সঞ্চয় বাবু বলেন, রাস্তার অপরিচিত মানুষের কাছে অনেক কথা শুনেছি। কষ্ট হত, “তবে আমি কোনও কিছুকে পাত্তা না দিয়ে এগিয়েছিলাম। এখন আমার বেশ ভাল লাগে। তবে বাবা বেঁচে থাকলে আমার সাফল্য দেখে অনেকটা খুশি হতেন।” ছোটবেলায় সাঁফুয়া প্রাথমিক বিদ্যালয়ে পড়াশোনা শুরু। গ্রাম থেকে পড়াশোনার সুবিধার জন্য তাঁর বাবা পরিবার-সহ তাঁকে নিয়ে চলে আসেন শহর সংলগ্ন ভাদীশ্বর গ্রামে। সেখানেই ধীরে ধীরে শুরু হয় তাঁর নতুন লড়াই।
advertisement
আরও পড়ুন: দেশের সেরা বিশ্ববিদ্যালয়ের তালিকায় যাদবপুর, NIRF র্যাঙ্কিংয়ে বাংলার আর কোন কোন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান?
২০০৯ সালে মাধ্যমিক এবং তারপর ২০১১ সালে উচ্চমাধ্যমিক পাশ করেন তিনি। এরপর ভর্তি হন সিউড়ি বিদ্যাসাগর কলেজে ইংরেজি অনার্স নিয়ে। তবে রেজাল্ট আশানুরূপ না হওয়ায় তিনি ব্যর্থতার স্বাদ পান। কিন্তু হাল ছাড়েননি। ২০১৩ সালে নতুন করে ভর্তি হন মুরারই কবি নজরুল কলেজে বাংলা অনার্স নিয়ে এবং ২০১৬ সালে পাশ করেন সাফল্যের সঙ্গে। তারপর বর্ধমান বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাংলা এমএ সম্পন্ন করেন ২০১৮ সালে। একই বছরে রাজ্যের গুরুত্বপূর্ণ সেট পরীক্ষাতেও উত্তীর্ণ হন। তবে এখানেই থেমে থাকেননি তিনি।
২০১৯ সালে বিদ্যাসাগর বিশ্ববিদ্যালয়ে এমফিল করার সুযোগ পান এবং ২০২১ সালে সম্পন্ন করেন। এরপর ২০২২ সালে শুরু করেন পুরুলিয়ার সিধো কানহো বিরসা বিশ্ববিদ্যালয়ে পিএইচডি। সেই বছরেই কলেজ সার্ভিস কমিশনের পরীক্ষা দেন এবং ২০২৩ সালের ডিসেম্বরে ফল প্রকাশিত হলে দেখা যায় তিনি সফল। অবশেষে ২০২৪ সালের ৭ ফেব্রুয়ারি পূর্ব বর্ধমানের চন্দ্রপুর কলেজে সহকারী অধ্যাপক হিসেবে যোগদান করেন সঞ্চয় মণ্ডল। চন্দ্রপুর কলেজের ভারপ্রাপ্ত শিক্ষক অশোক কুমার সাহা রায় বলেন, “সাধারণ ভাবে যারা সক্ষম তাদের থেকে তিনি আলাদা। সঞ্চয় মণ্ডল চন্দ্রপুর কলেজের বাংলা বিভাগের অধ্যাপক। তিনি অনেকদিন ধরেই এই কলেজে শিক্ষকতা করে আসছেন। সঞ্চয় মণ্ডল আমাদেরই একজন, বিশেষ ভাবে সক্ষম হিসেবে আমরা দেখিনা।”
আরও পড়ুন: দেশের সেরা বিশ্ববিদ্যালয়ের তালিকায় যাদবপুর, NIRF র্যাঙ্কিংয়ে বাংলার আর কোন কোন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান?
তবে এই শিক্ষককে দেখে প্রথম প্রথম পড়ুয়াদের একটু অন্যরকম লাগলেও এখন তাঁদের কাছেও পছন্দের হয়ে উঠেছেন সঞ্চয় বাবু। এই প্রসঙ্গে চন্দ্রপুর কলেজের বাংলা বিভাগের চতুর্থ সেমিস্টারের ছাত্রী রিয়া ঘোষ বলেন, “স্যার খুব ভাল মনের মানুষ, খুব ভাল ভাবে ক্লাস নেন। প্রথম স্যারকে দেখে একটু অন্যরকম লাগলেও এখন বেশ ভাল লাগে ক্লাস করতে।” কলেজের অন্যান্য অধ্যাপক অধ্যাপিকাদের সঙ্গেও বেশ ভাল সম্পর্ক রয়েছে সঞ্চয় বাবুর। কোনও রকম সাহায্যের প্রয়োজন হলে ছুটে আসেন সকলেই। ইতিহাস বিভাগের সহকারী অধ্যাপক প্রেমানন্দ মুর্মু বলেন, “যতটা জানি সঞ্চয় মানুষ হিসেবে খুব ভাল। গর্বের বিষয় এত প্রতিকূলতা কাটিয়েও ও চাকরি পেয়েছে আর প্রথম চাকরি সেটাও কলেজে, এটা সত্যিই আনন্দের।”
আজ সঞ্চয় মণ্ডল শত শত ছাত্রছাত্রীর প্রিয় শিক্ষক। যাঁরা একসময় তাঁকে নিয়ে হাসাহাসি করেছিল, আজ তাঁদের সামনে তাঁর সাফল্যই সবচেয়ে বড় জবাব। শারীরিক সীমাবদ্ধতা নয়, মানুষের আসল শক্তি তার ইচ্ছাশক্তি আর অধ্যবসায় , সঞ্চয় মণ্ডল সেই শিক্ষায় যেন দিয়ে চলেছেন সকলকে। শিক্ষক দিবসের দিনে তাঁর এই জীবনের গল্প কেবল ছাত্রছাত্রী নয়, সমাজের প্রত্যেকের কাছেই এক অমূল্য অনুপ্রেরণা।