এই সমস্যা ঘরে ঘরে, হয় ব্যস্ত জীবনধারার সঙ্গে তাল রাখতে গিয়ে সংসারে মন দেওয়ার সময় নেই, অথবা নেই অসুস্থ পরিজনের নিজে হাতে পরিচর্যার সামর্থ্য, গৃহকর্মী বলা যাক, আয়া বলা যাক, যে নামেই ডাকা হোক না কেন, পরিবারে তখন তাঁদের ভূমিকা অপরিসীম আর অপরিহার্য দুই হয়ে ওঠে। সংসারের ছন্দ তখন ঘোরে অন্য দিকে, এক নতুন সমীকরণ, নতুন সখ্যতার অবকাশও তৈরি হয় বইকি, যা নিয়ে লক্ষ্মীকান্তপুর লোকাল ছবির চিত্রনাট্য বুনেছেন পরিচালক রামকমল মুখোপাধ্যায়।
advertisement
ছবি এগিয়েছে মালতী (চান্দ্রেয়ী ঘোষ), কল্যাণী (পাওলি দাম) এবং সরস্বতীকে (সায়নী ঘোষ) অনুসরণ করে, যারা প্রতিদিন সকালে লক্ষ্মীকান্তপুর লোকাল ট্রেনে উঠে কাজের বাড়িতে পৌঁছায়। পরিচালক তাদের গল্প তিনটি পরিবারের মধ্যে তুলে ধরেন: লেখক অনি (ইন্দ্রনীল সেনগুপ্ত) এবং টেলিভিশন অভিনেত্রী অপর্ণা (সঙ্গীতা সিনহা), যারা আলজাইমার্স রোগে আক্রান্ত অসুস্থ বাবার যত্নআত্তির জন্য সংগ্রাম করছে; লিভ-ইন দম্পতি তিয়াশা (রাজনন্দিনী পাল) এবং আত্মদীপ (জন ভট্টাচার্য), যারা ক্রমাগত পিচ এবং প্রযোজকদের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলছে; এবং লাবণ্য (ঋতুপর্ণা সেনগুপ্ত ), যে তার পক্ষাঘাতগ্রস্ত স্বামীর (কৌশিক গঙ্গোপাধ্যায়) যত্ন নেওয়ার পুরো ভার বহন করছে, যেখানে তার ছেলে বিদেশে পড়াশোনা করছে।
আরও পড়ুন– ‘আমার কাছে উনি বাবার মতো…’ ধর্মেন্দ্রর প্রয়াণে শাহরুখের আবেগঘন পোস্ট
ছবির প্রথমার্ধটি ধীরে সুস্থে জীবনের দৈনন্দিন ছন্দের মতোই এগোতে থাকে, যা নারীদের যাত্রার চিরন্তন আখ্যান তুলে ধরে। দ্বিতীয়ার্ধে গতি বেড়ে যায় ছবির, লোকাল ট্রেন যেমন গতি বাড়ায়, ঠিক সেরকম করেই। চিত্রনাট্যে দত্তক নেওয়া, অভিবাসন, শিক্ষা এমন অনেক বিষয় উঠে এসেছে, চরিত্রগুলো পেয়েছে এক অনন্য মাত্রা।
ছবির সঙ্গীত অসাধারণ, যা চিত্রনাট্যের আবেগঘন পরিবেশকে সমৃদ্ধ করেছে। ইমন চক্রবর্তীর কণ্ঠে হেমাঙ্গ বিশ্বাসের ‘সোনা বন্ধু রে’ বিশেষভাবে আলোড়ন সৃষ্টি করে, অন্য দিকে, সোনু নিগমের তুই যে আপন মণীশ চক্রবর্তীর সুরে আধুনিক বাংলা ছবির সম্পদ হয়ে থাকবে।
কল্যাণী চরিত্রে পাওলি দামের অভিনয় অন্যতম শক্তিশালী পারফরম্যান্স, মালতী চরিত্রটি চান্দ্রেয়ী ঘোষ অনায়াসে জীবন্ত করে তোলেন, তার আবেগঘন অনুভূতি স্পষ্টভাবে তার যন্ত্রণার চিত্র তুলে ধরে। সায়নী ঘোষ এবং দেবাশিস মণ্ডল একটি মনোমুগ্ধকর জুটি তৈরি করেছেন, অন্য দিকে, রাজনন্দিনী পাল এবং জন ভট্টাচার্যের রসায়ন সহজ, বাস্তবসম্মত। ঋতুপর্ণা সেনগুপ্ত এবং কৌশিক গঙ্গোপাধ্যায় অভূতপূর্ব দক্ষতায়, অসাধারণ স্বাচ্ছন্দ্যে একটি বৃদ্ধ দম্পতিকে তুলে ধরেছেন, যাদের এমন একটি সম্পর্ক গড়ে তোলার সুযোগ দেওয়া হয়েছে যা সত্যিকার অর্থে বসবাসের অনুভূতি দেয়, আনন্দ থেকে শুরু করে তাদের ছোট ছোট ঘরোয়া ঝগড়া পর্যন্ত সব কিছু নিয়ে।
লক্ষ্মীকান্তপুর লোকাল সব মিলিয়ে ঠিক যেন এক আধুনিক জীবনের আয়না দেখায়, সেই কাচে নিজের মুখের ছায়া খুঁজে পাওয়া যাবে ছবিতে, ঠিক সেই কারণেই এই ছবি না দেখলেই নয়!
