বাংলা ছবির দর্শককে ফের মাল্টিপ্লেক্সমুখী করে তোলার দায়িত্বে অগ্রণী শিবপ্রসাদ-নন্দিতা জুটি৷ পুজোর সময় মুক্তি পাওয়া ‘বহুরূপী’-র ব্লকবাস্টার সাফল্যের মতো না হলেও রাখী গুলজারের প্রত্যাবর্তনের সাক্ষী থাকতে দর্শকদের ভিড় চোখে পড়ার মতো৷ ছবিতে একইসঙ্গে উঠে এসেছে একাধিক ইস্যু৷ যেগুলির চারপাশে ঘুরপাক খায় মা-ছেলের সম্পর্ক৷
ছবিতে শিবপ্রসাদ বাংলা প্রকাশনা সংস্থার মালিক৷ অফিসে তিনি অনিমেষ গোস্বামী, জাঁদরেল বস৷ অধস্তন কর্মীদের সঙ্গে রূঢ় ব্যবহার করে কাজ আদায় করে নেওয়াই তাঁর জীবনের একমাত্র লক্ষ্য৷ আবার অফিস শেষে বাড়িতে ফিরে তাঁকেই মায়ের পাশে বসতে হয় বাধ্য সন্তান হয়ে, করুণ মুখে৷ দোর্দণ্ডপ্রতাপ অনিমেষেরও বস আছে৷ এবং মা শুভ্রা গোস্বামীই তাঁর দণ্ডমুণ্ডের কর্ত্রী৷ কঠিন ব্যক্তিত্বের আড়ালে নরম মন দিয়ে ছেলের জীবনের দুর্বলতা, ভাঙাচোরা তীক্ষ্ণ খোঁচাগুলি সযত্নে আগলে রাখেন শুভ্রা৷ যাতে সেই ধারালো আঘাতে রক্তক্ষরণ না হয়৷
advertisement
অনিমেষের স্ত্রী মৌসুমী কেরিয়ারের সিঁড়িতে পা রাখতে চলে গিয়েছেন অন্য শহরে৷ ভাঙতে বসা সেই সম্পর্কের ক্ষরণেই কি অফিসে কর্কশ বস অনিমেষ? সেই উত্তর খোঁজার দায় দর্শকদের উপরই রেখেছেন পরিচালকদ্বয় এবং শুভ্রার চরিত্রে রাখী গুলজারও৷ মনস্তাত্ত্বিক অলিগলিতে পা না রেখে বরং একদিন অফিসে আসেন বসেরও বস৷ অনিমেষ, তাঁর আদরের লাড্ডুর সঙ্গে অফিসে আসেন শুভ্রা৷
তার পরই ধীরে ধীরে পাল্টাতে থাকে অফিসের ছবিটা৷ কর্মীদের ব্যক্তিগত সমস্যাগুলির সঙ্গে একাত্ম হয়ে যান শুভ্রা৷ পেশায় প্রাক্তন নার্স এই প্রৌঢ়া বিশ্বাস করেন বাড়িতে সব ঠিকঠাক থাকলে তবেই কাজের জায়গায় সেরাটা উজাড় করে দেওয়া যায়৷ এবং উল্টোটাও সত্যি৷ কর্মস্থান ঝঞ্ঝাটমুক্ত হলে তার মসৃণ প্রভাব পড়ে পারিবারিক জীবনেও৷ না হলে পেশা আর ব্যক্তিগত জীবন মিলেমিশে চচ্চড়ি বা ছ্যাঁচড়া হয়ে যেতে বাধ্য৷
তাই শুভ্রা তাঁর ছেলেকে শেখান অফিসে কর্মীদের সঙ্গে ভদ্র ব্যবহার করতে৷ তাঁদের পরিবারের সমস্যাগুলো শুনতে৷ তাঁদের প্রতি সহমর্মী হতে৷ সেই টান থেকেই ছেলের বিরুদ্ধে গিয়ে অফিসে সিনিয়র সিটিজেনদের জন্য ডে কেয়ার সেন্টার শুরু করেন শুভ্রা৷ যাতে বাড়িতে রেখে আসা বয়স্ক বাবা মায়ের জন্য কাজের সময়ে চিন্তা করতে হয় না সন্তানদের৷ কিন্তু ছকভাঙা উদ্যোগ শুরু করলেই তো আর হল না! স্বয়ং সংস্থার কর্ণধার, তাঁর সন্তানই এই উদ্যোগের বিরুদ্ধে৷ এ ছাড়াও আসে আর্থিক প্রতিবন্ধকতা৷ সে সব পেরিয়ে শুভ্রা কি পারবেন সংস্থার কর্মীদের বয়স্ক বাবা মায়ের জন্য এই আশ্রয়ের ছাদ অটুট রাখতে? অনিমেষ কি হয়ে উঠতে পারবেন সহমর্মী বস? নতুন সম্পর্কের হাতছানি ফেলে স্ত্রী মৌসুমী কি ফিরে আসবে অনিমেষের কাছে? সব উত্তর অপেক্ষা করে আছে ক্লাইম্যাক্সে৷
কিন্তু আজকের এই রিলসসর্বস্ব দিনে সিনেমার যবনিকা পতন পর্যন্ত দর্শকদের আগ্রহ ধরে রাখতে গেলে যে মুনসিয়ানা দরকার, তার যেন কিছুটা অভাব রয়ে গেল নির্মাণে৷ শুভ মহরতের রাঙা পিসিমার ছোঁয়া পাওয়া গেল না শুভ্রা গোস্বামীর মধ্যে৷ বরং ছোট্ট ভূমিকায় এক ঝলক টাটকা বাতাস বয়ে আনে সাবিত্রী চট্টোপাধ্যায়ের অভিনয়৷ এখনও এতটাই চুম্বক উপস্থিতিতে, তিনি পর্দায় থাকলে নজর আটকে থাকবে তাঁর দিকেই৷ অন্যান্য ছবিতে শিবপ্রসাদের যে সহজাত এবং প্রাণবন্ত অভিনয় দেখতে দর্শক অভ্যস্ত, সেটারও যেন খানিক ছন্দোপতন হয়েছে এই ছবিতে৷ শ্রাবন্তী চট্টোপাধ্যায়, কাঞ্চন মল্লিক, সৌরসেনী মৈত্র-সহ বাকি কুশীলবরা যথাযথ চিত্রনাট্যের সঙ্গে তাল মিলিয়ে৷
তবে সহজেই অনুমেয় পরিণতি, ধারহীন সংলাপের মতো খামতি ছাপিয়ে যায় এ ছবির সামাজিক বার্তা৷ কর্পোরেটদের সামাজিক দায়িত্ব তো বটেই৷ বাংলা প্রকাশনার প্রতিবন্ধকতা, বাংলা ভাষার অবনমন, বাংলা সাহিত্য নিয়ে উচ্চশিক্ষার অধোগতি, বাংলা নিয়ে উচ্চশিক্ষা সম্পন্ন করাদের প্রতি তাচ্ছিল্য, দাম্পত্যে দূরত্ব এবং কলকাতা তথা বাংলা ছেড়ে প্রতিভাদের ভিনদেশ পাড়ির মতো আমার-আপনার গায়ে লেপ্টে থাকা প্রসঙ্গগুলি তুলে ধরার জন্য নির্মাতা জুটিকে কুর্নিশ৷ মন ছুঁয়ে যাবে ছবির গান এবং আবহসঙ্গীতও৷ ওটিটি অভ্যস্ত নাক মেগা ধারাবাহিকের গন্ধ পেলেও এ ছবি ছুঁয়ে গিয়েছে তাঁদের বাবা মায়েদের মন৷