আজ থেকে আড়াই দশক আগে গ্রামের বাড়ি ছেড়ে চলে গিয়েছে রজত৷ সঙ্গে নিয়ে গিয়েছে নিজের বালক পুত্রকে৷ স্ত্রীর অকালমৃত্যুর জন্য সে কার্যক দায়ী করে পরিবারকেই৷ বদলির চাকরি করা রজত খবর পেয়েছিল তার স্ত্রী অন্নপূর্ণা অসুস্থ৷ কিন্তু ভাবতে পারেনি ছুটি পেয়ে দেখতে যাওয়ার আগেই চিরতরে হারাতে হবে অর্ধাঙ্গিনীকে৷ বাড়ির লোক কেন ডাক্তারের কাছে নিয়ে যায়নি অন্নপূর্ণাকে-এই ক্ষোভে পরিবারের সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করে রজত৷ তার মায়ের যুক্তি, অন্নপূর্ণা বাড়ি ছেড়ে, গ্রাম ছেড়ে যেতে চায়নি৷ গ্রামের চিকিৎসা ব্যবস্থাতেই তার বিশ্বাস ছিল৷
advertisement
স্ত্রীকে হারালেও জীবনের ছন্দ ছত্রখান হয়নি রজতের৷ কলকাতায় গিয়ে সে একাই ছেলে সোমনাথকে বড় করে তুলেছে৷ আজ, সোমনাথ উচ্চপদস্থ কর্পোরেট চাকুরে৷ সুনিপুণ দক্ষতায় লোকের চাকরি খাওয়াতেই তার সাফল্য৷ চাকরির মাশুল দিতে গিয়ে দিনের শেষে উচিত-অনুচিতের দ্বন্দ্বে ক্ষতবিক্ষত হতে থাকে সোমনাথ৷ পালাতে চায় কর্পোরেট জীবনের চাকচিক্য থেকে৷ সোমনাথ যত পালাতে চায়, রজত তাকে তত বেঁধে ফেলে সোনার শিকলে৷ বন্ধুর সুন্দরী মেয়ের সঙ্গে বিয়েও ঠিক করে ফেলে৷
আরও পড়ুন : অঙ্কস্যার আর পপিন্স পাশে থাকলে ঘোতনের মতো টাট্টুঘোড়াও উড়ে যেতে পারে পক্ষীরাজ হয়ে! মাক্কালী!
ক’দিন পরই কানাডা উড়ে যাবে সোমনাথ৷ সেখানেই ঘর বাঁধবে স্ত্রীর সঙ্গে৷ তার আগে অফিসের কাজের নামে, বাবাকে না জানিয়েই চলে আসে মানিকপুরে৷ গ্রামের বাড়িতে ঠাকুমা, জেঠু-জেঠি, দুই কাকা-কাকিমা, তুতো ভাইবোনদের মাঝে জীবনের নতুন আস্বাদ পায়৷ গ্রামের মেঠো গন্ধে ভরপুর দিনগুলি তাকে শেখায় বেঁচে থাকার অন্য অর্থ৷ প্রজেক্ট-টার্গেট-অ্যাচিভমেন্ট থেকে আলোকবর্ষ দূরে সেই যাপন মাটির অনেক কাছাকাছি৷ কিন্তু মানুষের স্বপ্ন সেখানে মেটে হয়ে যায়নি, বরং বেশ রঙিন৷ এবং সঙ্কল্প দৃঢ়৷ তাই মনের জোরে গ্রামের দুর্নীতির মুখে রুখে দাঁড়ায় রাই, সোমনাথের বাল্যসখী৷ সফল কেরিয়ার ছেড়ে গ্রামের স্কুলের দিদিমণি হয়েই আছে রাই৷ এখানে থেকেই ভবিষ্যতের নাগরিক হওয়ার কারিগরের ভূমিকাতেই তার জীবনের সার্থকতা৷
এই প্রাণবন্ত জীবন? নাকি কানাডায় মোটা অঙ্কের বেতন? কোনটা বেছে নেবে সোমনাথ? বাঙালির আদি অকৃত্রিম পূর্ব পশ্চিমের দ্বন্দ্বে কার কাছে যাবে সে? রাস পূর্ণিমার জ্যোৎস্নায় কতটা প্লাবিত হবে তার জীবনদর্শন? জানতে দেখতে হবে ‘রাস’৷ এ ছবি দেখতে দেখতে তরুণ মজুমদারকে মনে পড়বেই৷ বাঙালি তথা বাংলা ছবির রোজনামচা থেকে হারিয়ে যাওয়া অনেক কিছু ফিরিয়ে এনেছেন পরিচালক৷ যে সময়ে সাফল্যের অন্যতম মাপকাঠি সন্তানের বিদেশে চাকরি করা-সেই সময়ে দাঁড়িয়ে এই ছবি ভাবিয়ে তুলবে৷ জিয়া নস্টাল করে মনকে আনমনা করবে৷
আরও পড়ুন : মগনলাল মেঘরাজের মুলুকে কেমন হল একেনবাবুর অভিযান? পড়ুন ‘The একেন-বেনারসে বিভীষিকা’-র রিভিউ
মূল ভূমিকায় বিক্রম চট্টোপাধ্যায় এবং দেবলীনা কুমার যত্ন নিয়ে অভিনয় করেছেন৷ তবে বিক্রমের অভিনয়ে যেন অতিরিক্ত সাবধানতা, আড়ষ্টতা এসে ভিড় করেছে মাঝে মাঝেই৷ বাকি কুশীলবদের মধ্যে সোমনাথের দিদামার ভূমিকায় অনসূয়া মজুমাদর তাঁর সহজাত স্বতঃস্ফূর্ততাকে মনে করিয়েছেন৷ বড় জেঠুর চরিত্রে শঙ্কর দেবনাথ,সেজো জেঠুর চরিত্রে অনির্বাণ চক্রবর্তী যতটা সুযোগ পেয়েছেন, দর্শনীয় মুহূর্ত উপহার দিয়েছেন৷ ছোট্ট পরিসরে ঝকঝকে লেগেছে রণজয় বিষ্ণুকে৷ ছবির গান এবং আবহসঙ্গীত গল্পের সঙ্গে যথাযথ৷ ভাল লাগে তরুণ মজুমদার-তপন সিনহা ঘরানার মতো চিত্রনাট্য অনুযায়ী রবীন্দ্রসঙ্গীতের ব্যবহার৷ ক্যামেরা মায়াময়। তবে সংলাপ আরও পরিণত হতে পারত৷ দ্বিতীয়ার্ধে সম্পাদকের কাঁচি আরও একটু ধারালো হওয়া প্রয়োজন ছিল৷
রাধাকৃষ্ণের রাস উৎসব এই ছবির বাঁধনের মূল উপজীব্য৷ কিন্তু চক্রবর্তী পরিবারে সেই উৎসব আরও নিখুঁতভাবে দেখানোর দাবি রাখে চিত্রনাট্য৷ পারিবারিক সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের দৃশ্য মন ছুঁয়ে গেলেও গ্রামবাংলার একান্ত আপন সেই রাস পার্বণের মূল অংশ আরও একটু ফ্রেমবন্দি করা যেত৷ আর,যে বাড়ির বর্ষীয়ান কর্ত্রী গ্রামের মামাবাড়িতে বেড়াতে আসা শহুরে নাতনির হ্রস্ব পোশাকে আপত্তির কিছু দেখেন না, যিনি গার্হস্থ্য হিংসার বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে আর এক বিবাহিত নাতনির বাপের বাড়িতে থাকাকে পূর্ণ সমর্থন করেন, তাঁর সংসারে গত শতকের নয়ের দশকে আলতা-নূপুর পরা নাবালিকা কিশোরী পুত্রবধূ বেশ বেমানান৷