সংক্রমণ যখন রেকর্ড উচ্চতায় বাড়তে থাকে, তখন বিপুল সংখ্যক মানুষ উদ্বিগ্ন থাকে। প্রকৃতপক্ষে তারা আশাবাদী হয় যে, সংক্রমণের কারণেই করোনাভাইরাসের বিরুদ্ধে ব্যাপক ইমিউনিটি বা অনাক্রম্যতা তৈরি হতে পারে। নতুন ওমিক্রন প্রজাতি অত্যন্ত সংক্রমণযাগ্য হলেও তা ডেল্টা স্ট্রেনের (Delta Variant) মতো বিপজ্জনক নয়। এই স্ট্রেনের সংক্রমণে মৃদু উপসর্গ দেখা যাচ্ছে। কয়েক জন বিশেষজ্ঞ দাবি করেছেন যে, ওমিক্রনসংক্রমণ হলে শরীরে দীর্ঘমেয়াদ প্রাকৃতিক অনাক্রম্যতা (Natural Immunity) গড়ে ওঠে। যদিও অনেক কিছুই এখনও জল্পনা-কল্পনার মধ্যেই রয়ে গিয়েছে। আসুন আমরা সম্ভাবনাগুলি নিয়ে আলোচনা করে নিই।
advertisement
আরও পড়ুন : ওমিক্রন আশীর্বাদ না অভিশাপ? এর সঙ্গেই কি শেষ হতে চলেছে অতিমারি?
শরীর কী ভাবে SARs-COV-2 ভাইরাসকে মনে রাখে?
গবেষণায় দেখা গিয়েছে যে, যাঁরা কোভিড থেকে সেরে ওঠেন, তাঁদের শরীরে এই ভাইরাসের বিরুদ্ধে একটি শক্তিশালী ইমিউন প্রতিক্রিয়া তৈরি হয়, যা তাঁদের ভবিষ্যতে পুনরায় সংক্রমণের হাত থেকে রক্ষা করে। এটি ইঙ্গিত দেয় যে, শরীরের রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থা ভাইরাস মনে রাখতে সক্ষম। কিন্তু কী ভাবে? মানব দেহের দু'টি প্রধান প্রতিরক্ষা লাইন রয়েছে। যেমন– সহজাত ইমিউন সিস্টেম (Innate Immune System) এবং অভিযোজিত ইমিউন সিস্টেম (Adaptive Immune System)। একটি সহজাত অনাক্রম্য প্রতিক্রিয়া হল প্রতিরক্ষার প্রথম লাইন, যা ভাইরাল কণা শনাক্ত হওয়ার পরই সেটিকে ধাক্কা মারে। প্রতিরক্ষার প্রথম লাইন প্রোটিন ক্ষরণের জন্য হোস্ট কোষকে উত্তেজিত করে, যা ভাইরাসের প্রতিলিপি গঠনে বাধা দেয়। অথবা এটি সংক্রমিত কোষগুলিকে বন্ধ করার চেষ্টা করার জন্য প্রতিরোধ ব্যবস্থাকে কাজে লাগায়।
অন্য দিকে, একটি অভিযোজিত ইমিউন প্রতিক্রিয়া একটি প্রতিক্রিয়া শুরু করতে আরও সময় নেয়। কারণ ইমিউন সিস্টেমকে একটি বিশেষ আক্রমণ শুরু করার আগে প্রথমে ভাইরাল আক্রমণকারীকে চিনতে হয়। অভিযোজিত প্রতিরোধ ব্যবস্থা ধীর। বি কোষ এবং টি কোষগুলি তাদের ভূমিকা নিতে কয়েক দিন সময় নিতে পারে। এক বার ভাইরাস শনাক্ত করা এবং নির্মূল করা হলে, মেমরি টি এবং বি কোষ তৈরি হয়। একই প্যাথোজেনের সংস্পর্শে না-আসা পর্যন্ত এগুলি সুপ্ত থাকে। তারা শুধুমাত্র ভাইরাল কণাকেই দ্রুত চিনতে পারে না, বরং শক্তিশালী প্রতিক্রিয়াও তৈরি করে, যা দীর্ঘমেয়াদে সুরক্ষা প্রদান করে।
আরও পড়ুন : করোনায় দু'বছরের কম বয়সি শিশুরা আক্রান্ত হচ্ছে কেন? শিশুদের ক্ষেত্রে ওমিক্রনের প্রভাব কতটা মারাত্মক?
বিভিন্ন প্রজাতি কি শরীরকে ভিন্ন ভাবে প্রভাবিত করে? কী ভাবে ওমিক্রন ডেল্টা বা অন্যান্য প্রজাতির থেকে ভিন্ন?
ভাইরাসগুলি পরিবর্তিত হওয়ার জন্য প্রোগ্রাম করা হয় এবং সময়ে সময়ে নতুন রূপগুলি আবির্ভূত হতে বাধ্য। এই নতুন রূপগুলি মিউটেশন, ভাইরাস এবং তীব্রতার পরিপ্রেক্ষিতে মূল স্ট্রেন থেকে আলাদা হতে পারে। ওমিক্রন প্রজাতির স্পাইক প্রোটিনেই তিরিশের বেশি মিউটেশন রয়েছে। বিজ্ঞানীরা বলেছেন যে, এটি সম্ভবত টিকা থেকে প্রাপ্ত অনাক্রম্যতা এড়াতে পারে এবং তাই দ্রুত হারে ছড়িয়ে পড়তে পারে। কোভিড কেসের সংখ্যার দ্রুত বৃদ্ধি এই দাবিকে সমর্থন করে। ডেল্টা প্রজাতির তুলনায় ওমিক্রন প্রায় চার গুণ বেশি সংক্রমণযোগ্য হলেও কম গুরুতর।
একটি অত্যন্ত সংক্রামক, হালকা বৈকল্পিক ব্যাপক অনাক্রম্যতা মানে?
এখনও পর্যন্ত যা জানা গিয়েছে, তাতে ওমিক্রন প্রজাতির সংক্রমণে হালকা উপসর্গ দেখা দিচ্ছে। হাসপাতালে ভর্তির সংখ্যা এ ক্ষেত্রে অনেক কম। আক্রান্তরা দ্রুত সুস্থও হয়ে উঠছেন। তাই বিশেষজ্ঞরা বিশ্বাস করেন যে, ওমিক্রন ব্যাপক অনাক্রম্যতা প্রদান করতে পারে কোনও কিছু না-করেও। দ্বিতীয় ঢেউয়ের যদিও একটি বৃহৎ জনসংখ্যা অনাক্রম্যতা অর্জন করেছিল, অনেকেই গুরুতর উপসর্গের সঙ্গে লড়াই করে জয়ী হয়েছেন। আবার কেউ কেউ ভাইরাসের কাছে হার স্বীকার করেছেন।
এক শীর্ষস্থানীয় সংক্রামক রোগ বিশেষজ্ঞ বলেছেন যে, কোভিডের ওমিক্রন প্রজাতি প্রায় অপ্রতিরোধ্য। এটি বৃহৎ জনসংখ্যাকে প্রভাবিত করবে। বুস্টার ডোজ নেওয়া থাকা সত্ত্বেও বহু মানুষ সংক্রমিত হবে। তবে, বিশেষজ্ঞরা এটাও দাবি করেছেন যে, ওমিক্রন একটি বিশাল জনসংখ্যাকে প্রাকৃতিক অনাক্রম্যতা প্রদান করতে পারে এবং এটি কোভিডকে অতিমারি পর্যায়ের বাইরে ঠেলে দিতে পারে। কেউ কেউ এমনও বলেছেন যে, সতর্কতামূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করা শুধুমাত্র একটি সুপার-প্রজাতির (Super-Variant) জন্ম দেবে, যা ব্যাপক অনাক্রম্যতা তৈরির সম্ভাবনাকে মাঠে মেরে দেবে।
আরও পড়ুন : ভারতে করোনার কোন কোন প্রজাতি সংক্রমণ ছড়াচ্ছে, তাদের উপসর্গ কী কী?
ওমিক্রন কি আজীবন অনাক্রম্যতার প্রতিশ্রুতি দিতে পারে?
সম্প্রতি, বেশ কয়েক জন গবেষক দাবি করেছেন যে, ওমিক্রনের সংক্রমণ প্রাকৃতিক টিকা (Natural Vaccine) হিসেবে কাজ করতে পারে। রিডিং বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাইরোলজিস্ট প্রফেসর ইয়ান জোনস সম্প্রতি এই ধারণাটিকে সমর্থন করেছেন। তিনি বলেছেন যে, অনেকটা ফ্লুয়ের মতো। ওমিক্রন সুস্থ লোকেদের জন্য কোনও বিপদ ডেকে আনে না। ওমিক্রন গুরুতর অসুস্থতা সৃষ্টি না-করেই দেহের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়াতে পারে।
ভবিষ্যতে কি কোভিড সংক্রমণ থেকে ব্যাপক অনাক্রম্যতা এবং সুরক্ষা আশা করতে পারি?
ভাইরোলজিস্ট শহিদ জামিল এই ধারণাকে বিপজ্জনক বলে অভিহিত করেছেন। ওমিক্রনের সংক্রমণ প্রাকৃতিক টিকা হিসেবে কাজ করতে পারে, এমন কোনও প্রমাণ এখনও মেলেনি। বিশেষ করে ভারতে, যেখানে অপুষ্টি, বায়ু দূষণ এবং ডায়াবেটিস ব্যাপক ভাবে ছড়িয়ে পড়েছে, সেখানে স্বেচ্ছায় লোকেদের এমন একটি ভাইরাসের সংস্পর্শে আসতে দেওয়া বিজ্ঞান এবং জনস্বাস্থ্যের পক্ষে হিতকর নয়। জামিল আরও বলেছেন যে, এই ধারণার পক্ষে সমর্থনকারী লোকজন কোভিড পরবর্তী অসুস্থতার কথা বিবেচনা করছেন না।
অনাক্রম্যতা হ্রাসের সমস্যা:
বিশেষজ্ঞরা বলেছেন যে, অনাক্রমতা সময়ের সঙ্গে সঙ্গে হ্রাস পেতে পারে। দ্য ল্যানসেট মাইক্রোবে প্রকাশিত ইয়েল স্কুল অফ পাবলিক হেলথের সাম্প্রতিক একটি সমীক্ষা অনুসারে, টিকা না-দেওয়া ব্যক্তিদের কোভিড হওয়ার পর ৩ থেকে ৬ মাস পর্যন্ত পুনরায় সংক্রমণের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ ক্ষমতা থাকা উচিত। সায়েন্স জার্নালে প্রকাশিত একটি পুরনো গবেষণায় দেখা গিয়েছে যে, অনাক্রম্যতা ৪ মাস পর্যন্ত স্থায়ী হতে পারে। যেখানে একটি গবেষণা দাবি করেছে যে, কোভিড সংক্রমণ থেকে তৈরি অ্যান্টিবডি কমপক্ষে ৫-৭ মাস স্থায়ী হয়। তা হলে এটা পরিষ্কার যে, প্রতিরোধ ক্ষমতা শুধুমাত্র একটি নির্দিষ্ট সময়ের জন্য স্থায়ী হয়। এর অর্থ দীর্ঘমেয়াদে পুনরায় সংক্রমণের একটি সম্ভাবনা রয়ছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (WHO) রিপোর্ট করেছে যে, প্রাথমিক প্রমাণগুলি ইঙ্গিত করে যে, ওমিক্রনে পুনরায় সংক্রমণের ঝুঁকি বাড়তে পারে। অর্থাৎ, যাঁদের আগে কোভিড হয়েছিল, তাঁরাও আরও সহজে ওমিক্রনে পুনরায় সংক্রমিত হতে পারেন।
মাস্ক পরা, সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখা জরুরি:
টিকা নেওয়া হোক বা না-হোক, বর্তমানে প্রায় সকলেই সংক্রমণের ঝুঁকির আওতায়। প্রাপ্তবয়স্ক, শিশু এবং বয়স্ক– সকলেই আক্রান্ত হতে পারেন করোনভাইরাসে। কারণ ভাইরাসটিই অত্যন্ত সংক্রামক। যাঁরা বয়স্ক এবং আগে থেকেই কোনও রোগে আক্রান্ত বা যাঁদের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কম, তাঁদের সংক্রমণের ঝুঁকি বেশি। তাই কোভিড বিধি ও অন্য সব সুরক্ষা বিধি মেনে চলতে হবে। নতুন প্রজাতি ওমিক্রনও অত্যন্ত সংক্রমণযোগ্য এবং টিকা প্রতিরোধ ক্ষমতা এড়াতে পারে। এটা বিবেচনা করে অবশ্যই সতর্ক থাকতে হবে, মাস্ক (Mask) পরতে হবে। সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখতে হবে, ভিড়-জমায়েতে যাওয়া চলবে না। টিকা অবশ্যই নিতে হবে। বর্তমানে যাঁদের বুস্টার ডোজ দেওয়া হচ্ছে, দেরি না-করে তাঁদের এটা অবশ্যই নিতে হবে।