২৬ তম আন্তর্জাতিক বুসান চলচ্চিত্র উৎসবে যুগ্মভাবে ‘কিম জিসোক পুরস্কার’-এ সম্মানিত ‘দ্য রেপিস্ট’৷ অনেক অভিনন্দন আপনাকে৷ আপনার শিরোপায় আরও একটি পালক যুক্ত হল৷
অপর্ণা : ধন্যবাদ৷
হিন্দি ভাষায় এই ছবিটা করার পিছনে কি কোনওভাবে দিল্লিতে ‘নির্ভয়া’-র ঘটনা ছায়া ফেলেছে?
অপর্ণা : শুধু নির্ভয়া নয়৷ আরও অনেক ধর্ষণের ঘটনা চারদিকে হয়েছে এবং হয়ে চলেছে৷ এই সব মিলিয়েই আমার মনে একটা ভাবনা জন্মায়৷ যে, এত ধর্ষক জন্মাচ্ছে কেন? শুধু আমাদের এখানে নয়৷ সব সমাজে৷ তার থেকেই আমি ভাবলাম এর দায় কি কোনওভাবে সমাজ এড়াতে পারে?
advertisement
‘দ্য রেপিস্ট’ ছবির মাধ্যমে আপনি কি সেই বার্তাই দিতে চেয়েছেন যে একজন ধর্ষকের জন্মের পিছনে সমাজের দায়বদ্ধতা আছে?
অপর্ণা : একটা দায়িত্ব আছে বৈ কী! বাবা মায়েদের দায়িত্ব আছে৷ ভীষণভাবে৷ যে তাঁরা যখন সন্তানদের মানুষ করছেন, বড় করছেন, তখন যেন সন্তানদের মধ্যে পিতৃতান্ত্রিক মূল্যবোধ গেঁথে না যায়৷ কারণ এই পিতৃতান্ত্রিক মূল্যবোধের ফলে মেয়েদের ভোগ্যপণ্য হিসেবে দেখা হয়, যে তাঁদের উপর যা খুশি করা যায়! অনেক সময়েই একজন নারী যদি পুরুষকে প্রত্যাখ্যান করেন তাহলে তাঁকে অ্যাসিড হামলার শিকার হতে হয়৷ ধর্ষণ তো খুব পরিচিত অত্যাচার৷ এর মাধ্যমে একজন নারীকে ‘অবোলা’ করে দেওয়া যায়৷ শক্তিহীন করে দেওয়া যায়৷ এ সবই কিন্তু পিতৃতান্ত্রিক মূল্যবোধের কুফল৷ সমাজে জাঁকিয়ে বসেছে এই মূল্যবোধ৷ ‘দ্য রেপিস্ট’-এই যেমন আছে, নয়নার স্বামী আফতাব, মানে যে ভূমিকায় অর্জুন রামপাল অভিনয় করেছেন, সে নয়নাকে জিজ্ঞাসা করছে, যারা ধর্ষণ করে তাদের সকলেরই কি শৈশব খুব খারাপভাবে কাটে? উত্তর হল, শৈশব ভালখারাপের প্রশ্ন নয়৷ আসলে এরা সকলে পিতৃতান্ত্রিক মূল্যবোধের মধ্যে বড় হয়ে উঠেছে৷ বড় হয়ে না উঠলেও কোনও খান থেকে কোনও ভাবে তাদের মধ্যে পিতৃতান্ত্রিক মূল্যবোধ ঢুকে পড়েছে৷ বাবা মা, পরিবারের অন্য কোনও সদস্য, আত্মীয়স্বজন, বন্ধুবান্ধব, পারিপার্শ্বিক-কোথাও থেকে কোনও না কোনওভাবে তার মধ্যে পিতৃতান্ত্রিক মূল্যবোধ এসেছে৷ তবে মূল দায়িত্ব কিন্তু শেষ পর্যন্ত বাবা মায়েরই৷
আরও পড়ুন : অফলাইন স্কুলের লেখাপড়া নিয়ে সন্তানের আতঙ্ক কাটছেই না? রইল বিশেষজ্ঞের সমাধান
এখন সংবাদপত্র তথা সংবাদমাধ্যমে ধর্ষণের ঘটনা নিয়মিত উঠে আসে৷ তাহলে কি আগের থেকে ধর্ষণ বেড়ে গিয়েছে? নাকি এখন ধর্ষণের মতো অপরাধ সাধারণ সমাজেও অন্তত অভিযোগের স্তর অবধি পৌঁছয়?
অপর্ণা : মেয়েদের উপর অত্যাচার সব সময় হয়ে এসেছে৷ সাহিত্যে কত পড়েছি! নীলচাষিদের পরিবারের মেয়েদের উপর অত্যাচার করেছে নীলকর সাহবেরা৷ নিগৃহীতা মেয়েদের ওষুধ খাওয়ানো হয়েছে যাতে তাঁরা অন্তঃসত্ত্বা হয়ে না পড়েন৷ কত শোনা গিয়েছে যে বাঁশবনে বা ধানক্ষেতে ধর্ষিতার নিথর দেহ পাওয়া গিয়েছে৷ আর ধর্ষণ হলে সব সময় দোষ দেওয়া হত মেয়েটিকেই৷ পুরুষের কোনও দোষ নেই!
এখন কি দোষারোপের সেই ছবিটা পাল্টেছে?
অপর্ণা : অনেকটাই পাল্টেছে৷ কিন্তু এখনও অনেকেই সেই মেয়েদেরই দোষ দেন৷ কেন এই ধরণের পোশাক সে পরল? কেন ওই সময়ে ওখানে গেল? কিন্তু একটি মেয়েকে সুরক্ষা দেওয়ার দায়িত্ব তো সমাজের, প্রশাসনের৷ যদি নারীকে সুরক্ষা দিতে না পারে, তাহলে প্রশাসন ব্যর্থ৷ কিন্তু তাই বলে একজন মেয়ে বোকার মতো সেখানে চলে যাবে যেখানে সে ধর্ষিতা হতে পারে-এটাও আমি সমর্থন করি না৷ আমার দর্শন মডারেট৷ একটা ঘটনার অনেকগুলো দিক আমি দেখি৷ শুধুমাত্র একটা দিক ধরে বসে থাকি না৷ অনেকেই আমাকে ফেমিনিস্ট বলেন৷ অবশ্যই আমি ফেমিনিস্ট৷ প্রাউড ফেমিনিস্ট৷ তবে আমার ফেমিনিজম আসে বেসিক হিউম্যানিজম থেকে৷ মানবতাবাদেরই অংশ নারীবাদ৷ মেয়েদের উপর অত্যাচার, শিশুদের উপর নির্যাতন আমায় ভাবায়৷ কষ্ট দেয়৷
সেই ভাবনারই ফসল ‘দ্য রেপিস্ট’?
অপর্ণা : হ্যাঁ৷ আমার কাজ তো কোনও প্রচারকের নয়৷ আমি কোনও মতবাদ প্রচার করিনি৷ আমার মনে যে প্রশ্নগুলো এসেছে, সেগুলো তুলে ধরেছি৷ আমার কাজ ছবি তৈরি করা৷ সেটাই করেছি৷ কোনও পক্ষ নিইনি৷ যথাসম্ভব নিরপেক্ষ থাকার চেষ্টা করেছি৷
আরও পড়ুন : কোভিডে প্রিয়জনকে হারানোর দুঃখ নিয়েই বসতে হচ্ছে মাধ্যমিকে? মন শক্ত করার উপায় বললেন মনোরোগ বিশেষজ্ঞ
প্রাণদণ্ড কি একজন ধর্ষকের জন্য উপযুক্ত শাস্তি?
অপর্ণা : আমি মৃত্যুদণ্ডে বিশ্বাস করি না৷ বহু দেশ প্রাণদণ্ড তুলে দিয়েছে৷ গবেষণায় প্রমাণিত হয়েছে, প্রাণদণ্ড দিয়ে কিন্তু অপরাধ থেকে বিরত রাখা যায় না৷ ধর্ষণের ক্ষেত্রে মধ্যপন্থায় নতুন শাস্তির কথা ভাবা হচ্ছে এখন৷ সেটা হল, অপরাধী ও নির্যাতিতার মুখোমুখি কথা বলা৷ একে বলা হচ্ছে ‘রেস্টোরেটিভ জাস্টিস’৷ এই পদ্ধতি আমি ছবিতে আনিনি৷ কিন্তু পন্থাটি অবলম্বন করেছি৷ যেখানে মেয়েটি জানতে চায়, কেন সে ধর্ষিতা হল?
একজন ধর্ষকের জন্ম হল কেন? এর পিছনে সমাজের দায়বদ্ধতা কতটা?-এটাই কি ‘দ্য রেপিস্ট’-এর উপজীব্য?
অপর্ণা : নিশ্চয়ই৷ কোনও পুরুষ তো আর ধর্ষক হয়ে জন্মায় না৷ সে শিশু হয়েই ভূমিষ্ঠ হয়৷ মায়ের আঁচল ধরে ঘোরে৷ পড়ে গেলে ব্যথা পায়৷ তার পর ধীরে ধীরে কী করে পিতৃতান্ত্রিক মূল্যবোধ তাকে রেপিস্ট-এ পরিণত করে, সেটা ঘিরেই আবর্তিত হয়েছে ছবির পটভূমি৷ সে ছোট থেকে দেখছে বাবা তার মাকে মারে৷
ম্যারিটাল রেপের প্রসঙ্গও তো সেইসঙ্গে উঠে এসেছে?
অপর্ণা : অবশ্যই৷ আমরা ধরেই নিই বিয়ের পর স্বামীর কাছে স্ত্রী ধর্ষিতা হতে পারেন না৷ অথচ দিনের পর দিন তিনি ধর্ষিতা হয়ে চলেন৷ এক জন শিশু এটা দেখেই বড় হয় যে মেয়েদের যখন খুশি মারা যায়৷ যখন ইচ্ছে রেপ করা যায়৷ মেয়েদের সতীত্ব রক্ষার ভার শুধু মেয়েদেরই!
আরও পড়ুন : ‘ক্রনিক রেসপিরেটরি ডিজিজে বছরভর এড়িয়ে চলুন ফ্রিজের ঠান্ডা খাবার এবং ঠান্ডা জলে স্নান’
ছবির শ্যুটিঙের কথা একটু বলুন৷ আপনারা তো কোভিড অতিমারির প্রথম ও দ্বিতীয় তরঙ্গের মাঝে খুব দ্রুততার সঙ্গে শ্যুটিং সেরেছেন?
অপর্ণা : আমরা সকলে কোভিড প্রোটোকল মেনে শ্যুটিং শুরু করেছিলাম৷ কিন্তু সব সময় তো আর অত বিধিনিষেধ মেনে চলা যায় না, অন্তত শ্যুটিঙের সময়৷ আমরা সকলে একই হোটেলে ছিলাম৷ সেটা একটা বাবল৷ কিন্তু হলে কী হবে! হোটেলে অন্যরাও তো ছিলেন৷ সকলে একসঙ্গে প্রাতরাশ করছেন৷ খাওয়ার সময় তো আর মুখে মাস্ক পরে থাকা যায় না৷ তার পরও আমরা সকলে সুস্থ থেকেই কাজ শেষ করেছি৷ আমরা যেদিন শ্যুটিং সেরে কলকাতায় ফিরলাম, তার দু’দিন পরই বোধহয় লকডাউন হল৷ নির্ধারিত সূচির আগে ২৭ দিনে পুরো শ্যুটিংপর্ব শেষ হয়েছে৷
তার পর পোস্ট প্রোডাকশনের কাজ? লকডাউনের মধ্যে তো বেশ অসুবিধেই হয়েছে বোধহয়?
অপর্ণা : কিছুটা অসুবিধেজনক ছিল৷ তবে আমরা তিন-চার জন গিয়ে কাজটা করেছি৷ স্টুডিও বন্ধই ছিল৷ শুধু আমাদের অনুমতি দেওয়া হয়েছিল গিয়ে কাজ করার জন্য৷ আমরা সবরকম কোভিড প্রোটোকল মেনেই পোস্ট প্রোডাকশনের কাজ করেছি৷
এত দিন পর মেয়ের সঙ্গে কাজ করলেন৷ কেমন লাগল?
অপর্ণা : মেয়ের সঙ্গে কাজ করতে আমার খুব ভাল লাগে৷ আমাদের মধ্যে পারস্পরিক বিশ্বাস ও নির্ভরতা আছে৷ আমাদের মূল্যবোধ একই৷ আমরা একে অন্যকে জানি, চিনি৷ ফলে কাজের ক্ষেত্রে একটা সুবিধে তো হয়ই৷ আমি বুঝতে পারছি, কঙ্কণা কখন ক্লান্ত হয়ে পড়ছে, এর পর আর শট দিতে পারবে না৷ ও-ও যেমন বোঝে কখন মাকে বিরক্ত করা যাবে না৷ মা এই সময় খুব ব্যস্ত, আমি আর পিছনে লাগব না৷ মা যা বলছেন, সেটা করে যাই চুপচাপ৷ এই বোঝাপড়ায় তো কাজের ক্ষেত্রে খুব সুবিধে হয়ই৷ তাছাড়া মা-মেয়ে বিষয়টা বাদ দিলেও কঙ্কণা এমন একজন অভিনেত্রী, যাকে ইংরেজিতে বলে ‘ওভার দ্য টপ’৷ ওর খুব সুন্দর মাত্রাজ্ঞান আছে৷ ও জানে, কোথায় থামতে হবে৷ তার বাইরে ও যায় না৷ সব সময় ও প্রস্তুত৷ সংলাপটা ও মুখস্থ করে আসে৷ কিন্তু তার বাইরে ওর প্রস্তুতি খুব একটা চোখে দেখা যায় না৷ এছাড়া আমি ওয়ার্কশপ করি৷ শুধু কঙ্কণার জন্য নয়৷ সকলের জন্যই৷ এই অ্যাক্টিং ওয়ার্কশপ খুব কার্যকর হয়৷ ওয়ার্কশপ কিন্তু রিহার্সাল নয়৷ কিন্তু আমার ছবির কুশীলবদের চরিত্র হিসেবে একে অন্যের সঙ্গে দেখা হয় ওয়ার্কশপেই৷
মাল্টিপ্লেক্সে কি ‘দ্য রেপিস্ট’ আসবে?
অপর্ণা : প্রযোজকরা বোধহয় ওটিটি-তে আনছেন৷ এখন ওটিটি প্ল্যাটফর্ম অনেক বেশি জনপ্রিয়৷ সেখানে সেন্সর নিয়ে চাপ নেই৷ ইন্টারমিশন নেই৷ বিরতি বা ইন্টারমিশনে চিন্তাধারা ব্যাহত হয়৷
আপনার পরবর্তী ছবির বিষয়বস্তু কী?
অপর্ণা : পরবর্তী ছবি বা কাজ নিয়ে না এখনও কিছু ভাবিনি৷ তাই এক্ষুণি বলতে পারব না৷