মধ্যে ওমিক্রন প্রজাতিরই উচ্চ সংক্রমণের হার রয়েছে বলে বলা হয়েছিল আগে।
এটা কি উদ্বেগের একটি প্রজাতি হবে?
জানুয়ারিতে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বলেছিল ডেল্টাক্রন একটি পরীক্ষাগার ত্রুটি। সেই থেকে এখনও পর্যন্ত এই প্রজাতি নিয়ে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার থেকে আর কোনও আপডেট পাওয়া যায়নি। একটি করোনাভাইরাস বৈকল্পিককে উদ্বেগের একটি প্রজাতি বলা হয় যখন এটি মারাত্মক সংক্রমণযোগ্য হয়। এছাড়াও তীব্রতা, টিকার কার্যকারিতা, থেরাপিউটিক ওষুধ এবং ডায়াগনস্টিক সরঞ্জামগুলির সঙ্গে জড়িত গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্যগুলি ব্যাপকভাবে পরিবর্তিত হয়, যা মানবজাতির জন্য হুমকিস্বরূপ।
করোনাভাইরাসের উদ্বেগের অন্যান্য রূপগুলি কী কী?
এখনও পর্যন্ত করোনাভাইরাসের পাঁচটি প্রজাতিকে উদ্বেগের প্রজাতি (Variants Of Concern) হিসাবে চিহ্নিত করা হয়েছে, সেগুলি হল-আলফা (Alpha), বিটা (Beta), গামা (Gamma), ডেল্টা (Delta) এবং ওমিক্রন (Omicron)। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা জানিয়েছে, আলফা প্রজাতি (B.1.1.7) প্রথম ব্রিটেনে ২০২০ সালের সেপ্টেম্বরে পাওয়া গিয়েছিল। বিটা প্রজাতি (B.1.351) ২০২০ সালের মে মাসে দক্ষিণ আফ্রিকায় পাওয়া গিয়েছিল। পরবর্তী অত্যন্ত সংক্রমণযোগ্য প্রজাতি গামা (P.1) ২০২০ সালের নভেম্বরে ব্রাজিলে পাওয়া গিয়েছিল। এই তিনটি প্রজাতির মিউটেশনে কিছুটা মিল রয়েছে। বিশেষ করে স্পাইক প্রোটিনের মূল অঞ্চলে। SARS-CoV-2-তেও স্পাইক প্রোটিন একই মিউটেশনগুলি বহন করে।
করোনাভাইরাসের চতুর্থ প্রজাত ডেল্টা (B.1.617.2) বা সুপার-আলফা ২০২০ সালের অক্টোবরে ভারতে সনাক্ত করা হয়েছিল। বিশেষজ্ঞরা বলছেন যে এটি আলফা প্রজাতির তুলনায় ৬০ শতাংশ বেশি সংক্রমণযোগ্য ছিল৷ ডেল্টা সংক্রমিত ব্যক্তিদের শ্বাসনালীতে দ্রুত এবং উচ্চ স্তরে বৃদ্ধি পায়, ভাইরাসের বিরুদ্ধে প্রাথমিক প্রতিরোধ ক্ষমতাকে এড়াতে পারে।
ওমিক্রন (Omicron)-B.1.1.529 প্রজাতি ২০২১ সালের নভেম্বরে প্রথম সনাক্ত করা হয়েছিল। অন্যান্য প্রজাতির সঙ্গে তুলনা করলে ওমিক্রনে আরও বেশি মিউটেশন রয়েছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা জানিয়েছে, করোনাভাইরাসের অন্য উদ্বেগজনক প্রজাতিগুলি হল ল্যাম্বদা (Lambda) এবং মু (Mu)।
ওমিক্রন সংক্রমণের বর্তমান অবস্থা কী?
ওমিক্রনের কারণে তৃতীয় ঢেউ কমেছে। তবে এর একটি সাবভ্যারিয়েন্টকে নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (World Health Organization)। সাম্প্রতিক কিছু গবেষণায় ইঙ্গিত মিলেছে যে ওমিক্রনের প্রাথমিক ভ্যারিয়েন্টের চেয়ে আরও বেশি সংক্রামক বিএ.২ নামে চিহ্নিত এই সাবভ্যারিয়েন্ট। ইতিমধ্যেই সাবভ্যারিয়েন্টটি ৫৭টি দেশে সনাক্ত করা হয়েছে। আইসিএমআর (ICMR)-র বিজ্ঞানী সমীরণ পান্ডে এই প্রসঙ্গে বলেছেন, "কোভিড সংক্রমণের বয়স মাত্র দুই বছর। আমরা এখনও এই অতিমারীর বিষয়ে অধ্যয়ন করছি।"