১৯২৩ সালের ১৪ মে জন্ম পূর্ববঙ্গের ফরিদপুরে৷ পদার্থবিজ্ঞান নিয়ে পড়াশোনার ইচ্ছের পাশাপাশি ছোট থেকেই সঙ্গী ছিল ছবি দেখার নেশা৷ আজীবন চলচ্চিত্র ছিল অমোঘ নেশা হয়েই৷ পেশার মাপকাঠিতে মাপতে যাননি নিজের প্যাশনকে৷ যে কলকাতা তাঁর ছবির উপজীব্য থেকে চরিত্র হয়ে উঠেছে বার বার, তার নাগরিক তিনি হয়েছিলেন কৈশোরেই ৷ তিরিশের দশকে কলেজজীবনে বাম রাজনীতিতে হাতেখড়ি৷ ওই সময়পর্বেই থিয়েটার ও ছবির জগতের অঙ্গন উন্মুক্ত হয় তাঁর সামনে৷ স্বপ্ন সঙ্গে নিয়েই পেশার টানে পা রাখলেন কলকাতার বাইরে৷ কিন্তু মেডিক্যাল রিপ্রেজেন্টেটিভের চাকরিতে বেশি দিন মন বসল না৷ চারের দশকে ফিরলেন কলকতায়, এ বার তাঁর পাখির চোখ শুধুই চলচ্চিত্র৷
advertisement
‘পথের পাঁচালী’-র মুক্তির বছর অর্থাৎ ১৯৫৫ সালে মুক্তি পেয়েছিল মৃণাল সেনের প্রথম ছবি ‘রাতভোর’৷ তার তিন বছর পরে ‘নীল আকাশের নীচে’৷ তবে প্রথম দুই ছবির পর সমালোচক বা দর্শক, কোনও মহলেই দাগ কাটতে পারেননি তরুণ পরিচালক৷ রাজনৈতিক বার্তার জন্য ‘নীল আকাশের নীচে’-এর উপরে নেমে এসেছিল নিষেধাজ্ঞার খাঁড়াও৷
আন্তর্জাতিক পরিচিতি পেতে অপেক্ষা করতে হয়েছিল ছয়ের দশক পর্যন্ত৷ ১৯৬০ সালে প্রেক্ষাগৃহে এল ‘বাইশে শ্রাবণ’৷ দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের প্রেক্ষাপটে বাংলা জুড়ে ভয়াবহ দুর্ভিক্ষের সামনে অসহায় এক দম্পতির জীবনযুদ্ধ মৃণালকে নিয়ে এল আন্তর্জাতিক মঞ্চের আলোয়৷ তাঁর ছবির মধ্যে এটাই প্রথম দেখানো হয়েছিল বিদেশি চলচ্চিত্র উৎসবে৷ প্রদর্শিত হয়েছিল লন্ডন ফিল্ম ফেস্টিভ্যালে৷
আরও পড়ুন : শতবর্ষে মৃণাল সেনকে শ্রদ্ধার্ঘ্য জানিয়ে কৌশিক গঙ্গোপাধ্যায়ের ছবি ‘পালান’, খুশি মৃণালপুত্র কুণাল
বনফুলের উপন্যাসের সেলুলয়েড রূপ ‘ভুবন সোম’ তাঁকে এনে দেয় তিনটি জাতীয় পুরস্কার৷ শ্রেষ্ঠ পরিচালক, শ্রেষ্ঠ ছবি বিভাগের পাশাপাশি শ্রেষ্ঠ অভিনেতার পুরস্কার পান উৎপল দত্ত৷ এই ছবি দিয়ে শুরু৷ এর পর ‘কোরাস’, ‘মৃগয়া’, ‘আকালের সন্ধানে’, ‘ক্যালকাটা ৭১’, ‘খারিজ’, ‘পুনশ্চ’, ‘আকাশকুসুম’, ‘অন্তরীন’, ‘ওকা উড়ি কথা’, ‘পরশুরাম’, ‘এক দিন প্রতিদিন’, ‘খণ্ডহর’, ‘পদাতিক’-জাতীয় পুরস্কার-সহ একাধিক সম্মানে ভূষিত হয়েছে তাঁর সৃষ্টি৷ ‘ইন্টারভিউ’, ‘ক্যালকাটা ৭১’, ‘পদাতিক’-মৃণালের এই তিন সৃষ্টি এখনও অবধি নাগরিক জীবন নিয়ে ছবি-তালিকার শীর্ষে ৷ তাঁর ছবিতে কলকাতা শুধুই কল্লোলিনী বা তিলোত্তমা নয় ৷ বরং, প্রকট হয়ে ওঠে বেকারত্ব, দারিদ্র, অনাহার-সহ এই শহরের বিভিন্ন ক্ষত৷
তাঁর স্রষ্টা সত্ত্বার পিছনে অন্যতম অনুঘটক তাঁর স্ত্রী গীতা৷ সত্যজিতের ছবিতে বিজয়া রায়ের ভূমিকা যেমন অনস্বীকার্য, তেমনই মৃণালের ছবির বিভিন্ন ক্ষেত্রে থাকত গীতার নীরব উপস্থিতি৷ বিয়ের পরে গীতা অভিনয় আর না করলেও স্ত্রীর পরামর্শ এবং সমালোচনাকে বিশেষ গুরুত্ব দিতেন মৃণাল৷ চিত্রনাট্য, সেট, অভিনয় থেকে কুশীলবদের পোশাক-সব দিকে গীতার তীক্ষ্ণ নজর থাকত৷ বহু সাক্ষাৎকারে সে কথা জানিয়েছেন পরিচালক নিজেই ৷
আরও পড়ুন : রবীন্দ্রনাথ থেকে রামপ্রসাদ! মুকুটে নয়া পালক জুড়তেই ক্ষোভ উগরে মুখ খুললেন শ্রীজাত
তাঁর ছবি, শর্ট ফিল্ম, তথ্যচিত্র-সহ বিভিন্ন কাজ বহু বার সমালোচিত হয়েছে এর কৃষ্ণ বিষয়ের জন্য ৷ কিন্তু নিজের দৃষ্টিভঙ্গি বা জীবনদর্শন থেকে সরে এসে পপুলিস্ট হতে চাননি তিনি ৷ দীর্ঘ কর্মজীবনে একে একে নামের পাশে যোগ হয়েছে ‘দাদা সাহেব ফালকে পুরস্কার’, ‘পদ্মভূষণ’, ‘কমান্দ্যর দ্য অর্দ্র দ্য আর্ত্ এ দ্য লের্ত্র’-এর মতো সম্মান ৷
২০০২ সালে মুক্তি পেয়েছিল তাঁর শেষ ছবি ‘আমার ভুবন’৷ নিজেই বলতেন প্রতি ছবি শেষ হওয়ার পর তিনি ধ্বংস হয়ে যান৷ আবার জেগে ওঠেন পরের ছবির জন্য৷ তাঁর ছবিগুলিও দর্শককে জাগিয়ে তোলে সুখের দিবাস্বপ্ন থেকে৷ টেনে হিঁচড়ে নামিয়ে আনে বাস্তবের মাটিতে৷ ‘লার্জার দ্যান লাইফ’ নয়৷ তাঁর ছবির বিষয় ‘লাইফ’৷ মানুষের জীবন ও তার চর্যাকেই লালনপালন করে বাংলা চলচ্চিত্র জগতে এনেছিলেন নতুন যুগ৷ সেই যুগ কোনওদিন খারিজ হয়ে যায় না। বরং বাইশে শ্রাবণের ধারার মতোই বাংলা ছবিকে খণ্ডহর থেকে নিয়ে যায় পদাতিকের পথে।