গা-শিউরে ওঠার মতো সেই বিষয়ই এবার বাংলা পর্দায় ধরা দিয়েছে। নেক্রোফিলিয়া, সিরিয়াল কিলিং, এক লেখকের সৃজনশীলতার সমস্যা- পরতে পরতে একাধিক রোমাঞ্চের স্তর সাজিয়ে রেখেছে ক্লিক ওটিটি প্ল্যাটফর্মের আগামী নিবেদন বিষাক্ত মানুষ, সম্প্রতি মুক্তিপ্রাপ্ত ট্রেলারেও তারই ঝলক, যে সব প্রাপ্তমনারাও যথেষ্ট সাহসী নন, তাঁদের দৃশ্যগুলো দেখতে অস্বস্তি হবেই !
advertisement
বলতেই হয়, বাংলা চলচ্চিত্র এবার বুঝি বা সাবালক হয়ে উঠল! এরকম এক বাস্তব যে চিত্রনাট্যের বিষয় হয়ে উঠতে পারে, সে কথা প্রমাণ করে দিয়েছেন অত্যন্ত মুন্সিয়ানার সঙ্গে সঞ্জীব বন্দ্যোপাধ্যায় এবং শান্তনু মুখোপাধ্যায়- বিষাক্ত মানুষ-এর গল্প, চিত্রনাট্য এবং সংলাপ তাঁদেরই অবদান। সোনম মুভিজ-এর প্রযোজনায় বিষাক্ত মানুষ পরিচালনা করেছেন সানি রায়, ছবির সম্পাকও তিনিই, গানেও রয়েছে তাঁর সৃজনশীলতার পরশ।
ছবির চিত্রগ্রাহক অনির, ট্রেলারের প্রতিটি ফ্রেমই গা-ছমছমে, আলো-আঁধারিতে আর ইঙ্গিতে মানবমনের অবচেতনের একবারে ঠিক জায়গাটিতে ঘা দিয়েছেন তিনি। বিষাক্ত মানুষ-এর সহযোগী পররিচালক নিলয় ঘোষ দস্তিদার, সঙ্গীতে রয়েছেন দীপ্তার্ক বসু আর সানি রায়। গানের কথা লিখেছেন পরিচালকের সঙ্গে একজোটে নীলাঞ্জন মণ্ডল। ব্যাকগ্রাউন্ড স্কোরেও নিজের দক্ষতা প্রমাণ করেছেন সানি, সঙ্গে রয়েছেন অনঞ্জন বন্দ্যোপাধ্যায়। ছবির জন্য গানও গেয়েছেন সানি, রয়েছেন দীপ্তার্ক বসু আর অনঞ্জন বন্দ্যোপাধ্যায়ও।
ছবিতে মূল চরিত্রে দেখা যাবে সৌরভ দাস, শুভম, রূপসা চট্টোপাধ্যায়, অনংশা বিশ্বাস, সুমনা দাস, যুধাজিৎ সরকার, রানা বসু ঠাকুর, জিনা তরফদার, পলাশ হক, বিমল গিরি প্রমুখকে। ছবির অন্যতম প্রধান চরিত্র অগ্নিভ বসু, মানসিক অশান্তি ও ব্যক্তিগত ট্রমার সঙ্গে লড়াই করা এক ব্যর্থ ঔপন্যাসিক তিনি। টানা তিনটি উপন্যাসের ব্যর্থতার পর তিনি খুঁজে ফিরছেন জীবনের এক নতুন মোড়। সেই সন্ধানেই তাঁর সাক্ষাৎ হয় তৌফিক আসিফের সঙ্গে, তিনি একজন নেক্রোফিলিক সিরিয়াল কিলার, মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত বন্দি। অদ্ভুত এই সম্পর্ক কি অগ্নিভকে এনে দেবে তাঁর কাঙ্ক্ষিত শ্রেষ্ঠ উপন্যাস? প্রকাশক-সহযোগী রুক্মিণীর সঙ্গে তাঁর সম্পর্কই বা কোন পথে এগোবে? আর তৌফিকের জীবনের অন্ধকার অধ্যায়গুলোই বা কতটা ভয়াবহ? সেই সব প্রশ্নের উত্তরের ঝলক তুলে ধরেছে বিষাক্ত মানুষ-এর ট্রেলার, উত্তর খুঁজতে হবে ছবিতে!
বিষাক্ত মানুষের পরিচালক সূর্য (সানি) রায় জানান, ‘‘এই ছবির শুটিং ছিল ভীষণ অদ্ভুত এক অভিজ্ঞতা। মানসিক ও শারীরিকভাবে আমাকে সীমার প্রান্তে ঠেলে দিয়েছিল কাজটি। বিষয়বস্তু যেহেতু সংবেদনশীল এবং মানসিক বিকৃতি নিয়ে, তাই উপস্থাপনায় যথাযথতা বজায় রাখা ছিল অত্যন্ত জরুরি। আমাদের লক্ষ্য ছিল যৌনতা–কেন্দ্রিক একটি বিষয়ে এমন একটি ছবি তৈরি করা, যা যৌনতাকে নয়, বরং মানসিক অস্থিরতাকে কেন্দ্র করে। এক কথায় বলতে গেলে—একটি ট্যাবু বিষয় নিয়ে বাণিজ্যিক বিনোদনমূলক চলচ্চিত্র তৈরি করা। আর সেটিই আমরা করেছি। সেন্সর বোর্ডও সৌভাগ্যবশত ছবিটিতে কোনও কাট ছাড়াই ছাড়পত্র দিয়েছে।”
পরিচালকের অনুপ্রেরণা এসেছিল ছবির চিত্রনাট্যকার সঞ্জীব বন্দ্যোপাধ্যায়ের কাছ থেকে। তিনি বলেন, “সঞ্জীব যখন প্রথম গল্পটি শোনাচ্ছিলেন, সেটি ছিল ভীষণ গম্ভীর একটি স্ক্রিপ্ট। অথচ আমি তখন হেসে ফেলছিলাম। কারণ মানুষের মস্তিষ্কের ভেতরে যে অদ্ভুত, অযৌক্তিক অথচ নিজের মতো করে এক ধরনের যুক্তি রয়েছে, সেটিই আমি দেখতে পাচ্ছিলাম। মানবমস্তিষ্কের অপ্রত্যাশিত স্বভাব সবসময় আমাকে মুগ্ধ করে। সেটিই মানুষকে বিশ্বের সবচেয়ে ভয়ঙ্কর প্রজাতি করে তুলেছে।”
সুর্য আরও বলেন, “নেক্রোফিলিয়া নতুন কোনও বিষয় নয়—শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে এর উপস্থিতি রয়েছে। শুধু কোভিড–১৯ সময়কালেই এটি কার্যত থেমে গিয়েছিল। সেই সময়ই আলোচনার ফাঁকে সঞ্জীব আমাকে এই গল্প শোনান। তখনই জানতাম—এই ছবিটি আমি বানাব।”
ছবির অভিনেতাদের প্রসঙ্গ টেনে পরিচালক বলেন, “আমার মনে হয়েছিল অভিনেতারা জানতেন যে তারা এক অদ্ভুত অভিজ্ঞতার মধ্যে ঢুকতে যাচ্ছেন। ওয়ার্কশপ করার মতো সময় আমাদের হাতে ছিল না, কিন্তু আমরা অনেক আলোচনা করেছি। সেই আলোচনা ছিল ভিন্ন প্রকৃতির—যা অভিনেতা আর আমার মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকুক। তবে একটি বিষয় পরিষ্কার—অভিনেতারা প্রত্যেকে মুহূর্তের কাছে নিজেদের সম্পূর্ণ সমর্পণ করেছিলেন। ছবিটি কাজ করেছে কেবল এই সমর্পণের জন্যই।”
অন্তরঙ্গ দৃশ্য নিয়ে সুর্যের বক্তব্য— “এই ছবিতে শারীরিক হিংসা এবং লিঙ্গ–বিন্যাস ভেঙে দেওয়া অন্তরঙ্গতা রয়েছে। তাই অভিনেতাদের মধ্যে পারস্পরিক বোঝাপড়া ছিল খুবই গুরুত্বপূর্ণ। আমি প্রথম থেকেই নিশ্চিত করেছিলাম যে ‘যৌনতা’ একটি ব্যক্তিগত বিষয়। তাই অভিনয়ে অভিনেতাদের কাছে আমি ব্যক্তিগত সংযম চেয়েছিলাম—অতিরঞ্জিত ভঙ্গিতে যৌনতাকে বিকৃতভাবে উপস্থাপন নয়।”
অবশেষে দর্শকদের উদ্দেশে তাঁর বার্তা—“শিশুদের অবশ্যই এই ছবি থেকে দূরে রাখুন। আমি যে ছবিই বানাই, সেটি একটি যাত্রা, একটি অভিজ্ঞতা—যা হলে থেকে বেরিয়েও দর্শকের মনে থেকে যায়। বিষাক্ত মানুষও তার ব্যতিক্রম নয়। আরও বেশি দর্শকের কাছে পৌঁছনোর জন্য আমি ইচ্ছাকৃতভাবে গালিগালাজ কিংবা মানসিক ব্যাধিকে যৌনতার সঙ্গে মিশিয়ে দেখানো থেকে বিরত থেকেছি। বরং চরিত্রগুলির মানসিক অস্থিরতাকে সঠিকভাবে তুলে ধরার দিকেই আমাদের সমস্ত ফোকাস।”
অভিনেত্রী অনংশা বিশ্বাস বলেন, ‘‘চলচ্চিত্র ‘শিরো’ চরিত্রটিতে অভিনয়ের অভিজ্ঞতাকে অনংশা বিশ্বাস বর্ণনা করেছেন মানসিক পরিশোধনের মতো। ব্যক্তিগত জীবনের একটি ভয়ংকর অভিজ্ঞতা তাঁকে এই চরিত্রে অভিনয়ের জন্য কিছুটা বিশেষভাবে প্রস্তুত করেছিল। মুম্বইয়ে একজন প্রভাবশালী পরিবারের ভদ্রলোক তাঁকে অবসেসিভভাবে অনুসরণ করত এবং বিয়ের প্রস্তাব দিয়েছিল। সেই অভিজ্ঞতা তাঁকে গভীরভাবে নাড়িয়ে দিয়েছিল, কিন্তু একইসঙ্গে আরও দৃঢ় ও ইতিবাচক মানুষ করে তুলেছিল। তাই চরিত্রে প্রবেশ করা তাঁর কাছে সহজ হয়ে উঠেছিল।
অভিনয়ের বিষয়বস্তু নিয়ে তিনি কোনো কালো–সাদা বা অন্ধকার–আলোর বিভাজন মানেন না। তাঁর মতে, কেবল দুটি ধরণের গল্প হয়—একটি ভাল গল্প বা একটি খারাপ গল্প। “শিরো” র যাত্রাপথের গল্পকে তিনি আকর্ষণীয় বলেই মনে করেন।
অস্ট্রেলিয়ায় অভিনয় শিক্ষা গ্রহণের সুবাদে অনংশা চরিত্রের প্রস্তুতির জন্য বিশেষ কিছু অভিনয়কৌশল ব্যবহার করেন। তবে সেই প্রক্রিয়ার সঙ্গে যুক্ত থাকে স্বতঃস্ফূর্ততা ও সততা, যা তাঁর অভিনয়কে পরিপূর্ণ করে তোলে। মুম্বইতে দীর্ঘ পাঁচ বছর ধরে নাসিরুদ্দিন শাহ ও বেঞ্জামিন গিলানির মতো বরেণ্য শিল্পীর সঙ্গে থিয়েটারে কাজ করার অভিজ্ঞতাও তাঁকে মহড়ার প্রতি গভীর শ্রদ্ধাশীল করে তুলেছে।
শুটিংয়ের অভিজ্ঞতা প্রসঙ্গে তিনি জানান, ছবির কাস্ট ও ক্রু সবার সঙ্গে কাজ করা ছিল আনন্দের। পরিবেশ ছিল হালকা ও প্রাণবন্ত। পরিচালক সুর্য রায়ের সঙ্গে তাঁর বোঝাপড়া ছিল অসাধারণ। তাঁদের সৃজনশীল আলোচনায় মিল খুঁজে পেয়েছেন, যা ভবিষ্যতে একসঙ্গে আরও কাজ করার আগ্রহ তৈরি করেছে। সহঅভিনেতা সৌরভ দাসের সঙ্গে কোনো দৃশ্য না থাকলেও তাঁর অভিনয়ের প্রতি নিষ্ঠাকে তিনি প্রশংসা করেছেন।
ছবিতে অন্তরঙ্গ দৃশ্য ও জেন্ডার–বিভ্রান্ত ঘনিষ্ঠতা নিয়ে অনংশা বিশ্বাস একেবারেই স্বচ্ছ। তাঁর মতে, ভালবাসা মানে ভালবাসা, অন্তরঙ্গতা মানে অন্তরঙ্গতা—এখানে লিঙ্গ বা অভিমুখের কোনও গুরুত্ব নেই। সহ অভিনেত্রী রূপসা চট্টোপাধ্যায়ের সঙ্গে কাজ করাও ছিল সহজ ও আনন্দের ৷ দৃশ্যের ফাঁকে তাঁরা একসঙ্গে হাসাহাসি করে সময় কাটিয়েছেন।