বিশেষজ্ঞরা বিশ্বাস করেন যে টিকা থেকে প্রাপ্ত অনাক্রম্যতা (Immunity) সময়ের সঙ্গে সঙ্গে হ্রাস পেতে পারে, অতিরিক্ত শট নেওয়া হলে আরও কার্যকর ইমিউন প্রতিক্রিয়া ট্রিগার করতে পারে, পাশাপাশি শরীরে অ্যান্টিবডির সংখ্যাও বৃদ্ধি করতে পারে। নতুন কোভিড প্রজাতির আবির্ভাবের পরে বুস্টার শটগুলির চাহিদা বেড়েছে। কারণ, টিকা নেওয়ার পরেও সংক্রমিত (Breakthrough Infections) হচ্ছেন অনেকে এবং সম্পূর্ণরূপে টিকা নেওয়া হলেও ঝুঁকি থেকে যাচ্ছে। বিশেষজ্ঞদের দাবি, তৃতীয় কোভিড টিকার ডোজ শুধুমাত্র অনাক্রম্যতা (Immunity) বৃদ্ধি করবে।
advertisement
কাদের বুস্টার ডোজ নিতে হবে?
১৮ বছরের বেশি বয়সি যে কেউ বুস্টার ডোজ পেতে পারে। এছাড়াও বয়স্করা, যাদের পূর্ব-বিদ্যমান দীর্ঘস্থায়ী অসুস্থতা (Co-Morbidities) রয়েছে তাদের বুস্টার ডোজ নেওয়া উচিত। এছাড়াও যারা ইমিউনোকম্প্রোমাইজড (Immunocompromised) বা রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কম, তাদেরও বুস্টার শট দেওয়ার জন্য অগ্রাধিকার দেওয়া উচিত। বর্তমানে, ভারতে ১০ জানুয়ারি থেকে বুস্টার ডোজ দেওয়া শুরু হয়েছে। চিকিৎসক, স্বাস্থ্যকর্মী, পুলিশ সহ ফ্রন্টলাইন কর্মী ও ষাটোর্ধ্বরা এই ডোজ পাচ্ছেন। তবে ককটেল নয়, আগে যে টিকা নেওয়া হয়েছে, সেই টিকারই বুস্টার ডোজ দেওয়া হচ্ছে। দ্বিতীয় ডোজ নেওয়ার দিন থেকে ৩৯ সপ্তাহের মধ্যে একটি বুস্টার ডোজ নেওয়া যেতে পারে। আগে থেকেই অসুস্থ ৬০ বছর বা তার বেশি বয়সি নাগরিকরাও সতর্কতামূলক ডোজ নিতে পারে, তবে শুধুমাত্র ডাক্তারের পরামর্শের পরেই তা নেওয়া যায়।
বুস্টার ডোজ কতটা কার্যকর?
বুস্টার ডোজ রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতাকে প্যাথোজেনের (Pathogen) স্মৃতি ধরে রাখতে সাহায্য করে এবং ভবিষ্যতে একই ধরনের আক্রমণের জন্য প্রস্তুত রাখে। মূল টিকার ডোজের কার্যকারিতা কমতে শুরু করলে বুস্টার ডোজ অপরিহার্য। করোনাভাইরাসের উদীয়মান প্রজাতি পরিপ্রেক্ষিতে বুস্টার ডোজ আশীর্বাদের চেয়ে কম কিছু নয়। এই টিকার শট শরীরকে আসন্ন মিউটেটিং ভ্যারিয়েন্ট থেকে রক্ষা করে। কোভিডের তৃতীয় ঢেউয়ের সময় টিকা এবং বুস্টার শটের কার্যকারিতা দেখা গিয়েছে। এই ঢেউয়ের সময় রোগীদের মধ্যে সংক্রমণের তীব্রতা কম দেখা গিয়েছে। অধিকাংশ সংক্রমিতকে হাসপাতালে ভর্তি হতে হয়নি। যদিও অনেক বিজ্ঞানী ওমিক্রন প্রজাতির মৃদু প্রকৃতিকে এর পিছনে কারণ হিসাবে দায়ী করেছেন, অন্যরা বলছেন যে টিকা দেওয়ার কারণে বেশিরভাগ মানুষের মধ্যে সংক্রমণের তীব্রতার ঝুঁকি হ্রাস পেয়েছে।
বুস্টার ডোজের সুরক্ষা কতদিন স্থায়ী হয়?
বুস্টার ডোজের প্রভাব ১০ সপ্তাহ পরে হ্রাস পায়, তবে গুরুতর রোগের বিরুদ্ধে সুরক্ষা বেশি থাকে বলে দাবি বিশেষজ্ঞদের। তথ্য বিশ্লেষণ করে জানা গিয়েছে, টিকার দুটি ডোজ নেওয়ার ২০ সপ্তাহের মধ্যে হালকা সংক্রমণের বিরুদ্ধে টিকার সুরক্ষা চলে যায়। এরপর বুস্টার ডোজ নেওয়ার পরে সুরক্ষা প্রাথমিকভাবে প্রায় ৬৫ থেকে ৭০ শতাংশ পর্যন্ত বৃদ্ধি পায়। কিন্তু ১০ সপ্তাহের পর ৪৫ থেকে ৫০ শতাংশ পর্যন্ত কমে যায়। বুস্টার ডোজে গুরুতর রোগের বিরুদ্ধে সুরক্ষা অনেক বেশি। একটি বুস্টার ডোজ নেওয়ার পরে হাসপাতালে ভর্তির বিরুদ্ধে টিকার কার্যকারিতা ৯২ শতাংশ থাকে বলে অনুমান করা হয় এবং ১০ সপ্তাহের বেশি সময় পর্যন্ত ৮৩ শতাংশে থাকে। আরেকটি গবেষণা বলছে, গুরুতর রোগের বিরুদ্ধে বুস্টার ডোজগুলি কার্যকার।
বাড়তে থাকা নতুন ভ্যারিয়ান্ট উদ্বেগের কারণ
প্রথমে ডেল্টা, এখন ওমিক্রন, সব মিলিয়ে কোভিড-১৯-এর একের পর এক নতুন প্রজাতি আসতে থাকায় ভ্যাকসিন বুস্টারের চাহিদা বেড়েই চলেছে। কারণ দু'টি ডোজ নেওয়া থাকলেও ঝুঁকি পিছু ছাড়ছে না। এদিকে এখন নতুন, ক্রমশ বহুরূপে পরিবর্তিত ওমিক্রন প্রজাতিতে আক্রান্তের সংখ্যা ক্রমে বেড়েই চলেছে। এখনও পর্যন্ত ওমিক্রনে আক্রান্তদের মধ্যে সামান্য উপসর্গই দেখা গিয়েছে, তবে আক্রান্তের সংখ্যার গ্রাফ রীতিমতো চিন্তার কারণ হয়ে উঠছে।
বর্তমানে, অনেক ভ্যাকসিন উৎপাদনকারী কোম্পানির তরফে জানানো হয়েছে যে কোম্পানিগুলি ভ্যাকসিন টুইক করতে পারে বা সম্ভবত একটি নতুন ওমিক্রন-নির্দিষ্ট শট তৈরি করতে পারে, যা কোম্পানিগুলির মতে নতুন স্ট্রেনের বিরুদ্ধে কার্যকর প্রমাণিত হবে। যদিও অনেক জল্পনাই এখন আলোচনার স্তরে রয়েছে।
আরও পড়ুন- শুধু শ্বাসকষ্টই নয়, কোভিড সংক্রমণের ফলে দেখা দেয় পেট ব্যথার মতো উপসর্গও, জানুন বিশদে!
ক্ষীয়মান ইমিউনিটির সমস্যা বাড়াতে পারে
ভারতে প্রায় এক বছর ৪৫ বছর বয়সীদের কোভিড-১৯ টিকা শুরু হয়েছে। প্রাথমিকভাবে স্বাস্থ্যকর্মী এবং ফ্রন্টলাইন কর্মীদেরও টিকা দেওয়ার ক্ষেত্রে অগ্রাধিকার দেওয়া হয়। তাই বিশেষজ্ঞদের বিশ্বাস যে সময়ের সঙ্গে ভ্যাকসিন থেকে পাওয়া ইমিউনিটি নষ্ট হয়ে যেতে পারে বলে বুস্টার শট ইমিউনিটি বাড়ানোর ক্ষেত্রে ভূমিকা নিতে পারে। যদিও এব্যাপারে এখনো কোনও জোরদার প্রমাণ পাওয়া যায়নি।
কোভিড-১৯ বুস্টার শট কি নিয়মিত নিতে হবে?
কোভিড-১৯ ভ্যাকসিন হল আসল ভাইরাসের একটি অনুকরণ। ভ্যাকসিনের প্রকারের উপর নির্ভর করে, এমআরএনএ ভ্যাকসিন বা ভাইরাল ভেক্টর ভ্যাকসিন, এটি শরীরের ইমিউন সিস্টেমকে নিষ্ক্রিয় ভাইরাস কণা বা স্পাইক প্রোটিন সনাক্ত করতে এবং প্রয়োজনীয় প্রদাহজনক প্রতিক্রিয়া দ্রুত করতে সাহায্য করবে, যা পরে অ্যান্টিবডি তৈরির দিকে এগোয়। পরবর্তীকালে, যখন একটি আসল ভাইরাস শরীরের ইমিউন সিস্টেমকে আক্রমণ করে, তখন এই অ্যান্টিবডি সংক্রমণের বিরুদ্ধে লড়াই করতে সাহায্য করে।
শরীরে ভ্যাকসিন থেকে হওয়া অ্যান্টিবডিগুলি সময়ের সঙ্গে সঙ্গে কমে যায় বলে বুস্টার শটগুলি ইমিউনাইজিং অ্যান্টিজেনে একজন ব্যক্তির ইমিউন সিস্টেম ফের কার্যকর করে তোলে। যদিও এক্ষেত্রে কোনো জোরালো প্রমাণ নেই যে ভ্যাকসিনের ইমিউনিটি সময়ের সঙ্গে নষ্ট হয়ে যায়, তবে যদি করোনার টিকা অন্যান্য ভাইরাল টিকার মতো হয় তবে তা নিয়মিত উন্নত করতে হবে। এক্ষেত্রে বুস্টার শট প্রতি বছর অতিরিক্ত বা বার্ষিক শট হিসাবে প্রয়োজন হতে পারে।
বুস্টার শট হিসাবে নতুন ভ্যাকসিন দেওয়া হচ্ছে দেশে?
এখন একটি ট্রায়াল চলছে, যেখানে কোভিশিল্ড বা কোভ্যাক্সিন পাওয়া স্বেচ্ছাসেবকদের কর্বেভ্যাক্স (Corbevax) টিকার তৃতীয় ডোজ দেওয়া হচ্ছে। এই টিকা ইতিমধ্যেই জরুরি ব্যবহারের জন্য ভারতের ওষুধ নিয়ন্ত্রকের থেকে অনুমোদন পেয়েছে।
দেশে ব্যবহৃত যে কোনও টিকার তৃতীয় শট (Booster Dose) নেওয়া যায়। ভারতে বুস্টার মিশ্রিত না করার আরেকটি কারণ হতে পারে পর্যাপ্ত পরিমাণে টিকা না থাকা। ভারতে বেশিরভাগ লোককে কোভিশিল্ড টিকা দেওয়া হয়েছে, ১.৩২ বিলিয়নেরও বেশি ডোজ দেওয়া হয়েছে। বুস্টার মিশ্রিত করার অর্থ এই পরিমাণ লোককে তাদের তৃতীয় ডোজের জন্য কোভ্যাক্সিন বা স্পুটনিক-ভি টিকার একটি শট দিতে হবে।
বায়োলজিক্যাল ই গত বছরের ডিসেম্বরে বলেছিল যে তারা নতুন বছরের ফেব্রুয়ারি থেকে প্রতি মাসে ১০০ মিলিয়নের বেশি ডোজ উৎপাদনের আশা করছে এবং শীঘ্রই বিশ্বব্যাপী এক বিলিয়নেরও বেশি অতিরিক্ত ডোজ সরবরাহ করার পরিকল্পনা করছে। জানা গিয়েছে, কেন্দ্রীয় সরকার ইতিমধ্যেই ৩০ কোটি কর্বেভ্যাক্স টিকার অগ্রিম অর্ডার দিয়েছে।
কোভিড বিধি মেনে চলা জরুরি: টিকা নেওয়া হোক বা না হোক, বর্তমানে সবাই সংক্রমণ প্রবণ। প্রাপ্তবয়স্ক, শিশু এবং বয়স্ক, সবাই করোনাভাইরাস সংক্রমণের ঝুঁকিতে রয়েছে। কারণ ভাইরাসটিই অত্যন্ত সংক্রামক। যারা বয়স্ক এবং আগে থেকেই কোনও রোগে আক্রান্ত বা রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কম, তাদের সংক্রমণের ঝুঁকি বেশি। তাই কোভিড বিধি (Covid Protocol) ও অন্য সব সুরক্ষা বিধি মেনে চলতে হবে। নতুন প্রজাতি ওমিক্রনও (Omicron) অত্যন্ত সংক্রমণযোগ্য এবং টিকা প্রতিরোধ ক্ষমতা এড়াতে পারে। এটা বিবেচনা করে অবশ্যই সতর্ক থাকতে হবে, মাস্ক (Mask) পরতে হবে। অন্য লোকেদের থেকে সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখতে হবে। টিকা অবশ্যই নিতে হবে। যারা বুস্টার ডোজ পাওয়ার যোগ্য তাদের এটা অবশ্যই নিতে হবে।